সিবিএন ডেস্ক:
একে-৪৭ থেকে মুর্হুমুহু গুলি ছুড়ে সেই ভিডিও পোস্ট করেছিলেন ফেসবুকে। বছর খানেক আগে সেই ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এ ছাড়া মদের বোতল সামনে নিয়ে ছবি তুলে ফেসবুকে দিয়ে বিতর্ক কুড়িয়েছিলেন তিনি। এ-ই শেষ নয়, বঙ্গবন্ধুর স্নেহভাজন প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাকে মুঠোফোনে অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিয়ে আরেক বিতর্কের জন্ম দেন। এখন এক ব্যাংক কর্মকর্তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ উঠেছে তার বিরুদ্ধে। এভাবে একের পর এক বিতর্কের বৃত্তে ঘোরপাক খাচ্ছেন নাজমুল হক চৌধুরী ওরফে শারুন চৌধুরী। তিনি জাতীয় সংসদের হুইপ চট্টগ্রামের পটিয়া আসনের সংসদ সদস্য শামসুল হক চৌধুরীর ছেলে।

বিএনপি-জাতীয় পার্টি হয়ে শেষে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এসে সংসদ সদস্য হওয়া শামসুল হক চৌধুরী নিজেও বিপাকে আছেন ছেলে শারুনকে নিয়ে। স্থানীয় আওয়ামী লীগের সঙ্গেও তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে ছেলের কারণে। বাবার ক্ষমতার দাপটে ছেলের এমন বেপরোয়া চালচলনে ক্ষুব্ধ দলের নেতাকর্মীরা।

অভিযোগ আছে, বাবার পরিচয় ব্যবহার করে চাঁদাবাজি, দখলবাজি, হামলা-মামলাসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়েছেন শারুন চৌধুরী। এসব ঘটনায় তার সার্বক্ষণিক অনুসারী-অনুগামীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অপরাধের অভিযোগে থানায় মামলা হয়েছে। এর আগে বছর খানেক আগে ক্যাসিনো, জুয়ার আখড়ায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযান পরিচালনার সময় পুলিশের একজন কর্মকর্তা হুইপ শামসুল হক চৌধুরীর বিরুদ্ধে আবাহনী ক্লাবে জুয়ার আসর বসানোর অভিযোগ তোলেন। পরে ওই পুলিশ কর্মকর্তাকে অদৃশ্য শক্তির চাপে অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল বলেও অভিযোগ আছে। ওই সময় জুয়া ও ক্যাসিনোর বিরুদ্ধে অভিযান সম্পর্কে বিতর্কিত মন্তব্য করেও আলোচনার জন্ম দেন হুইপ নিজে।

চট্টগ্রামের স্থানীয় সূত্র ও ভুক্তভোগীদের সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, বাবার বয়সী ব্যবসায়ী ও আওয়ামী লীগ নেতা সেলিম নবীকে হুমকি এবং ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে বাবার চেয়েও বেশি বয়সী বীর মুক্তিযোদ্ধা ও বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আওয়ামী লীগ নেতা দিদারুল আলম চৌধুরীকে ‘থাপ্পড় মেরে দাঁত ফেলে দেওয়ার হুমকি’ বিতর্কে ব্যাপক সমালোচনা কুড়িয়েছিলেন শারুন। দিদারুল আলম চৌধুরীর সঙ্গে ফোনালাপের অডিওটি তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। যদিও শারুন তখন দাবি করেন, তার কথা এডিট এবং টেম্পারিং করা হয়েছে। শারুনের ওই দাবিকে তখন চ্যালেঞ্জ করেন দিদারুল আলম।

ফেসবুকের ভিডিও সূত্রে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর নাজমুল হক চৌধুরী শারুন একে৪৭ রাইফেল তুলে একের পর এক গুলি করছেন। হুইপপুত্রের ওই ভিডিও জনমনে ভীতি সৃষ্টি করেছিল বলে অভিযোগ করেন পটিয়ার স্থানীয় সাধারণ মানুষ।

এবার অভিযোগ উঠেছে চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক আবদুল মোরশেদ চৌধুরীর আত্মহত্যার প্ররোচনার পেছনে আছেন শারুন ও তার সহযোগীরা। গত ৭ এপ্রিল মোরশেদ চৌধুরী চট্টগ্রামের হিলভিউ আবাসিক এলাকার নাহার ভবনের ৬ তলার একটি ঘরে আত্মহত্যা করেন। এই অভিযোগে শারুনের সহযোগীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে মামলা করেছেন ব্যাংকার মোরশেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান।

