আহমদ গিয়াস :

শুধু ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ নয়, বঙ্গোপসাগরের কক্সবাজার উপকুলেও তিমির বিচরণ ও বাসস্থান রয়েছে; যে কারণে কক্সবাজার উপকুলে বার বার তিমির মৃতদেহ ভেসে আসছে। বিজ্ঞানীদের মতে, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকুল থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমেই বিচরণ রয়েছে বিশ্বের কয়েকটি বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির তিমির। সাগরের গভীরতম স্থান হওয়ায় এখানে তাদের বাসস্থানও থাকতে পারে।
বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ বিশ্বের বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির বেশ কয়েকটি তিমিসহ প্রায় এক ডজন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ‘হটস্পট’ বা আবাসস্থল হিসাবে চিহ্নিত হওয়ার পর বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ সালে বঙ্গোপসাগরের ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ডের ১,৭৩৮ বর্গ কিলোমিটার সমুদ্র এলাকাকে সামুদ্রিক সংরক্ষিত অঞ্চল বা মেরিন প্রটেক্টেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষণা করেছে। সুন্দরবনের ৪০ কিলোমিটার দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরে ১ কিলোমিটারের বেশি গভীরতাসম্পন্ন একটি সমুদ্র তলদেশীয় আর্ন্তজাতিক খাদ, যা ভারতীয় অংশে ৪০ কি.মি. প্রশস্থ এবং বাংলাদেশে উপকুলে খাদের শেষ প্রান্তে এসে মাত্র ৬ কি.মি. প্রশস্থ হয়ে এর সমাপ্তি ঘটেছে; এই খাদটিই ‘সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড’ নামে পরিচিত।
ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির (ডাব্লিউসিএস) সর্বশেষ জরীপ মতে, বাংলাদেশে ১২ প্রজাতির সিটাসিয়ান বা জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণী রয়েছে। যারমধ্যে একটি প্রাণী নদীতে থাকে, বাকী ১১টি থাকে সাগরে। বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড এদের হটস্পট হলেও আশেপাশের সাগরেও তাদের বিচরণ দেখা যায় বলে জানান ওয়াইল্ড লাইফ কনজারভেশন সোসাইটির বাংলাদেশ কান্ট্রি রিপ্রেজেন্টেটিভ ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন।
তিনি বলেন, কক্সবাজার উপকুল থেকে মাত্র দেড়শ থেকে ২শ’ কিলোমিটার পশ্চিম-দক্ষিণে অবস্থিত বঙ্গোপসাগরের সোয়াচ অব নো গ্রাউন্ড। যেখানে ইতোমধ্যে ৪ প্রজাতির তিমি ছাড়াও ৭ প্রজাতির ডলফিন ও এক প্রজাতির পরপইস এর আবাসস্থল শনাক্ত হয়েছে। বাংলাদেশে থাকা চার প্রজাতির তিমির মধ্যে ব্রাইডিস বা বলিন তিমি, গন্ডার তিমি বা শুক্রাণু তিমি, ঘাতক তিমি এবং ছদ্ম ঘাতক তিমি অন্যতম। কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকুল থেকে মাত্র ৪০ কিলোমিটার পশ্চিমেই বিচরণ রয়েছে তিমি ও ডলফিনসহ অন্যান্য স্তন্যপায়ী প্রাণীর।
