মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আলী শিকদার (অব.)

রোহিঙ্গা সংকটটি বাংলাদেশের জন্য গলার কাঁটার মতো হয়ে আছে। মিয়ানমারের একান্ত অভ্যন্তরীণ ইস্যু; যদিও এখন এটি আন্তর্জাতিক ইস্যু, এর সঙ্গে শুধু প্রতিবেশী হওয়ার জন্য ১৯৭৮ সাল থেকে বাংলাদেশ জড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু ২০১৭ সালের আগ পর্যন্ত প্রায় ৩৯ বছর পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় থাকা সরকারগুলো রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে যথার্থ গুরুত্বসহকারে মাথা ঘামিয়েছে, এমন কোনো নজির নেই। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের যথার্থ উপস্থিতি না থাকায় সুযোগ নিয়েছে বহু রকম স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠী। তার মধ্যে দেশি-বিদেশি ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীও আছে। সুতরাং চরম অদূরদর্শিতার পরিণাম যা হওয়ার সেটাই হয়েছে। মিয়ানমারের প্রায় ১১ লাখ নাগরিক বাংলাদেশের ওপর জেঁকে বসেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ পশ্চিমা বিশ্বের মানবদরদি শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর পক্ষ থেকে বড় বড় কথা বলা হচ্ছে সেই ২০১৭ সাল থেকে। কিন্তু কার্যকর কিছুই হচ্ছে না। সবই ফাঁকা বুলি।

বাংলাদেশের একমাত্র চাওয়া ১১ লাখ সর্বহারা অসহায় মানুষ তাদের নিজ জন্মভূমি মিয়ানমারে ফিরে যাক। কিন্তু গত প্রায় চার বছরে সে পথে কোনো অগ্রগতি নেই। বরং কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা, এনজিও ও ধর্মীয় উগ্রপন্থী গোষ্ঠীর চক্রান্তে অবৈধভাবে বসবাসকারী এই ১১ লাখ রোহিঙ্গার ওপর বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ পরিপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারছে না। বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচরে এক লাখ রোহিঙ্গার জন্য আধুনিক আবাসনকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক চক্রান্ত ও অপপ্রচারের কারণে গত এক বছরে এক লাখ রোহিঙ্গাকে কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে স্থানান্তর করা সম্ভব হয়নি। অনেক চেষ্টার পর মাত্র কয়েক হাজার রোহিঙ্গাকে সেখানে নেওয়া সম্ভব হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বর্তমান চেয়ারম্যান তুরস্কের নাগরিক ভলকান বোজকির সম্প্রতি ভাসানচর পরিদর্শন করেছেন এবং বলেছেন, ভাসানচরের মতো এত সুন্দর ও সুরক্ষিত আবাসিক ব্যবস্থা বিশ্বের অন্য কোনো এলাকায় শরণার্থীদের জন্য করা হয়নি। অথচ কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা এবং বিদেশি অর্থে এনজিও পরিচালনা করছেন এমন কিছু বাংলাদেশি নাগরিকও ভাসানচরে স্থানান্তরের চরম বিরোধিতা করছেন। ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতাকে সহজ সরল চোখে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বের পরাশক্তিগুলো এবং তাদের অর্থে চালিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো কোথায় কী খেলা খেলতে চায় এবং কোন ইস্যুকে কখন দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহার করতে চায় সেটা সব সময় বোঝা কঠিন। ভূ-রাজনৈতিক হিসেবে মানবতা-দাক্ষিণ্য একেবারে গৌণ বিষয়। একদিকে সমস্যা সমাধানের পথ তো খুলছেই না, অন্যদিকে কক্সবাজারে ১১ লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের কারণে যে ধরনের সামাজিক, রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাজনিত সংকট সৃষ্টি হচ্ছে তার প্রসার-বিস্তারও ঠেকিয়ে রাখা যাচ্ছে না। তাহলে সব কিছু মিলে রোহিঙ্গা সমস্যা কোন দিকে ধাবিত হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে এর কোনো সুরাহা কি হচ্ছে; যদি তা না হয় তাহলে সেটি বাংলাদেশের জন্য আরো কত বড় সংকট সৃষ্টি করতে পারে তা যেমন ভাবনার বিষয়, তেমনি করণীয় সম্পর্কেও চিন্তা করা প্রয়োজন।

