ইউএনএইচসিআর-এর সহকারী হাই কমিশনারদ্বয়ের চার দিনব্যাপী সফর সম্পন্ন

ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি টিমের সফর, রেখে গেলেন কি বার্তা?

প্রকাশ: ৩ জুন, ২০২১ ০৪:৪৪ , আপডেট: ৩ জুন, ২০২১ ০৪:৪৮

পড়া যাবে: [rt_reading_time] মিনিটে


ইমাম খাইর, সিবিএন:
বাংলাদেশে চার দিনের সফর শেষ হলো ইউএনএইচসিআর-এর সুরক্ষা বিষয়ক সহকারী হাই কমিশনার জিলিয়ান ট্রিগস ও কার্যক্রম বিষয়ক সহকারী হাই কমিশনার রাউফ মাজুর।

গত ৩০ মে থেকে ২ জুন পর্যন্ত তারা বাংলাদেশে যৌথ সফর করেন। এর অংশ হিসেবে তাঁরা কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির, ভাসানচর পরিদর্শন করেন। এছাড়া সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

এ সময় তারা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ও বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা ও সংহতির আহ্বান জানিয়েছেন। শরণার্থীদের সুরক্ষা, মঙ্গল ও এর পাশাপাশি এই সংকট সমাধানের নতুন প্রচেষ্টা পুরো কার্যক্রমের পুরোভাগে থাকা উচিত বলেও জানান ইউএনএইচসিআরের শীর্ষ এই দুই কর্তা।

গত কয়েক দশক ধরে মিয়ানমারের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক ও উদারভাবে সুরক্ষা প্রদানের জন্য পুরো সফরজুড়ে সহকারী হাই কমিশনাররা বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পুনরায় আন্তরিক প্রশংসা করেন। এই শরণার্থীদের উল্লেখযোগ্য অংশ হচ্ছেন ৭৪০,০০০-এরও বেশি রোহিঙ্গারা, যাঁরা ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের পর এসেছেন। হাই কমিশনারদ্বয় এই সংকটের পূর্ণাংগ সমাধানের জন্য কাজ করার প্রয়োজনীয়তা পুনঃব্যক্ত করেন, যার অংশ হচ্ছে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মিয়ানমারে স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে ও টেকসই ভিত্তিতে প্রত্যাবাসন।

সহকারী হাই কমিশনাররা বাংলাদেশের বর্তমান রোহিঙ্গা শরণার্থী পরিস্থিতির জন্য মিয়ানমারের দায়বদ্ধতার কথা তুলে ধরেন, আর আবারও জানিয়ে দেন মিয়ানমারেই রয়েছে এই সংকটের সমাধান। তবে মিয়ানমারের সাম্প্রতিক ঘটনা নিকট ভবিষ্যতে স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের সম্ভাবনাকে আরও চ্যালেঞ্জিং করে তুলেছে।

জিলিয়ান ট্রিগস বলেন, “গ্লোবাল কম্প্যাক্ট অন রিফিউজিস (শরণার্থীদের জন্য বৈশ্বিক ঐক্য)-এর সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ দেখিয়েছে মানবিকতা ও সংহতি। এখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিজ নিজ দায়িত্ব পূরণে কার্যকর কিছু করতে, শরণার্থীদের সুরক্ষা দিতে ও বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করতে এগিয়ে আসতে হবে”।

সহকারী হাই কমিশনারদ্বয় কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এবং শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসকের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

চলমান মহামারীতে সৃষ্ট চ্যালঞ্জের পরেও তাঁরা কোভিড-১৯ মোকাবেলায় শরণার্থী শিবিরের বাইরে ও ভেতরে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগণের জন্য নেয়া বিভিন্ন অসাধারণ পদক্ষেপ লক্ষ্য করেন। সহকারী হাই কমিশনারগণ উখিয়ায় রোহিঙ্গা ক্যাম্পের বাইরে একটি বিশেষায়িত কোভিড-১৯ চিকিৎসা কেন্দ্র পরিদর্শন করেন। এই বিশেষায়িত চিকিৎসা কেন্দ্রটি গত বছর মাত্র ৮ সপ্তাহে নির্মাণ করা হয়। গত এক বছরে শুধুমাত্র এই কেন্দ্রে প্রায় ১,০০০ রোগীর চিকিৎসা করা হয়, যাঁদের প্রায় ৭০% ছিলেন স্থানীয় বাংলাদেশী।

