মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম

‘জীবন-জীবিকায় প্রাধান্য দিয়ে সুদৃঢ় আগামীর পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে ৬ লাখ ৩ হাজার ৬৮১ কোটি টাকা ব্যাপ্তির ঘাটতি বাজেট ঘোষিত হয়েছে। আমাদের মত দেশের জন্য উদ্ধৃত বা সুষম বাজেট বাস্তবিক নয়, তবে এবারে ঘাটতি বাড়ার প্রাসংগিক কারণও রয়েছে। করোণা মহামারিতে অনেক শিল্প,বানিজ্য স্থবির হয়ে গেছে, মানুষের উপার্জন কমেছে। তিনটি লক্ষ্য ২০৩০ (টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট), ২০৩১ (উচ্চমধ্যম আয়ের দেশ), ২০৪১ (উন্নত দেশ) ও ২১০০ (ব-দ্বীপ পরিকল্পনার বাস্তবায়ন) নিয়ে বাজেট প্রস্তাব করা হয়েছে।

জাতীয় সংসদে অর্থমন্ত্রী কতৃক উপস্থাপিত ৩০১ অনুচ্ছেদের বাজেট বক্তৃতায় ‘কক্সবাজার’ শব্দটি চারবার এসেছে। তবে পরোক্ষভাবে বিভিন্ন অনুচ্ছেদে কক্সবাজার ও সমুদ্র্যের কথা এসেছে অনেকবার।

৬১ নং অনুচ্ছেদে টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের মাধ্যমে উচ্চ প্রবৃদ্ধি অর্জনের কথা বলতে গিয়ে মেগা প্রকল্পসমূহের মধ্যে দোহাজারি থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ ও কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে বিদ্যুৎ প্রকল্প স্থাপনের প্রসঙ্গ এসেছে।

১৬০ নং [জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ] অনুচ্ছেদে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সাথে সামঞ্জস্য রেখে জ্বালানির ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণ এবং টেকসই ও নিরাপদ জ্বালানির ব্যবহার ও সরবরাহ বৃদ্ধিকল্পে সরকারের উদ্যোগ হিসেবে কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুট করে মোট ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতার দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল স্থাপন করার কথা বাজেট বক্তৃতায় এসেছে। তাছাড়া এলএনজি বৃদ্ধির লক্ষ্যে কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে দৈনিক ১০০০ মিলিয়ন ঘনফুট ক্ষমতার ল্যান্ড-বেইজড এলএনজি টার্মিনাল স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

১৬৪ নং [সড়ক পরিবহন] অনুচ্ছেদে “চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক চার লেনে উন্নীত করার কাজ এগিয়ে চলছে উল্লেখ করা হয়েছে বাজেট বক্তৃতায়।

তাছাড়া ১৬৯ নং অনুচ্ছেদে রেলওয়ের সংশোধিত মহাপরিকল্পনায় (২০১৬-২০৪৫) তে ঢাকার সাথে কক্সবাজারের সংযোগ স্থাপনের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

কক্সবাজারের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠা ক্রমবনতিশীল লবণ শিল্পের ব্যাপারে বাজেট বক্তৃতায় নির্দেশনা এসেছে। বক্তৃতায় বলা হয়েছে, লবণ চাষীদের প্রতিরক্ষণ, আমদানিকৃত শিল্প লবণের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং জনস্বাস্থ্য ঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে শিল্প মন্ত্রনালয় এর সুপারিশের প্রেক্ষিতে শিল্প লবণ (সোডিয়াম সালফেট / ডাইসোডিয়াম সালফেটের) আমদানিতে বিদ্যমান শুল্কহার বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে। বাজেট বক্তৃতায় অবশ্য স্বীকার করা হয়েছে, খাবার লবণের সাথে শিল্প লবনের দামের তারতম্য অনেক বেশি হওয়ায় অপঘোষণার মাধ্যমে খাবার লবণ আমদানির প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তাছাড়া, খাবার লবনের সাথে শিল্প লবণ মিশিয়ে বাজারজাত করার অভিযোগ ও চিহ্নিত করা হয়েছে বাজেটে। প্রান্তিক চাষী ও লবন মিল ক্ষতি হচ্ছে ও স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু শুধুমাত্র শিল্প-লবণ আমদানিতে শুল্কহার বাড়িয়ে প্রান্তিক চাষীদের কতটুকুই বা উপকার হবে !

