অনলাইন ডেস্ক: ভারতের পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচনে হ্যাটট্রিক জয় পেয়েছে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০১১, ২০১৬-এর পর ২০২১ সালে জয়ের মাধ্যমে দলটি টানা তিনবার বিজয়ের খ্যাতি অর্জন করল।
রোববার সকাল থেকেই ভোট গণনা শুরু হয়। দুপুরের পর থেকে তৃণমূলে নিশ্চিত বিজয়ের খবর আসতে থাকে। এ ধরনের খবর আসার সঙ্গে সঙ্গে দলের অফিস ও আশপাশের সড়কে শুরু হয় আনন্দ উৎসব। এর অংশ হিসেবে সীমিত আকারে রংও মাখানো হয়। এর আগে রাজ্যজুড়ে ২৭ মার্চ থেকে ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত আট দফায় ভোট হয়। ২৯৪ আসনের বিধানসভায় এবার ভোট হয়েছে ২৯২টিতে। সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজন ১৪৮ আসন। সেখানে তৃণমূল ২১৩ আসনে জয় পেয়েছে, এগিয়ে আছে ৪টিতে।
কোভিডের কারণে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতা ও তার মন্ত্রিসভা ছোট আকারে শপথ নেবে। এখনই নয়, পরে বিজয় সমাবেশ হবে ব্রিগেডে। তৃণমূলের বিজয় নিশ্চিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন রাজ্য থেকে মমতা ব্যানার্জিকে অভিনন্দন জানাচ্ছেন নানা দল ও জোটের নেতারা।
তৃণমূল নেত্রী মমত ব্যানার্জির আসন নন্দীগ্রামের ভোটের ফল নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে। তবে পরে এ আসনে বিজেপি প্রার্থী শুভেন্দু অধিকারীকে বিজয়ী ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। এছাড়া রোববার পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি কেরল, পদুচেরী, অসম এবং তামিলনাড়ুতে নির্বাচনের ফল ঘোষণা করা হয়। এতে কেরলে বাম, অসমে বিজেপি এবং তামিলনাড়ুতে ডিএমকে এবং পদুচেরীতে এনডিএ বিজয়ী হয়েছে।
এবারের পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভার ভোটে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নেতৃত্বে সর্বশক্তি দিয়ে মাঠে নেমেছিল বিজেপি। বিজেপির লক্ষ্য ছিল তৃণমূল নেত্রী মমতা ব্যানার্জির তৃণমূল কংগ্রেসের পরাজয় নিশ্চিত করা। বিজেপির হয়ে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী ১৮টি এবং অমিত শাহ ২৯টি জনসভা করে গিয়েছেন।
চার্টার্ড বিমানে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে অমিত শাহ, রাজনাথ, যোগী আদিত্যনাথরা দিল্লি-কলকাতা ডেলি প্যাসেঞ্জারি করছিলেন। প্রচারে নেমে বাংলাদেশকেও নানা ইস্যুতে টার্গেট করেছিল বিজেপি এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহরা।
গুজরাটের মতো সুশাসন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু ভোটে পশ্চিমবঙ্গের মানুষ মোদি শাহর স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে। তারা ফের তৃণমূল কংগ্রেসকে সমর্থন করে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে মমতাকে হ্যাটট্রিক করিয়ে দিয়েছে।
২৯৪ আসনের বিধানসভায় এবার ভোটে মমতা একাই ২১৩ আসন পেলেন। রাত নটা পর্যন্ত ২১৩টি আসনে তৃণমূলকে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়েছে, ৪টিতে এগিয়ে রয়েছে।
অপরদিকে বিজেপিকে ৭৩ আসনে জয়ী বলে ঘোষণা দেওয়া হয়। দলটি এগিয়ে আছে ২টি আসনে। যদিও তৃণমূলের এই বিপুল জয়ের মধ্যেও নন্দীগ্রামে শুভেন্দু অধিকারীর কাছে মমতার নিজের ১৯২২ ভোটে হেরে যাওয়াটা বিশাল জয়মালায় গোলাপের কাঁটা হয়ে রইল। যদিও নন্দীগ্রামের এই ফলের বিরুদ্ধে কোর্টে যাওয়ার ঘোষণা করেছেন স্বয়ং মমতাই।
পশ্চিমবঙ্গে প্রচারে নেমে মোদি স্লোগান দিয়েছিলেন, কেন্দ্রের সঙ্গে রাজ্যেও বিজেপি এলে ডাবল ইঞ্জিন সরকার হবে। কিন্তু বাংলায় মমতা একাই বিজেপির আগ্রাসন রুখতে গিয়ে ভোটে ডাবল সেঞ্চুরি করে দিলেন।
