আবুল কালাম, চট্টগ্রাম:
গভীর রাতে পরিত্যক্ত পঁচা ও আবর্জনাময় ডোবার পানিতে নেমে চট্টগ্রামের আলোচিত ট্রাকচালক আজিজুল নিখোঁজ মামলার রহস্য উদঘাটন করেছেন চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (রাউজান- রাঙ্গুনিয়া সার্কেল) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম।

ক্রাইম থ্রিলারকে হার মানানো এক মাস ব্যাপী নিবিড় তদন্তের ঘটনা পরম্পরা শেষে তিনি নির্ধারণ করতে সক্ষম হন যে, ভিকটিম আজিজুল আসলে শুধু অপহরণ নয়,বরং হত্যাকাণ্ডের শিকার এবং নিহতের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নেজামই এই হত্যার প্রধান কুশীলব। সে অনুযায়ী গত ২৪ এপ্রিল কঠোর গোপনীয়তায় তিনি আসামি নেজামকে গ্রেফতার এবং তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী রাঙ্গুনিয়ার হাজীপাড়া গ্রামের এক মজা ডোবার তলদেশ থেকে ভিকটিমের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করেন।

কর্মদক্ষতার এমন অনুপম প্রদর্শনীতে দেশব্যাপী নেটিজেনদের প্রশংসায় ভাসছেন সার্কেল এএসপি আনোয়ার শামীম এবং রাঙ্গুনিয়া থানা পুলিশ।

ঘটনার বিবরণে জানা যায় যে, গত ২৫ শে মার্চ রাতে চট্টগ্রাম থেকে নিখোঁজ হন রাঙ্গুনিয়া উপজেলার ইসলামপুর ইউনিয়নের আল আমিন পাড়া গ্রামের আব্দুল হাকিমের ছেলে পেশায় ট্রাকচালক আজিজুল হক (২৭)। ২৬ মার্চ আজিজুল হকের বাবা রাঙ্গুনিয়া থানায় একটি হারানো জিডি করলে বিষয়টি নিয়ে তদন্তে নামে পুলিশ। এর মধ্যে গত ৬ এপ্রিল আজিজুল হকের মামা হায়দার আলী বাদী হয়ে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি অপহরণ মামলা দায়ের করেন।

তদন্তে নেমে আজিজের ব্যবহৃত মোবাইলটি প্রযুক্তির সাহায্যে কক্সবাজারে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। ঘটনার ১৫ দিন পর সূত্র ধরে কক্সবাজার সদর এলাকা থেকে মোবাইল এবং রামু এলাকা থেকে ট্রাকটি জব্দ করা হয়। অপহরণকাণ্ডে জড়িত সন্দেহে ওই এলাকা তাদের দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে তারা নেজামের সংশ্লিষ্টতার কথা স্বীকার করে। এরপর পুলিশ প্রযুক্তির সাহায্যে তার অবস্থান সন্দ্বীপে শনাক্ত করে। শনিবার সন্দ্বীপ থানা পুলিশের সহায়তায় তাকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গভীর রাতে ওই ডোবার তলদেশ সার্চ করে ভিকটিমের লাশ উদ্ধার করে সার্কেল এএসপির নেতৃত্বাধীন পুলিশ তদন্ত দল।

পুলিশের তদন্তে উঠে আসে যে, ঘটনার দিন রাত ৯ টার দিকে বালু আনার নাম করে আজিজুলকে কৌশলে রাঙামাটি জেলার বেতবুনিয়া এলাকার এক নিভৃত জায়গায় নিয়ে গিয়ে ট্রাকের রেঞ্জ (যন্ত্রাংশ) দিয়ে মাথায় আঘাত করে এবং ছুরিকাঘাতে হত্যা করেন । হত্যার পর একদিন পাহাড়ে মরদেহ লুকিয়ে রাখার পর বন্ধু আজিজুলের জানাজা ও দাফনের চিন্তা আসে নেজামের মাথায়। সে অনুযায়ী গত ২৬ মার্চ রাতে তিনি মরদেহটি কাঁধে করে রাঙ্গুনিয়া থানার চৌধুরীখিলস্থ নাজিম প্রফেসরের পাহাড়ের পাদদেশে একটি ডোবার সামনে নিয়ে আসেন। সেখানে নেজাম একাই মৃতের জানাজা পড়েন এবং কবর দেওয়ার মতো করে ডোবার তলদেশে লাশটিকে গুম করেন। এর আগে তিনি হত্যার জন্য বন্ধুর লাশের হাতে ধরে ক্ষমাও চান।