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসামরিক বিমান ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের জন্য চার হাজার ৩২ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে। এ বরাদ্দ প্রস্তাব গত অর্থবছরে প্রস্তাবিত বরাদ্দ তিন হাজার ৬৮৮ কোটি টাকার চেয়ে ৩৪৪ কোটি টাকা বেশি। এবারের প্রস্তাবিত বাজেটে বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন খাতের জন্য আলাদা করে কোনো প্রণোদনা বরাদ্দ রাখা হয়নি। অথচ করোনাকালীন মোটা অংকের আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হওয়া এ খাত সংশ্লিষ্টরা দীর্ঘদিন ধরে প্রণোদনার দাবি করে আসছিলেন।

২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশ সংরক্ষণ খাতে ১ হাজার ২২১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ১ হাজার ৩৬ কোটি টাকা। জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ সমুদ্র তীরবর্তী ছোট দ্বীপ অভিযোজনসূলক কার্যক্রম গ্রহণের লক্ষ্যে আরো একটি প্রকল্প অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে থেকে প্রতি বছরই বাজেট পেশের সময় ‘টেকসই উন্নয়নে জলবায়ু অর্থায়ন’ শীর্ষক প্রতিবেদন জাতীয় সংসদের উপস্থাপন করা হচ্ছে। এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে সংসসদ সদস্যসহ দেশের জনসাধারণ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় সরকারের অঙ্গীকার এবং সম্পদ সঞ্চালনের বিষয়ে জানতে পারছেণ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পরিচালন ব্যয় ধরা হয়েছে ৫ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা। আর উন্নয়ন ব্যয় ধরা হয়েছে ৪ হাজার ৬৩১ কোটি টাকা। অর্থাৎ, মোট ৯ হাজার ৯৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, যা ২০২০-২০২১ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটের চেয়ে ৬৩৭ কোটি টাকা বেশি। তবে এই বরাদ্দতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ নিয়ে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবনা আনা হয়নি।

এবারের বাজেটে আলোচনায় এসেছে সুনীল অর্থনীতি বা সমুদ্র অর্থনীতি। বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশকে অপার সম্ভাবনাময় সুনীল অর্থনীতি হাতছানি দিচ্ছে। বঙ্গোপসাগরের ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে অবস্থিত এ বিশাল সমুদ্র সম্পদের সদ্ব্যবহার করা গেলে তা আমাদের অর্থনীতিতে বড় ধরনের অবদান রাখবে। বাজেটে অন্তত সুনীল অর্থনীতির বিষয়টি উঠে এসেছে; যদিও সুনির্দিষ্টভাবে কিছুই উঠে আসেনি। সমুদ্র অর্থনীতি নিয়ে আমাদের গবেষণা যে এখনো প্রারম্ভিক পর্যায়ে, তাই বোধগম্য হচ্ছে।

সার্বিকভাবে কক্সবাজারের উন্নয়ন নিয়ে মেগা প্রকল্পের কথা গুলো গুরুত্ব পেলেও সমুদ্র নিরাপত্তা, সমুদ্রের দূষণ দূরীকরণ, মাদক নিরুপন ও শরনার্থী সমস্যা সমাধানের বাস্তবিক কোন রুপকল্প অংকিত হয়নি। আলোচনায় আসলেও লবণ শিল্প ও জেলেদের পেশাগত উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রত্যাশিত রূপ পায়নি। কক্সবাজারে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় করার দাবি দীর্ঘদিনের- শিক্ষা অংশে এর প্রতিফলতা আসেনি।

কক্সবাজারের সমৃদ্ধতা এসব সমস্যার উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল। প্রস্তাবিত বাজেটের বাস্তবায়ন সরকার ও জনপ্রতিনিধিরা কতটা সুষ্ঠুভাবে বাস্তবায়ন করে, তার উত্তর সময়-ই বলে দিবে।

 

মোহিব্বুল মোক্তাদীর তানিম, তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। mmtanim@gmail.com