প্রথমে বলতে হয় রোহিঙ্গারা অদূর ভবিষ্যতে মিয়ানমারে ফেরত যাবে তার কোনো লক্ষণ আপাতত দেখা যাচ্ছে না। এ বছরের ১ ফেব্রুয়ারি অং সান সু চিকে হটিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনী পুনরায় সরাসরি ক্ষমতার সম্মুখে আসায় অনেকে মনে করেন, পুতুল সরে গিয়ে প্রকৃত মাস্টার সামনে আসায় সংকট সমাধানের একটা পথ হয়তো বের হবে। কারণ পুতুল নিয়ে মাস্টাররা খেলা করতে ভালোবাসেন, আয়-রোজগার করেন। কিন্তু এমন কোনো ক্ষমতা পুতুলকে দেবেন না, যাতে মাস্টারের চেয়ে পুতুল বেশি জনপ্রিয় হয়ে যায়। পুতুল জনপ্রিয় হয়ে উঠলে মাস্টারের জন্য তা বিপজ্জনক হয়। তবে ক্ষমতা গ্রহণের চার মাস অতিবাহিত হলেও রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সেনাবাহিনীর কোনো সুনির্দিষ্ট বক্তব্য পাওয়া যায়নি। ১৯৬২ সাল থেকে বিগত সময়ে সামরিক শাসকরা মিয়ানমারের ভেতর থেকে যে রকম বাধা-প্রতিবাদের সম্মুখীন হয়েছেন তার থেকে এবারের প্রতিরোধ-বিক্ষোভের বৈশিষ্ট্য অনেকখানি ভিন্ন। অং সান সু চির দলের সমর্থকরা তো রয়েছেই, তার সঙ্গে এবার সরকারের সব সেক্টর থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একটা অংশ বিক্ষোভ প্রতিবাদে যোগ দিয়েছে। তারপর বার্মিজের বাইরে জাতিগোষ্ঠীর মধ্য থেকে কারেন, কাচিন, ওয়াহ, শানসহ ডজনখানেক যেসব সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপ রয়েছে তারা এবার ঐক্যবদ্ধভাবে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে। সুতরাং যত তাড়াতাড়ি সব কিছু নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসবে বলে সেনাবাহিনী প্রথমে ভেবেছিল তা হয়নি। তাই সেনাবাহিনী নিজেদের গদি সুরক্ষিত না করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন কোনো উদ্যোগ নেবে না। এটাই সংগত। তবে বিগত সময়ে সেনাবাহিনীর যে অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি দেখা গেছে তাতে নতুন করে কিছু আশা করাও কঠিন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘসহ পশ্চিমা বিশ্বের চাপ থাকলেও সেটি মিয়ানমার সহজেই উপেক্ষা করতে পারছে। কারণ নতুন পরাশক্তি এবং একই সময়ে দুয়ারের পড়শি চীন শক্ত দেয়ালের মতো পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সঙ্গে রাশিয়া রয়েছে। তারপর প্রতিবেশী ও গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোট আসিয়ান দেশগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে জোরালো স্ট্যান্ড কখনো নেয়নি। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও আসিয়ান জোটের তেমন কোনো উচ্চবাচ্য নেই; যদিও দু-একটি দেশ মৃদুস্বরে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার আহ্বান জানিয়েছে। গত এপ্রিল মাসে আসিয়ান দেশগুলোর শীর্ষ সম্মেলনে মিয়ানমারের সেনাপ্রধান জেনারেল অং মিন হ্লাইং উপস্থিত হয়ে বক্তব্য দিয়েছেন। তাতে আসিয়ান দেশগুলোর একপ্রকার স্বীকৃতি বর্তমান মিয়ানমার সামরিক সরকার পেয়ে গেছে। আমার বিশ্লেষণ, চলমান অভ্যন্তরীণ আন্দোলন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ সেনাবাহিনী অচিরেই নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসবে। কারণ মিয়ানমার সেনাবাহিনীর জন্য সশস্ত্র বিদ্রোহী গ্রুপগুলো হচ্ছে সবচেয়ে ভয়ের জায়গা। সেখানে সীমান্তবর্তী প্রতিবেশী চীন, ভারত, থাইল্যান্ড ও লাওস থেকে সশস্ত্র গ্রুপগুলো বড় ধরনের কোনো সমর্থন এই সময়ে পাবে না বিধায় এ বিষয়ে সেনা সরকার অনেকটাই নিশ্চিন্ত।

