সিবিএন ডেস্ক:
দুর্নীতি বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানিয়ে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য আলী আশরাফ বলেছেন, বড় বড় চোরদের দুর্নীতি, অর্থপাচারের মতো কার্যক্রমে ঘৃণায়, লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। এগুলোর বিষয়ে শক্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। বাজেট বাস্তবায়নে দক্ষতা না বাড়ালে, দুর্নীতি বন্ধ করা না গেলে বাজেটের লক্ষ্য অর্জন করা যাবে না।’

রবিবার (৬ জুন) সংসদে ২০২০-২১ অর্থবছরের সম্পূরক বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন।

আলী আশরাফ বলেন, ‘আমরা বাজেট তো দিচ্ছি। কিন্তু বাস্তবায়নের জন্য সদিচ্ছা থাকতে হবে। দুর্নীতি ও অর্থপাচার… কিছু কিছু লোক… জীবনের কোনও মায়া নিয়ে আমরা যুদ্ধ করিনি। কিছু পাবার, খাবার বা প্রত্যাশার জন্য যুদ্ধ করিনি। লড়াই করেছিলাম বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য। সেই দেশে আজকে ঘৃণা, লজ্জায় মাথা হেট হয়ে যায়। এত বড় বড় কিছু চোর, যাদের নাম ওঠে।’

বাজেট সরকারের নির্ধারিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে কর প্রশসানের দক্ষতা বাড়ানোর ওপর জোর দেন সরকারি এই সংসদ সদস্য।

তিনি বলেন, ‘কর প্রশাসনকে ঢেলে সাজাতে হবে। আমাদের মুহিত সাহেব যখন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, ২০১০ সালে তিনি বলেছিলেন— উপজেলা পর্যায়ে ২৫ লাখ লোক কর দেয়। এটা গৌরবের কথা। ট্যাক্সের নেট আরও বাড়াতে হবে। দক্ষতা বাড়াতে হবে। কর প্রশাসনের সামর্থ্য আছে। কর প্রশাসনের দক্ষতা, স্বচ্ছতা, সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা যদি আমরা না বাড়াতে পারি, তাহলে বাজেটের ইপ্সিত লক্ষ্যে আমরা পৌঁছাতে পারবো না।’

মহামারি মোকাবিলায় সরবকার ও প্রধানমন্ত্রীর পদক্ষেপের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘কোভিডের তৃতীয় ঢেউ যদি আসে, আমাদের প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সামনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছেন। কোভিড-১৯ এর প্রথম ধাপ, দ্বিতীয় ধাপ, এখন তৃতীয় ধাপ উঁকি দিচ্ছে। এর মধ্যে এই জাতীয় সংসদে বাজেট পেশ করা হয়েছে।’

আলী আশরাফ বলেন, ‘সব কর্মকাণ্ডে বিশ্বে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। কোভিড পরিস্থিতিতে যে বিপর্যয়ের কথা ছিল, তার (প্রধানমন্ত্রী) নেতৃত্বে আমরা মোকাবিলা করেছি। এটা চাট্টিখানি কথা নয়। এটা নিশ্চয়ই সফলতা। সারা পৃথিবী বাংলাদেশে গৃহীত পদক্ষেপের প্রশংসা করছে। তৃণমূলে প্রণোদনা পৌঁছেছে। মানুষ আজ উদ্বেলিত। সততা থাকলে এটা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে সেই সততা আছে।’

সরকারি দলের আরেক সদস্য মহিউদ্দীন খান আলমগীর বলেন, ‘কোভিডের কারণে আয় কমেছে। যে কারণে মূল বাজেটের চেয়ে সম্পূরক বাজেট কমে গেছে।’

তিনি মূল্যস্ফিতি ঠেকাতে মূদ্রা সরবরাহ বাড়ানো, সামাজিক নিরাপত্তা খাত আরও সম্প্রসারিত করা, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে আরও পদক্ষেপ নেওয়ার প্রস্তাব করেন।

তিনি বলেন, ‘সরকার স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ঋণ নিচ্ছে। দেশে ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা বেশ প্রসারিত হয়েছে। এই ব্যাংক ও আর্থিক ব্যবস্থা সংস্কারের জন্য আরও পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকরা।’

এজন্য একটি ব্যাংক কমিশন গঠনের দাবি জানান তিনি। একইভাবে কর কমিশন করাও পরামর্শ দেন এই সংসদ সদস্য।

সরকার দলের আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাজেটের সমালোচনাকারীদের জবাবে বলেন, ‘এই অর্থবছরে সিপিডি-বিএনপির নেতৃবৃন্দের প্রতিক্রিয়ার কারণ অন্য। মেগা প্রজেক্টগুলো শেষ হয়ে এসেছে। তা দেখে তারা আবোল-তাবোল বকছে।’