ভোটের ফল ঘোষণার পর মমতা ব্যানার্জি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে বলেন, ‘এখন প্রথম কাজ কোভিড মোকাবিলা। দেশের সবাইকে বিনামূল্যে করোনার ভ্যাকসিন দিতে হবে, নইলে আমি গান্ধী মূর্তির নিচে অনশন আন্দোলনে বসব।’
অন্যদিকে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি বিজেপির হার হয়েছে তামিলনাড়ু, কেরলেও। কেরলে বিজেপি পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। আসামে অবশ্য গতবারের চেয়ে আসন কম পেয়েও ফের ক্ষমতায় ফিরেছে বিজেপি সরকার। তবে মোদিশাহদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জেতা দেশের একমাত্র মহিলা ‘মুখ্যমন্ত্রী’ই যে এই মুহূর্তে ভারতীয় রাজনীতির সেরা নক্ষত্র, তা নিয়ে কোনো দ্বিধা রইল না রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের।
‘একপায়ে বাংলা দখল করব আর দু’পায়ে দিল্লি’ ভোট প্রচারের জনসভা থেকে মোদি সরকারের বিরুদ্ধে হুঙ্কার দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ভাঙা পায়েই ভোটের ময়দানে নেমেছিলেন তৃণমূলনেত্রী। লোকসভা ভোট থেকে শুরু হওয়া মোদির নেতৃত্বে বিজেপি ঝড়কে এবার বিধানসভা ভোটে একার নেতৃত্বে রুখে দিয়েছেন মমতা। সেই দীর্ঘ লড়াই আর আত্মত্যাগের আজ মধুর ফল পেলেন তৃণমূল সুপ্রিমো। মাটি কামড়ে কীভাবে পড়ে থাকতে হয়, তা শিখিয়ে দিলেন।
কখনও মমতাময়ী জননেত্রী হিসাবে তো কখনও অভিভাবক, আবার কখনও কড়া দলনেত্রী হিসাবে দায়িত্ব সামলেছেন। আম্পান হোক বা করোনার চোখ রাঙানি, আদর্শ ক্যাপ্টেনের মতোই সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বিজেপিকে অনেকখানি পিছনে ফেলে ম্যাজিক ফিগারের অনেক বেশি আসন নিয়ে আরও একবার পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় ফিরল মমতার তৃণমূল সরকার। তবে এখনই কোনো বিজয় উৎসব করছেন না দলটির নেতারা। জানিয়েছেন, ‘এখন বিজয় মিছিল হবে না, কোভিড কমলে ব্রিগেডে পরে সমাবেশ হবে।’
ভোট শুরুর আগে মমতার দল থেকে শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, সিঙ্গুরের রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের মতো বহু হেভিওয়েট নেতা বিজেপিতে যোগ দিয়েছিলেন।
পদ্ম প্রতীকে প্রার্থীও হয়েছিলেন দলবদলানো ১৪৮ জন। কিন্তু ভোটে এদের মধ্যে ১৩৩ জনই হেরে গিয়েছেন। এবারের পশ্চিমবঙ্গে ভোটের ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, বাম ও কংগ্রেস কার্যত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। মাত্র দশ বছর আগে যে দল ক্ষমতায় ছিল সেই সিপিএম তথা বাম জোট যে শূন্যে দাঁড়াবে তা কেউ ভাবতে পারেননি। উল্টো বামের সঙ্গে জোটবাঁধা কংগ্রেসও মালদহ ও মুর্শিদাবাদে খাতা খুলতেই পারেনি। স্বাধীনতার পর এই প্রথম দুই জেলায় মমতার ঝড়ে কংগ্রেসের অবস্থা এতটা শোচনীয় হলো।
বিশ্লেষকদের মতে, এবার পশ্চিমবঙ্গের ভোটের ফল প্রমাণ করে দিয়েছে, মমতার জনপ্রিয়তা, তাঁর প্রতি পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু মুসলিম খ্রিস্টান বৌদ্ধদের বিশ্বাস এবং আস্থা-ভরসাকে টলাতে পারেননি শাহ-নাড্ডা-স্মৃতি ইরানিরা। তাঁর পরিবার ও ভাইপো অভিষেকের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে গরু পাচার ও কয়লা কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী। সিবিআই ও ইডিকে তদন্তেও নামানো হয়েছিল। কিন্তু জনগণ যে সেই অভিযোগকে গুরুত্ব দেয়নি তা প্রমাণ হয়ে গেল।
দীর্ঘদিনের প্রথা ভেঙে এবার কেরলে ক্ষমতার ফিরল বামেরা। আসলে প্রতি পাঁচ বছর অন্তর ভোটে জিতে কেরলে সমস্ত বিরোধীদলই ক্ষমতায় আসছিল গত ৪০ বছর ধরে। কিন্তু এবারই পর পর দু’বার বামেরাই জিতল। সিপিএমের নেতৃত্বধীন এলডিএফ জোট ফের ক্ষমতায় এল ৯৫ আসনে জিতে। কেরলের ১৪০টি আসনের মধ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউডিএফ ৪৮।