তবে International Union for Conservation of Nature (IUCN) বাংলাদেশ এর ২০১৫ সালের জরীপ অনুযায়ী বাংলাদেশের সামুদ্রিক জলসীমায় ৩ প্রজাতির তিমি রয়েছে। এগুলো হলো ব্রাইডিস তিমি, ফল্স কিলার তিমি ও শুক্রাণু তিমি।
বাংলাপেডিয়ার বাংলাদেশের জলচর স্তন্যপায়ী প্রাণীর সাইট- এ একেএম আমিনুল হক (২০১৪) সম্পাদিত তথ্য অনুযায়ী, ১৮৪২ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অঞ্চলের চট্টগ্রাম উপকুলের কাছে একটি তিমি আটকে পড়েছিল, যেটি Balaenoptera গণের অর্ন্তভুক্ত বলিন তিমি বলে শনাক্ত হয়েছিল।
ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, WCS এর ২০১৭ ও ২০১৮ সালের জরীপকালে গবেষকরা কক্সবাজারের সেন্টমার্টিন দ্বীপের অদূরে ব্রাইড’স হুয়েলের মা ও শাবক তিমিকে একসাথে দেখেছেন। কক্সবাজার ও টেকনাফ উপকুলেও তিমির স্বাভাবিক বিচরণ দেখা গেছে।
কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্টমার্টিন উপকুলবর্তী বঙ্গোপসাগরে তিমির আবাস ও বিচরণ রয়েছে বলে মনে করেন বাংলাদেশ ফিশারিজ রিসার্চ ইন্সটিটিউট (বিএফআরআই) এর সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও পিএইচডি ফেলো মোহাম্মদ আশরাফুল হক। তিনি বলেন, কক্সবাজার উপকুলে বার বার জীবিত ও মৃত তিমি ভেসে আসার ঘটনায় প্রমাণিত হয় কক্সবাজার উপকুলের আশেপাশে তিমির বিচরণ ও আবাস রয়েছে।
বিজ্ঞানী আশরাফ বলেন, ২০০৯ সালে আমি কক্সবাজার শহরের ফিশারীঘাটস্থ মৎস্য অবতরন কেন্দ্রে প্রায় ১৮ ফুট লম্বা মৃত একটি স্পার্ম হুয়েল দেখি, যেটি টেকনাফ সংলগ্ন সমুদ্র থেকে পার্চসিন জালে জীবিত ধরা পড়েছিল বলে জেলেরা আমাকে জানিয়েছিলেন। এছাড়া কক্সবাজারে বিভিন্ন উপকুলে বিভিন্ন সময়ে তিমির মৃতদেহ ভেসে আসে।
তিনি বলেন, ১৯৮৬, ১৯৯০, ১৯৯৬ ও ২০০৮ সালে লাবনী পয়েন্টে মৃত তিমি ভেসে আসে। ২০২০ সালে আসে শাহপরীর দ্বীপের বাংলা চ্যানেলে এবং সর্বশেষ গত মাসের (এপ্রিলের) ৯ ও ১০ তারিখে হিমছড়িতে দুটি মৃত তিমি ভেসে আসে। আর এসব ঘটনা কক্সবাজার উপকুলের গভীরতম সমুদ্রে তিমির আবাসস্থল থাকার সম্ভাবনা প্রমাণ করে।
বিজ্ঞানীরা জানান, পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম রিভার সিস্টেম গঙ্গা-ব্রম্মপুত্র-মেঘনা বা পদ্মা-যমুনা-মেঘনা বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বিপুল পরিমাণ স্বাদু পানি বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়। যার ফলে বাংলাদেশের উপকুল ও সাগরের পানি পৃথিবীর অন্যতম উর্বর জলরাশি হিসাবে স্বীকৃত, যেখানে রয়েছে একটি সমৃদ্ধ জীববৈচিত্রসহ বিশ্বের বিপন্নপ্রায় বিরল কয়েকটি সামুদ্রিক জলজ স্তন্যপায়ী প্রাণীর আবাসস্থল (হট স্পট)। যারমধ্যে রয়েছে মহাসাগরীয় জায়ান্ট হিসাবে পরিচিত কয়েক প্রজাতির তিমি ও ডলফিন। পৃথিবীর মোট ৬৪টি লার্জ মেরিন ইকোসিস্টেম বা সমুদ্র চিহ্নিত করা হয়েছে, যার মধ্যে আমাদের বঙ্গোপসাগরও অন্যতম। আর বঙ্গোপসাগর ভারত মহাসাগরের একটি অংশ।

কক্সবাজার ,০৮ মে, ২০২১ ইং