রাউফ মাজু বলেন, “স্বাস্থ্যখাতে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করার মাধ্যমে অনেক জীবন বাঁচানো গিয়েছে। কোভিড-১৯ মোকাবেলার জাতীয় পরিকল্পনায় ও জাতীয় টিকাদান কর্মসূচীতে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকার একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

কক্সবাজারের ১২টি বিশেষায়িত কোভিড-১৯ চিকিৎসা কেন্দ্রের মধ্যে ২টি তৈরি করেছে ইউএনএইচসিআর, এর সাথে কক্সবাজার সদর হাসপাতালের প্রথম আইসিইউ (নিবিড় পরিচর্যা ইউনিট)-ও স্থাপন করেছে সংস্থাটি। শরণার্থী ও স্থানীয় সবাইকে সমান ভাবে স্বাস্থ্যসেবা দেয়ার কারণে সবাইকে নিরাপদ রাখা যাচ্ছে”।

কোভিড-১৯ ও এর কারণে শরণার্থী ক্যাম্পে বিধি-নিষেধের ফলশ্রুতিতে আরও কিছু চ্যালেঞ্জ তৈরি হয়েছে। সহকারী হাই কমিশনারেরা ক্যাম্পে সীমিত মানবিক কার্যক্রম ও এর কারণে শরণার্থীদের সুরক্ষা বিষয়ক ঝুঁকি লক্ষ্য করেন। যৌন নিপীড়ন, বাল্য বিবাহ ও শিশুশ্রমের ঝুঁকিতে থাকা নারী ও শিশুদের পাশাপাশি বিভিন্ন ঝুঁকিতে থাকা শরণার্থীদের অপরিহার্য সুরক্ষা সেবার জন্য ইউএনএইচসিআর আহ্বান জানায়।

ইউএনএইচসিআর সব সময় সবার পাশাপাশি শরণার্থীদের ভাষ্য শুনে। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শনের সময় সহকারী হাই কমিশনারদ্বয় শরণার্থীদের সাথে কথা বলে তাঁদের পরিস্থিতি ও প্রয়োজনের কথা তাঁদের কাছ থেকে ভালোভাবে জানতে পারেন। রোহিঙ্গাদের অনেকেই শিক্ষা ও দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ পুনরায় চালু করার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন।

সহকারী হাই কমিশনারদের জন্য ভাসান চরে একটি সফরের আয়োজন করে সরকার। সেখানে গিয়ে তাঁরা আবাসন, সুযোগ-সুবিধা ও অবকাঠামো তৈরিতে বাংলাদেশ সরকারের তাৎপর্যপূর্ণ উদ্যোগের ব্যাপারে স্পষ্টভাবে অবহিত হন। তবে চরে অবস্থানরত প্রায় ১৮,০০০ রোহিঙ্গা শরণার্থীর সুরক্ষা ও সহায়তার প্রয়োজন সুস্পষ্টভাবে প্রতীয়মান, আর সেগুলো হচ্ছে অর্থবহ জীবিকা নির্বাহের সুযোগ, দক্ষতা বৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নিত্যপ্রয়োজনে নগদ অর্থের প্রয়োজন।

