সিবিএন ডেস্ক:
পরিবারে-কর্মক্ষেত্রে নারীর এগিয়ে যাওয়া, গতিশীলতা, অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা ও দৃশ্যমান ভূমিকা রাখার পরও নারী নির্যাতন কমছে না। বরং নির্যাতনের ধরন বদলেছে। এর মাঝে আবার নারীর কাজের তালিকাও দীর্ঘ হয়েছে করোনাকালে। যুক্ত হয়েছে নতুন চ্যালেঞ্জ। বিশ্লেষকরা বলছেন, কেবল নারীর বেরিয়ে আসাই যথেষ্ট নয়। অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত হওয়ার পাশাপাশি নারীর ক্ষমতায়নের জন্য দরকার আরও কিছু।

করোনা মহামারিতে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) সংগঠনের ১ মে প্রকাশিত পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, গত এপ্রিলে দেশে ৩৭১টি নারী ও শিশু নির্যাতনের মধ্যে ১৩৭টিই ছিল ধর্ষণের ঘটনা। দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে ৩১টি। এ ছাড়াও ৩২ জন কিশোরী, ৬৯জন নারী আত্মহত্যা করেছে। মোট ৭৫ নারী ও শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন।

ধর্ষণের শিকার ১৩৭ জনের মধ্যে ৭৬ জন শিশু ও কিশোরী। ধর্ষণের চেষ্টা হয়েছে ১৫টি। যৌন হয়রানি ২২টি ও শারীরিক নির্যাতনের ঘটনা ২৯টি। এ ছাড়াও অ্যাসিড সন্ত্রাসের শিকার হয়েছেন দুই নারী। অপহরণের শিকার হয়েছে তিন শিশু, চার কিশোরী ও দুই নারী। ১১টি শিশু এখনও নিখোঁজ।

প্রতিষ্ঠানটির গত নভেম্বরের শেষে দেশের ৫৯টি জেলার ১০ লাখ নারীর অংশগ্রহণে করা এক জরিপে দেখা যায়, এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৪০ হাজার নারী পারিবারিক সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৪০ শতাংশ নারী প্রথমবারের মতো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

সংস্থাটি জানিয়েছে, লকডাউন চলাকালে নারীর ওপর সহিংসতার মাত্রা অস্বাভাবিক বেড়েছে। পারিবারিক সহিংসতার ক্ষেত্রে শারীরিক নির্যাতনের চেয়েও মানসিক নির্যাতনের মাত্রা ছিল বেশি।

প্রশ্ন হলো, নারীর অগ্রগামিতা বাড়লেও নির্যাতন কেন কমছে না? নারী অধিকার সংগঠনগুলোর জোট উই ক্যানের সমন্বয়ক জিনাত আরা হক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “অগ্রগামিতা বা অর্থনৈতিক কাজে যুক্ত হলেই নির্যাতন কমবে, ব্যাপারটা এমন নয়। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য এগুলো দরকার। কিন্তু নির্যাতন কমাতে দরকার আরও অনেক কিছু। দরকার পরিবারের সমর্থন ও নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ। উন্নয়নকে খণ্ডিতভাবে দেখি বলে সমস্যা হচ্ছে।’

তিনি মন্তব্য করেন, ‘নারীর এগিয়ে যাওয়ায় নির্যাতনের ধরনও বদলেছে। আগে নারীর কণ্ঠ ছিল না। এখন যে নারীরা প্রতিবাদ করছে তাকে ভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। এ নির্যাতনকে মোকাবিলা করার জন্য তার কিছু ‘টুলস’ থাকতে হবে।”

তবে কি অগ্রগামিতা সঠিক স্থানে ঘটেনি? এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষক কাবেরী গায়েন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নারীর অগ্রগামিতা একটি তুলনামূলক শব্দ। কার সাপেক্ষে অগ্রগামী হয়েছে, কিংবা কার সাপেক্ষে হয়নি এ প্রশ্ন আসে। আমি যদি রাশা সুন্দরী দেবীর সময়কাল থেকে বলি, তা হলে অনেক আমরা এগিয়েছি। বাংলাদেশে নারীসমাজ দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে আসছে। তবে সেটা ‘ট্যাবু’ সমাজে। আমি মনে করি, গার্মেন্টসে নারীরা যখন কাজ করা শুরু করলেন, আমাদের সামাজিক প্রতিবন্ধকতার যে মিথ ছিল, তা ভেঙে গেলো।’

তিনি মনে করেন, ‘তৃণমূলের চিন্তাধারার পরিবর্তন করা না গেলে কিছুই বদলাবে না। প্রান্তিক অঞ্চলে ছেলেমেয়েদের যেসব প্রণোদনা দেওয়া হতো, সেই স্কিম আবারও চালু হোক। তা না হলে এর ভয়াবহতা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে যাবে। মেয়েদের বিয়ে হবে অল্প বয়সে। জন্ম নেবে অপুষ্ট সন্তান। সব মিলিয়ে রাষ্ট্র এতো বড় দায়ভার নিতে পারবে না। নারীদের আবার স্কুলে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।’

কেন নির্যাতন কমছে না?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন-এর বনশ্রী মিত্র নিয়োগী মনে করেন, “নারীর এই বেরিয়ে আসাকে সমাজ সহজভাবে নিতে পারেনি। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে, ক্ষেত্রবিশেষে পুরুষ সঙ্গীর চেয়ে বেশি আয় করছে, এটাও গ্রহণ করতে চায় না। কাজ করতে আসা নিয়ে আপত্তি নেই; কিন্তু শুনতে হয় ‘সংসার সামলে যদি আয় করতে পারো করো’। নারীকে অর্থনৈতিক কাজে স্বাধীনতার কারণে বাইরে যেতে দিচ্ছি তা নয়, সংসার চালাতে সহায়তা হবে বলে অনুমতি দিচ্ছি।”

বনশ্রী নিয়োগী আরও বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে যাওয়ার পরে আরেক ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হয়। অর্থনৈতিক কাজের গতিশীলতার বাড়ার পরও গৃহস্থালী কাজ ও সেবামূলক কাজের যে বোঝাগুলো বইতে হচ্ছে সেটাও যে নির্যাতন, তা আলাদা করে চিহ্নিত করা হয় না। পাবলিক পরিসরে নির্যাতন বেড়ে যাওয়ার কারণে হচ্ছে, আমরা নারীকে বাইরে দেখতে প্রস্তুত নই। পুরুষ তার প্রয়োজনে নারীকে বের হওয়ার অনুমতি দিচ্ছে, কিন্তু সে তার স্বাধীনতায় বিশ্বাসী নয়। ধর্মান্ধতাও একটা ভূমিকা পালন করছে। দীর্ঘদিন ধরে নারীর অধিকার বিষয়ে ভুল তথ্য দিয়ে তারা সমাজে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।’ -বাংলা ট্রিবিউন