কান্নুর জেলার ধর্মাদম আসনে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন জিতেছেন। তামিলনাড়ুতে ডিএমকে-কংগ্রেস জোট বিপুল ভোটে জিতেছে। ২৩৪টি আসনের মধ্যে ডিএমকে জোট ১৪৩ এবং এডিএমকে জোট ৮৯টিতে জিতেছে।
১০ বছর ক্ষমতায় থাকার পরেও প্রয়াত জয়ললিতার দল এআইডিএমকের এই ফল তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা। উত্তর-পূর্বের রাজ্য অসমে ফের ক্ষমতায় ফিরছে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট।
১২৬টি আসনের মধ্যে বিজেপি, অসম গণপরিষদ এবং বোড়ো জনগোষ্ঠীর দল ইউপিপিএল এগিয়ে ৮৫টিতে। কংগ্রেস, এআইইউডিএফ এবং বামেদের জোট ৫০টিতে। পুদুচেরিতেও ক্ষমতা দখল করছে এনডিএ জোট। প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এন রঙ্গস্বামীর দল ও এনআর কংগ্রেস এবং এডিএমকে-কে সঙ্গী করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের মোট ৩০টি আসনের মধ্যে ১৪টিতে জিতেছে বিজেপি। কংগ্রেস-ডিএমকে জোট জিতেছে ৭টিতে।
যাঁর হাত ধরে তৃণমূলের এতবড় সাফল্য সেই প্রশান্ত কিশোর এবার ভোটকুশলীর দায়িত্ব ছেড়ে দেবেন বলে জানিয়েছেন। সহকর্মীদের হাতে দায়িত্ব তুলে দিয়ে নিজের সংস্থা আইপ্যাক ছেড়ে অন্য কিছু করতে চান বলে জানিয়েছেন।
গত দু’বছর ধরে যে ভাবে বাংলায় দাপট দেখিয়েছে গেরুয়া বাহিনী, সেই পরিস্থিতিতে তাঁর জাদুদণ্ডই তৃণমূলকে সাফল্যের পথ দেখিয়েছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল।
এ নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করলে প্রশান্ত বলেন, ‘দিদিকে সাহায্য করতে পেরে খুশি আমি। এই জয়ের মধ্যেও জানিয়ে রাখি যে আমি এই কাজ ছাড়ছি। আর এই কাজ করতে চাই না। অনেক হয়েছে। সহকর্মীদের হাতে আইপ্যাকের দায়িত্ব তুলে দিয়ে জীবনে অন্য কিছু করতে চাই আমি।’’
পশ্চিমবঙ্গে যে ক্ষমতায় তৃণমূল তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিরছেন তা স্পষ্ট হতেই ভারতের নানা প্রান্ত থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মমতাকে শুভেচ্ছা জানতে শুরু করেন।
বিজেপির ‘ঘৃণার রাজনীতি’কে পরাস্ত করার জন্য মমতাকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইট করেন সমাজবাদী পার্টির সুপ্রিমো তথা উত্তরপ্রদেশের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী অখিলেশ যাদব।
তিনি লিখেছেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির ঘৃণার রাজনীতিকে হারানোর জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তৃণমূলের নেতা ও কর্মীদের হার্দিক অভিনন্দন। এক মহিলাকে বিজেপি-র ‘দিদি ও-দিদি’ বলে অপমান করার জোরালো জবাব দিয়েছেন জনতা।’
অভিনন্দন জানিয়ে করোনা অতিমারির বিরুদ্ধে এক সঙ্গে লড়াই আহ্বান জানিয়ে টুইট করেন এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার।
লিখেছেন, ‘এই দুরন্ত জয়ের জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে অভিনন্দন। আমরা একসঙ্গে মানুষের জন্য আমাদের কাজ এবং অতিমারি পরিস্থিতি মোকাবিলায় কাজ করে যাব।’
টুইট করে অভিনন্দন জানিয়েছেন আপ প্রধান অরবিন্দ কেজরীবাল। তিনি লিখেছেন, ‘মমতা দিদি, আপনাকে ভূমিধস বিজয়ের জন্য অভিনন্দন। একেই বলে লড়াই।’
ভোট গণনা শুরুর পরেই মমতার হ্যাটট্রিকের ইঙ্গিত দেখে শিবসেনার মুখপাত্র ও সাংসদ সঞ্জয় রাউত লেখেন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলই সরকার বানাবে। পাশাপাশি তৃণমূল সুপ্রিমোর লড়াকু মানসিকতার প্রশংসা করে টুইটে লেখেন, ‘বাংলার বাঘিনীকে অভিনন্দন।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।