বিএনপি’র সংরক্ষিত আসনের এমপি রুমিন ফারহানা প্রথম আলোর সিনিয়র প্রতিবেদক রোজিনা ইসলামের মামলা প্রত্যাহারের দাবি করেন। রুমিন ফারহানা বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে খাতে স্বাস্থ্য খাতের ভয়ঙ্কর দুর্নীতির খবর এসেছে। হেলথ টেকনিশিয়ান নিয়োগে মাথাপিছু ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম যখন- ‘এখন এক কোটি নিন, পরে এক কোটি পাবেন, ৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকেটা নিয়ে অনিয়ম, টিকা নিয়ে দুই ধরনের তথ্য, রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তিটি গোপনীয়তার’, ইত্যাদি শিরোনামের নানা রিপোর্ট, স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম দুর্নীতি তুলে ধরেছেন, তখন তাকে চরমভাবে হেনস্থার শিকার হতে হয়েছে।’’

তিনি বলেন, ‘আমি মানুষের চিন্তা বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং উন্মুক্ত গণমাধ্যমের স্বার্থে প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক রোজিনা ইসলামেরন মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানাচ্ছি।’

রুমিন বলেন, ‘রোজিনাকে ৬ ঘণ্টা ধরে যে হেনস্থা করা হলো। যারা এর জন্য দায়ী তাদের ব্যাপারে সরকার কী ব্যবস্থা নিয়েছে, সেটাও আমি আপনার (স্পিকার) মাধ্যমে জানতে চাই।’

বিএনপির এই সংসদ সদস্য বলেন, ‘গণমাধ্যমকে রিপোর্ট প্রকাশের জন্য যদি হেনস্থার শিকার হতে হয়. জীবন হুমকির মুখে পড়তে হয়, তখন আর কোনও গণমাধ্যমই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না। বিশ্ব গণমাধ্যম সূচকে ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৫২তম। এমনকি মিয়ানমার এবং আফগানিস্তানের অবস্থা বাংলাদেশের চাইতেও ভালো।’

এর আগে রুমিন ফারহানা বলেন, ‘স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের বরাদ্দ বাড়লেও বিগত ১০ বছরের মধ্যে স্বাস্থ্য খাতের এডিপি বাস্তবায়ন এ বছরই সবচেয়ে কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে বাজেটের মাত্র ২৫ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ। অথচ করোনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ তারা বরাদ্দকৃত অর্থ খরচে অদক্ষতা দেখিয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘স্বাস্থ্য খাতে তবুও বরাদ্দ বাড়ানোর অর্থ যে কী সেটা দেশের মানুষ খুব ভালো জানে। আমরা দেখেছি, অকল্পনীয় দামে বালিশ, পর্দা, কাঁটাচামচ কিনতে। এখন দেখা যাচ্ছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে ২৫০ টাকার বিশেষ সুঁই ২৫০০ টাকায় টাকায় কেনা হচ্ছে।’

গত বছরও করোনার মধ্যে বাজেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে আমরা ন্যূনতম বরাদ্দ দেখতে পাইনি। জিডিপির অনুপাতে মাত্র ৯ শতাংশ বরাদ্দ ছিল। যেটা নিয়ে স্বয়ং স্বাস্থ্যমন্ত্রীও হতাশা প্রকাশ করেছেন। আজকে আমাদেরকে এমন অবহেলার মাশুল দিতে হচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, জাতীয় বাজেটে স্বাস্থ্য খাতে মোট ১৫ শতাংশ এবং জিডিপির কমপক্ষে ৫ শতাংশ হওয়া উচিত। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে স্বাস্থ্য খাতে সবচেয়ে কম বরাদ্দ বাংলাদেশে।’

তিনি আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বারবার নির্দেশনা দেওয়ার পরেও দেশের ৪২টি জেলায় এখনও সরকারি পর্যায়ে কোনও আইসিইউ নেই কেন? চিকিৎসা সেবা এখন ব্যবসায় পরিণত হয়েছে। ব্যক্তি খাতের ব্যয় কমার বদলে ৬৭% থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭২%। এর ফলে স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে গিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৬৬ লাখ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে চলে যায়।’

রুমিন বলেন, ‘এই মহামারির শুরু থেকেই টিকা ব্যবস্থা নিয়ে আমরা নয়-ছয় দেখেছি। সেরাম ইনস্টিটিউটের ৬ মাসে তিন কোটি ডোজ দেওয়ার কথা থাকলেও এবং সেই বাবদ মূল্য পরিশোধ করার পরেও টিকা আসে মাত্র ৭০ লাখ পিস। আর বেক্সিমকো এরমধ্যেই লাভ করে নিয়েছে ৩৮ কোটি টাকা। নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষায় চাপের কারণেই সরকার বিকল্প পথে যেতে পারেনি। এটা কে বলেছেন? বলেছেন আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং তিনি যখন একথা বলেন, সেটা নিয়ে আর সন্দেহের কোনও অবকাশ থাকে না। টিকা বিক্রি করে এক ক্ষমতাশালী ব্যক্তির লাভের কারণে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জীবনকে হুমকির মুখে ফেলা হয়েছে।’