রোহিঙ্গা ইস্যুর একটা স্থায়ী শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে মিয়ানমার সেনাবাহিনী কেন যাচ্ছে না, সেটি আমার কাছে রহস্যজনক মনে হয়। রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব সম্পর্কে বাহ্যিকভাবে মিয়ানমার যা বলছে তার যে কোনো যুক্তি ও ভিত্তি নেই সেটা মিয়ানমারসহ সব আন্তর্জাতিক পক্ষ জানে। রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে ২০১৭ সালের ২৩ নভেম্বর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটা ১৯ দফা সমঝোতা দলিল স্বাক্ষরিত হয়। দলিলের ১৮ নম্বর দফায় বলা হয়, কফি আনান কমিশনের সুপারিশ অনুসারে রোহিঙ্গা সমস্যার পূর্ণাঙ্গ সমাধান করা হবে। ১৪ নম্বর দফায় ছিল এই প্রত্যাবর্তন প্রক্রিয়ায় জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকেও সংযুক্ত করা হবে। এই সমঝোতা দলিল স্বাক্ষরের পেছনে চীনের পরোক্ষ ভূমিকা ছিল, তা ওই সময়ই দেখা গেছে। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের সেই চরম অমানবিক ঘটনার মাত্র ৯১ দিনের মাথায় এমন একটা দলিল স্বাক্ষর ছিল রীতিমতো চমক। কিন্তু তারপর কী হলো—এর কিছুই আর বাস্তবায়িত হলো না। এ বিষয়ে এখন কোনো উচ্চবাচ্যও নেই। মাঝপথে ২০১৮-২০ তিন বছরে প্রত্যাবাসনের বেশ কয়েকটি উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। এই উদ্যোগগুলো ব্যর্থ হওয়ার পেছনে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে গড়ে ওঠা অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর বাধা এবং কিছু আন্তর্জাতিক পক্ষের কারসাজি কাজ করেছে বলে তখন জানা যায়। পত্রিকায় তখন খবর এসেছে, ক্যাম্পের ভেতরে গড়ে ওঠা অস্ত্রধারী রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ফেরত যাওয়ার জন্য নির্ধারিত পরিবারগুলোকে রাতের বেলায় অস্ত্রের মুখে ভয় দেখায়—ফেরত যেতে রাজি হলে গুলি করে মেরে ফেলা হবে। একই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী একই রকম ভয় দেখায়, যাতে ভাসানচরে যাওয়ার জন্য কেউ রাজি না হয়। রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে গড়ে ওঠা এই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সাধারণ নিরীহ রোহিঙ্গাদের জিম্মি করে মাদক ব্যবসা, অস্ত্র চোরাচালান ও নারী পাচারের মতো বিশাল অর্থকরী দুর্বৃত্তায়নে লিপ্ত আছে।

সুতরাং এটা এখন স্পষ্ট, সাধারণ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন ও পুনর্বাসনের চেয়ে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তায়নের স্বার্থ এবং আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক শক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের টানাপড়েনে সাধারণ রোহিঙ্গারা দেশে ফিরতে পারছে না। আর তার পরিণতিতে বাংলাদেশ এক মহাঘূর্ণায়নের মধ্যে পড়েছে। দিন যত যাবে সব কিছু ততই কঠিন হবে। তাই কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর ওপর প্রশাসনিক ও নিরাপত্তাজনিত বিষয়ে বাংলাদেশের একচ্ছত্র কর্তৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা অতি প্রয়োজন। আরো ১০ বছর অথবা তারও অধিক সময় যদি রোহিঙ্গারা এখন যেভাবে আছে সেভাবে থাকে, তাহলে অতিরিক্ত আরো অনেক নতুন সংকট সৃষ্টি হবে। কক্সবাজারে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তখন এদের আবাসনব্যবস্থা কোথায় কিভাবে হবে? ১০ বছর পর রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে কয়েক লাখের একটা যুবসমাজ তৈরি হবে। এরা হবে চরম সংক্ষুব্ধ যুব শ্রেণি। এদের নিয়ন্ত্রণ কিভাবে করা হবে। কক্সবাজার জেলায় স্থানীয় বাঙালি জনসংখ্যার চেয়ে রোহিঙ্গা জনসংখ্যা এখনই প্রায় দ্বিগুণ, আর সামনের দিন তো পড়ে আছে। আরো ঘটনা ঘটবে। রোহিঙ্গা আর বাঙালি ছেলে-মেয়েদের মধ্যে বিয়েশাদি আগেও হয়েছে, এখনো হচ্ছে এবং আগামী দিনেও তা অব্যাহত থাকবে। বাঙালি-রোহিঙ্গা সংমিশ্রণে যে জনগোষ্ঠী তৈরি হবে, সেটি বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল, নাকি অমঙ্গল হবে তা এখনই ভাবা দরকার। সুতরাং রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সর্বাত্মক চেষ্টা অব্যাহত রাখার সঙ্গে আগামী দিনে নতুন নতুন কী সংকট সৃষ্টি করতে পারে তা নিয়ে এখনই কাজ করা দরকার। সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান। গলায় কাঁটা বিঁধেছে, সেটি ক্যান্সারে রূপ নেওয়ার আগেই ছাড়ানোর ব্যবস্থা করা জরুরি। কাঁটা বের করার জন্য উপযুক্ত বৈদ্য হয়তো আছে। কিন্তু বৈদ্যদের ঝাঁপির মধ্যে সব সময় বড় বড় সাপ থাকে, সেটাই মূল সমস্যা।

লেখক : রাজনৈতিক নিরাপত্তা বিশ্লেষক

কালেরকন্ঠ থেকে সংগৃহীত