সুনীল বড়ুয়া, বাংলানিউজ, কক্সবাজার:
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর ড্রেজিং প্রকল্পে নদী থেকে উত্তোলন করা বালু নদীর বুকে রেখেই চলছিল ড্রেজিং প্রকল্পের-এর কাজ। এমন পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন এলাকাবাসী আশংকা করছিল, নদীতে পানি বাড়ার সাথে সাথে বালু নদীতেই চলে যাবে। এতে বহু আকাংখিত এ প্রকল্পের সুফল পাবেনা এলাকাবাসী।
শেষ পর্যন্ত এলাকাবাসীর আশংকা সত্যি হল। গত কয়েকদিনের প্রবল বর্ষনে পাহাড়ী ঢল নেমে আসায় রামুর আতিক্কাবিবির ঘাট,হাইটুপী, ভুতপাড়া,গাউচ্ছাপাড়াসহ বিভিন্ন পয়েন্টে নদী থেকে উত্তোলন করা বালুর সিংহভাগ নদীতেই তলিয়ে গেছে। এমনকি নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ায় কারণে বালু তুলে আনা কঠিন হয়ে গেলে গত বৃহস্পতিবার ( ৩ জুন) রামুর হাইটুপি ভুতপাড়া অংশে রাতের আঁধারে স্কেভেটর দিয়ে বিপুল পরিমান বালু পানিতে মিশিয়ে দিয়েছে স্বয়ং ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওয়ের্ষ্টান ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড। এমন অভিযোগ স্থানীয়দের।
উল্লেখ্য গত ২৫ এপ্রিল বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরডটকম-এ “নদীর বালু নদীতে রেখেই চলছে ড্রেজিং” এবং ২৭ এপ্রিল “বাঁকখালী ড্রেজিং- কার্যাদেশের অাগেই ৬ কোটি টাকার বালু বিক্রি” শিরোনামে দুটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়।
২৫ এপ্রিল প্রথম প্রতিবেদন প্রকাশের পর ওইদিনই কক্সবাজার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. আমিন আল পারভেজ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। এবং নদীর বুকে মজুদ করা বালু পরবর্তী একসপ্তাহের মধ্যে তুলে ফেলার নির্দেশ দেন। কিন্তু প্রায় দেড়মাস হলেও সেই নির্দেশনা মানা হয়নি ।
স্থানীয় ভুত পাড়ার বাসিন্দা এবং একটি আন্তজার্তিক সংস্থায় কর্মরত নুরুল আমিন বাংলানিউজকে বলেন, আমরা রীতিমত অবাক হয়েছি,ড্রেজিং করে তোলা বালু রাতের আঁধারে স্কেভেটর দিয়ে নদীতে ফেলে দেওয়া হয়েছে। এসব দেখে মনে হচ্ছে এগুলো দেখার কেউ নেই।
“কক্সবাজার বাসীর দীর্ঘ প্রতিক্ষিত প্রকল্প বাঁকখালী ড্রেজিং। কিন্তু এ রকম জনগুরুত্বপূর্ণ একটি প্রকল্পের কাজ চলছে নানা অনিয়মের মধ্যে দিয়ে। নদীর বালু নদীতে রেখে এ রকম অভিনব ড্রেজিং কার্য়ক্রম কোথাও দেখিনি। যোগ করেন অামিন।
ভুতপাড়ার বাসিন্দা মো. আলী বলেন, আমরা প্রতিদিন দেখি বিকাল ৫টা পর্যন্ত ড্রেজিং-এর কাজ চালানো হয়। কিন্তু বৃহস্পতিবার (৩ জুন) রাত একটার দিকে বের হলে দেখে স্কেভেটর দিয়ে বালু নদীতে ফেলা হচ্ছে।
পরে বুঝতে পারলাম নদীতে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে বালুগুলো তুলতে না পেরে পানিতে বিলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বলেন মো. আলী।
কাউয়ারখোপ ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার স্থানীয় বাসিন্দা মো. বদরুল হুদা বাংলানিউজকে বলেন, বৃহস্পতিবার দিনের বেলায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের কে বা কারা ড্রেজিং কাজ পরিদর্শনে আসেন। পরিদর্শনের পর সন্ধ্যায় দেখি বালুগুলো পানিতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তাৎক্ষনিক বিষয়টি আমরা বুঝে ওঠতে পারিনি।
পরে মনে হয়েছে পানি বেড়ে যাওয়ার কারণে তাদের এ কৌশল।
বাঁকখালী ড্রেজিং এখানকার মানুষের বহু প্রতিক্ষিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন। এ প্রকল্পের অনিয়ম বন্ধে প্রশাসনের জরুরী হস্তক্ষেপ কামনা করছি।
সুশাসনের জন্য নাগরিক সুজন রামুর সভাপতি মাস্টার মো. আলম বলেন, আমরা সুজনের পক্ষ থেকে প্রকল্পের কাজ পরিদর্শন করেছি। নদীর বালু নদীতে রেখে অভিনব ড্রেজিং-এর কাজ দেখে আমরা উদ্বিগ্ন ছিলাম, আমরা বার বার আশংকা প্রকাশ করেছি এসব বালু নদীতে পানি বাড়লেই নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।