ইউএনএইচসিআর মনে করে ভাসান চর বাংলাদেশে অবস্থানরত কিছু রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিকল্প অস্থায়ী অবস্থান হিসাবে কাজ করতে পারে। শরণার্থীদের সুরক্ষা ও চরে জাতিসংঘের ভবিষ্যৎ সম্পৃক্ততার বিষয়ে অধিকতর আলোচনার জন্য ইউএনএইচসিআর বাংলাদেশ সরকারকে প্রস্তাব দিয়েছে। একই সাথে, ভাসান চর ত্যাগে আগ্রহী শরণার্থীদের আটক ও গ্রেফতারের বিভিন্ন খবরে ইউএনএইচসিআর উদ্বিগ্ন। শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শরণার্থীদের ভাসান চরে স্থানান্তরকে ইউএনএইচসিআর দৃঢ়ভাবে নিরুৎসাহিত করে।

জিলিয়ান ট্রিগস বলেন, “ভাসান চর সম্ভাবনাময়। তবে সেখানে অবস্থানরত শরণার্থীদের মানবিক ও সুরক্ষা বিষয়ক ব্যাপারগুলো পুরোপুরি বিবেচনায় রাখতে হবে। শরণার্থীদের ভাসান চরে স্থানান্তরে স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। তাঁদের চরের ভেতরে চলাফেরার স্বাধীনতা থাকতে হবে, এর পাশাপাশি কক্সবাজারের ক্যাম্পে তাঁদের ফেরার ও পরিবারের সাথে সম্পর্ক রাখার সুযোগ থাকতে হবে”।

ভাসান চরে ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের একটি বড় গ্রুপের সাথে কথা বলতে পেরেছে, যাঁদের বেশিরভাগই ছিলেন তরুণ পুরুষ। শরণার্থীরা চরে জীবিকা নির্বাহ, আত্মনির্ভরশীলতা, দক্ষতা বৃদ্ধি ও শিক্ষার অভাবের ব্যাপারে তাঁদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। পরিদর্শনের দিন শরণার্থীদের আহত হওয়ার খবরে ইউএনএইচসিআর গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন।

বেশিরভাগ রোহিঙ্গারাই চায় অনুকূল পরিস্থিতিতে একদিন স্বেচ্ছায়, নিরাপদে, মর্যাদার সাথে ও টেকসইভাবে মিয়ানমারে ফিরে যেতে। তবে এটাও মনে রাখতে হবে এই সংকটের এখন চতুর্থ বছর চলছে, আর শরণার্থীরা শুধুমাত্র মানবিক সাহায্যের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল থাকতে পারে না।

রাউফ মাজু ব্যাখ্যা করেন, “জীবিকা নির্বাহ এবং দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণের সুযোগ দিলে শরণার্থীরা বাংলাদেশে স্বনির্ভর হয়ে অর্থবহ একটি জীবন পাবে। এটি তাঁদেরকে প্রত্যাবাসনের পর মিয়ানমারের সমাজে মিশতে ও অবদান রাখতে প্রস্তুত করবে”।

২ জুন ইউএনএইচসিআর-এর সহকারী হাই কমিশনাররা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র সচিবসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সাথে এরকম বিবিধ বিষয় নিয়ে আলোচনার সুযোগ পেয়ে কৃতজ্ঞ বোধ করেন।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাথে মিলে শরণার্থীদের স্বেচ্ছা প্রত্যাবাসনের জন্য কাজ করার পাশাপাশি সহকারী হাই কমিশনাররা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য বিকল্প সমাধান নিয়েও আলোচনা করেন। এগুলো হতে পারে বিশেষ কিছু সুরক্ষার প্রয়োজনে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা শরণার্থীদের তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসন, এবং দেশের বাইরে কাজ ও শিক্ষার সুযোগের ব্যবস্থা।

ইউএনএইচসিআর সম্প্রতি ঘোষণা হওয়া ২০২১ সালের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান অনুযায়ী ও অন্যান্য উপায়ে বাংলাদেশ সরকারকে সহায়তা করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে পুনরায় আহ্বান করে। বিশ্বের বৃহত্তম শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১ মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীর বিশাল দায়িত্ব তুলে নিয়েছে বাংলাদেশ। এই সংকটকে বিশ্ব ভুলে যেতে পারে না।