বাংলাট্রিবিউন:
মহামারির মধ্যে সরকার জাতীয় সংসদে যে বাজেট উপস্থাপন করেছে তার সুনাম নষ্ট করতে পারে উচ্চশিক্ষায় ভ্যাট। শুধু তাই নয়, ভ্যাট নিয়ে ফের উত্তপ্ত হতে পারে শিক্ষাঙ্গনও। এরইমধ্যে বিভিন্ন পক্ষ থেকে শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়।

প্রসঙ্গত, ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। যদিও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান। অর্থমন্ত্রী নতুন বাজেটে এই অলাভজনক প্রতিষ্ঠান থেকেও ভ্যাট নিতে চান। শুধু তাই নয়, সঙ্গে বেসরকারি কলেজ, পলিটেকনিক ও মেডিক্যাল কলেজ থেকেও ভ্যাট আদায় করতে চান তিনি।

এদিকে বাজেট উত্থাপনের একদিন পরই এই কর প্রত্যাহারের দাবি জানিয়েছেন শিক্ষার্থী ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগঠনসমূহ। শিক্ষার্থীরা বলছেন, এর ফলে তাদের শিক্ষার ব্যয় বাড়বে। এ ধরনের সিদ্ধান্তে ড্রপ আউটও (ঝরে পড়া) বাড়বে। দারুণ বাধার মুখে পড়বে উচ্চশিক্ষা।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ট্রাস্টি ও সংশ্লিষ্টরা দাবি করছেন, অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের ওপর ভ্যাট বসানো বেআইনি। এ ছাড়া বিভিন্ন মহল থেকেও এ ভ্যাট আরোপের প্রস্তাবে সমালোচনা শুরু হয়েছে।

প্রস্তাবিত ২০২১-২২ অর্থবছরে বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর কর বাড়ানো যৌক্তিক নয় বলে মনে করছে বেসরকারি সংস্থা-উন্নয়ন সমন্বয়। শনিবার (৫ জুন) বাজেট-পরবর্তী এক ওয়েবিনারে সংস্থাটির পক্ষ থেকে এ মন্তব্য করা হয়। এ ছাড়া শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তরের পাঁয়তারার অভিযোগ তুলে ছাত্ররা শুক্রবার (৪ জুন) বিকালে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে বিক্ষোভ করেছে।

এদিন বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে ‘নো ভ্যাট অন এডুকেশন’ ব্যানারে সংবাদ সম্মেলন করে ভ্যাট প্রত্যাহারসহ ৬ দফা দাবি তুলে ধরেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তা তুললে কঠোর আন্দোলনের হুমকিও দেন তারা।

এদিকে এই ১৫ শতাংশ করারোপ ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ পরিপন্থী বলে অভিহিত করেছে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি। শুক্রবার (৪ জুন) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ অভিমত দেওয়া হয়েছে। সংগঠনটি প্রস্তাবিত বাজেটে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ প্রত্যাহার চেয়ে অস্তিত্ব সঙ্কটে থাকা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে প্রণোদনা দেওয়ার দাবি জানিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত। আর ১৮৮২ সালের ট্রাস্ট আইন অনুযায়ী ট্রাস্টের অধীনে পরিচালিত হওয়ায় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান করযোগ্য নয়। ফলে প্রস্তাবিত বাজেটে যে ভ্যাট আরোপের কথা বলা হয়েছে, তা আইনসিদ্ধ হয়নি।

চলছে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনার দুর্যোগে অর্থ সঙ্কটে পড়া বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই করছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আয়ের একমাত্র উৎস শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি। সেটাও এখন নিয়মিত পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ভ্যাট নয়, সরকারের উচিত প্রণোদনার মাধ্যমে সহায়তার হাত বাড়ানো।

প্রসঙ্গত, এর আগে ২০১৫-১৬ অর্থবছরের বাজেটেও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ১০ শতাংশ ভ্যাটের প্রস্তাব করা হয়। প্রতিবাদে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। প্রথমে রাজধানী, পরে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে সেই আন্দোলন। এক পর্যায়ে বাধ্য হয়ে সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে সরকার।

জানা গেছে, এর আগে এনবিআর এসআরও জারি করে ভ্যাট নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এবার আইন করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ করারোপ করতে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সাবেক চেয়ারম্যান মো. আব্দুল মজিদ বলেন, এতদিন এনবিআর এসআরও জারি করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কাছ থেকে ভ্যাট নেওয়ার চেষ্টা করতো। ওই এসআরও যে কোনও সময় বাতিল বা সংশোধন করা যেত। এবার জাতীয় সংসদে যে প্রস্তাব করা হয়েছে তা যদি পাস হয়, তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্যতামূলক আয়ের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে।

প্রসঙ্গত, অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল তার বাজেট প্রস্তাবে দেশীয় শিল্প রক্ষায় বিভিন্ন খাতে কর কমানোর পাশাপাশি বিভিন্ন মেয়াদে কর অব্যাহতির ঘোষণায় যতটা বাহবা পাচ্ছেন, তার চেয়ে বেশি সমালোচিত হচ্ছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভ্যাট নেওয়ার ঘোষণায়।

বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছেন ‘প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রযোজ্য সাধারণ কর হার হ্রাস করে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ, বেসরকারি ডেন্টাল কলেজ, বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ বা কেবল তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ে শিক্ষাদানে নিয়োজিত বেসরকারি কলেজ থেকে আয়ের ১৫ শতাংশ হারে কর নির্ধারণ করা হয়েছিল। সংসদে আমি এ করহার অর্থ আইনের মাধ্যমে ১৫ শতাংশ করার প্রস্তাব করছি।’

জানা গেছে, বিগত বছরগুলোতে বাজেট অধিবেশন চলতো একমাস। সংসদ সদস্যরাও যে কোনও ইস্যুতে পক্ষে-বিপক্ষে টানা একমাস কথা বলার সুযোগ পেতেন। এবার করোনার কারণে সংসদ সদস্যরা টানা একমাস কথা বলতে পারবেন না। ফলে সংসদের বাইরে এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রতিক্রিয়া আসবে। এই ইস্যুতে তৈরি হতে পারে অস্বস্তিকর পরিস্থিতি।

মো. আব্দুল মজিদ মনে করেন, অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি এড়াতে সংসদীয় কমিটি বিষয়টি পর্যালোচনা করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করতে পারে।

এদিকে অভিভাবকদের অনেকেই বলছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয়ের ওপর করারোপ হলে শিক্ষার্থীদের ব্যয় বাড়বে। করোনায় এমনিতেই আর্থিক সঙ্কট চরমে। আবার হাতেগোনা দু-একটি ছাড়া অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান তাদের শিক্ষক-কর্মচারীদের পুরো বেতনও নিশ্চিত করতে পারেনি। কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান অর্ধেক বেতন দিয়েছে। অন্যদিকে অর্থাভাবে এখনও অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা কার্যক্রম চালুই করতে পারেনি। এসবের মধ্যে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ হলে বেসরকারি শিক্ষাখাতে বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।