আদালত সূত্রে জানা যায়, আজিজুল হককে হত্যার দোষ স্বীকার করে রোববার (২৫ এপ্রিল) দুপুরে চট্টগ্রামের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট বেগম আঞ্জুমান আদালতে আসামি মো. নেজাম ১৬৪ ধারার জবানবন্দি দেন। জবানবন্দিতে তিনি আজিজুলকে হত্যা ও গুমের ঘটনার রোমহষর্ক বর্ণনা তুলে ধরেন। পাশাপাশি তিনি নিজ স্ত্রীর সঙ্গে পরকীয়ার সন্দেহ থেকেই এ হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করেছেন বলেও জবানবন্দিতে দাবি করেন।

এএসপি আনোয়ার শামীম কর্তৃক গভীর রাতে পড়ো ডোবায় নেমে ভিকটিমের অর্ধগলিত মৃতদেহ খুঁজে বের করার একটি ভিডিওচিত্র সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ভাইরাল হলে তা নিয়ে নেটিজেনদের মধ্যে আলোচনার ঝড় উঠে। অনেকেই এএসপি আনোয়ার শামীমের অকুণ্ঠ প্রশংসা করে সেখানে মন্তব্য করেন। এছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দারাও পঞ্চমুখ হন পুলিশের প্রশংসায়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে স্থানীয় একজন স্কুল শিক্ষক বলেন, পুলিশ চাইলে যে সবকিছুই করতে পারে, তার বড় প্রমাণ এই ঘটনা। আমরা কেউ কল্পনাও করিনি যে, এই ঘটনার রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হবে। সবঘটনার ক্ষেত্রে পুলিশ প্রশাসন এরকম তৎপর ও দক্ষ ভূমিকা রাখবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

এ প্রসঙ্গে সূত্র ও তথ্যপ্রমাণ বিহীন এই মামলার রহস্য উদঘাটনের প্রধান কারিগর চট্টগ্রামের সহকারী পুলিশ সুপার (রাউজান -রাঙ্গুনিয়া সার্কেল) মো. আনোয়ার হোসেন শামীম বলেন, আমার বিশ্বাস ছিল, আমরা পারব। তদন্তের বিভিন্ন পর্যায়ে ভিকটিমের পরিবারের সদসদেরকে আমি বারবার আশ্বস্ত করেছি যে, এই ঘটনার রহস্য আমরা উদঘাটন করবই। আল্লাহকে ধন্যবাদ আমরা শেষপর্যন্ত তা করতে সমর্থ হয়েছি।

যেখানে অধীনস্থ পুলিশ সদস্যদেরকে আদেশ করলে তারাই গুম করা লাশ খুঁজে বের করত, সেখানে এত রাতে একজন এএসপির ওই পচা ডোবায় নামার মতো ঝুঁকি নেওয়ার প্রয়োজন ছিল কিনা জানতে চাইলে এএসপি আনোয়ার শামীম বলেন, ‘দেখুন, প্রথমত অধীনস্থ শব্দটির সাথে আমি একদম একমত নই। এটা ঠিক, আমি আমার নিম্ন র‍্যাংকের পুলিশ সদস্যদের আদেশ দিয়েও কাজটা করানো যেত। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার চিন্তাটা একটু ভিন্ন। অন্যদেরকে আদেশ দিয়ে দায়িত্ব শেষ করার বদলে আমি সবসময় নিজে সামনে থেকে কাজ করে পথ দেখানোর নীতি অনুসরণ করে চলি। অন্য পুলিশ সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করাটাই আমার পছন্দের, তিনি বা তারা যেই পদমর্যাদারই হোন। ঘরে বসে আদেশ দেওয়ার বদলে আমি কাজের মাধ্যমেই দেখাতে চাই যে, এখানে কে নেতৃত্বের ভূমিকায় রয়েছেন। আর এটাই আমার নেতৃত্বের স্টাইল।”