তাই রামু উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাত করে এ বিষয়ে জানিয়েয়েছি। কিন্তু মনে হয়েছে ইউএন মহোদয় আমাদের কথাগুলো এক পয়সারও পাত্তা দেননি। পরে আমরা জেলা প্রশাসক বরাবরও স্বারকলিপি দিয়েছি। কিন্তু কাজের কাজ কিছু হয়নি।
খালের বালু খালেই থাকছে। এমনকি হাইটুপী অংশে পাশে ৪০ মিটার ড্রেজিংয়ের কথা থাকলেও তা নিয়ম অনুযায়ী করা হচ্ছেনা বলে স্থানীয় লোকজন অঅমাদের জানিয়েছে। এখন আমরা সিদ্বান্ত নিয়েছি, এটা নিয়ে আমরা আন্দোলনে যাবো। যোগ করেন মাস্টার আলম।
এদিকে অভিযোগের বিষয়টি স্বীকার করে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ওয়েস্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিডেট-এর কাজ তদারকির দায়িত্বে থাকা মো. সরওয়ার আলম বলেন, ভুত পাড়া অংশে ড্রেজার মেশিন দিয়ে বালু তোলার কারণে বিশাল গর্তের সৃষ্ঠি হয়েছে। যে কারণে নদী তীরের সিসিব্লক ধ্বসে যাওয়ার আশংকা আছে সেজন্য কিছু বালু পানিতে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে রাতের আঁধারে বালু বিলিয়ে দেওয়ার বিষয়টি তিনি অস্বীকার করেন।
তবে পানি বাড়ায় নদীতে বালু বিলীন হয়ে যাওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে তিনি বলেন,এগুলো আমরা আবার তুলে ফেলবো। এবং ফাইনাল পোষ্ট ওয়ার্কের পর যতটুকু কাজ ততটুকুই তাদের বিল পরিশোধ করা হবে বলে ও তিনি জানান।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী প্রবীর কুমার গোস্বামীর মোবাইলে একাধিকবার ফোন দেওয়া হলেও সংযোগ ঘটেনি।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসক ড. মো. মামুনুর রশীদ বলেন,বিষয়টি সরাসরি পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখেন। আমি খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি।
প্রকল্পে যা যা আছে:
কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানাগেছে, বাঁকখালী নদী ড্রেজিং ও খনন করে নদীর নাব্যতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নৌ-চলাচলের পথ সুগম করা, দুর্যোগপূর্ণ মুহূর্তে সাগরের নৌকা/ট্রলার এর নিরাপদ অবস্থানের জন্য গুরুত্বপূর্ণ পোতাশ্রয় হিসাবে বাঁকখালী নদী ব্যবহার করা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ,পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নদী ভাঙ্গনের হাত থেকে ঘরবাড়ি,সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান রক্ষার জন্য ২০১৬ সালে প্রায় ১৯৫ কোটি ৫৪৩ লাখ ৯৫ হাজার টাকা ব্যয়ে এ প্রকল্প গ্রহন করে কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ড। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ওয়েষ্টান ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান।
প্রকল্পে নদী ২৮ কিলো মিটার ড্রেজিং ড্রেজিং ছাড়াও রয়েছে, ৪.৬৫০ কিলোমিটারনদীর তীর সংরক্ষণ, তিন কিলোমিটার বাঁধ নির্মান/পুনরাকৃতিকরণ, ২টি রেগুলেটর নির্মাণ ও ১২ কিলোমিটার খাল পুনঃখননের কাজ। ২০১৬ সালের জুনে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের মেয়াদ চলতি মাস জুনে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
জানাগেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অগ্রাধিকার প্রকল্প এটি। এই প্রকল্পের কাজ শেষ হলে দুই উপজেলার ২১টি ইউনিয়নের ১৯ হাজার ৪’শ হেক্টর জমি চাষাবাদের আওতায় আসবে। বন্যা থেকে রক্ষা পাবে রামু সদরের ৩ লাখ মানুষ। পাশাপাশি নদী ভাঙনের হাত থেকে রেহাই পাবে অন্তত ২ হাজার পরিবার।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।