মোরশেদ চৌধুরী তার সুইসাইড নোটে লিখে যান, ‘আর পারছি না। সত্যি আর নিতে পারছি না। প্রতিদিন একবার করে মরছি। কিছু লোকের অমানুষিক প্রেশার আমি আর নিতে পারছি না। প্লিজ, সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিয়ো। আমার জুমকে (মেয়ে) সবাই দেখে রেখো। আল্লাহ হাফেজ।’

আত্মহত্যার ঘটনায় চারজনকে আসামি করে স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী বাদী হয়ে গত ৮ এপ্রিল পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। মামলায় নির্যাতন-আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগ উঠেছে যুবলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক শহীদুল হক চৌধুরী রাসেল, চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক জাবেদ ইকবাল, তার ভাই পারভেজ ইকবাল এবং নাইম উদ্দিন সাকিব নামে চারজনের বিরুদ্ধে।

ইশরাত জাহান গণমাধ্যমের কাছে অভিযোগ করেন, দুই বছর আগেই ব্যাংকার মোরশেদের অনুপস্থিতিতে তার বাসায় লোকবল নিয়ে হামলা চালান হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা আরসাদুল আলম বাচ্চু, পারভেজ, জাবেদ ইকবাল, সাকিবসহ অন্যরা। ওই সময় এ ঘটনা নিয়ে নিরাপত্তা চেয়ে থানায় জিডি করা হয়েছিল। কিন্তু ‘সেই জিডিতেও যাতে হুইপপুত্র শারুনের নাম না লেখা হয় সে জন্য সামাজিকভাবে অনেকটা চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল’- এমন তথ্য জানিয়ে মোরশেদের স্ত্রী ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘আশা করেছিলাম পুলিশি তদন্তে পরবর্তী সময়ে সবকিছু বের হয়ে আসবে, অপরাধীরা শাস্তি পাবে। কিন্তু সেটি দূরে থাক, উপর্যুপরি চাপ প্রয়োগে মানসিক যন্ত্রণায় ভুগেছেন মোরশেদ। শেষ পর্যন্ত তাকে আর রক্ষা করা গেল না।’

মামলা দায়েরের এক সপ্তাহ পরও আসামি গ্রেপ্তার না হওয়ায় উদ্বেগ জানিয়ে মোরশেদের স্ত্রী বলেন, ‘অভিযুক্ত সাকিবের পক্ষ নিয়ে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছিলেন তারা। পারভেজ, জাবেদ ও সাকিবদের দেওয়া চাপ, অপমান ও হুইপপুত্র শারুন ও বাচ্চুদের উপস্থিতিতে বাসায় হামলার পর নিরাপত্তার জন্য আমরা দেশের বাইরে জাপানে চলে যেতে চেয়েছিলাম। সেই খবর পেয়ে আমাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়।’

ইশরাত জাহান চৌধুরী বলেন, ‘২০১৮ সালে এ ঘটনা ঘটে। সাকিবরা উপর্যুপরি বাড়তি পাওনা টাকা দাবি করে। সাকিবের বাবা মহসিন তাদের পাঁচলাইশের এমএম টাওয়ারে মোরশেদকে ডেকে নিয়ে যান। যেন টর্চার সেলে পরিণত হয় সেই বাড়ি। সেখানে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। হুমকির মুখে আমাকে ডেকে নিয়ে অতিরিক্ত টাকা দাবি করে জোরপূর্বক স্ট্যাম্প ও চেকে সই নেওয়া হয়েছিল। আমার স্বামীকে বাঁচাতে আমি, আমার ভাশুর, ননদ, ননদের হাজব্যান্ডসহ আমরা ছুটে যাই। সে সময় আসামি পারভেজ, জাবেদ, সাকিব সবাই ছিল। আমাদের মোবাইল ফোন তারা কেড়ে নিয়েছিল। আমি মোবাইল ফোন দিতে না চাইলে আমারটাও কেড়ে নেয়। শেষ পর্যন্ত স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর নিয়ে সবার মোবাইল ফোন ফিরিয়ে দেওয়া হলেও আমার মোবাইল ফোনটি তারা রেখে দেয় এবং আমাদের সেই পাসপোর্ট এখনো ফেরত দেওয়া হয়নি।’

ইশরাত উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, ‘মামলায় অভিযুক্ত ব্যক্তি ছাড়াও নেপথ্যে যারা থেকেছেন তাদের ব্যাপারেও ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন।’

ইশরাত বলেন, ‘মিথ্যা মামলা করে ওই ব্যবসায়ীপুত্র সাকিব একটি মামলায় আসামি করেছিলেন আমাকে। তার প্রতিটিতেই আমি নির্দোষ হিসেবে আদালত কর্তৃক ছাড়া পেয়েছি।’ মামলাটি ডিবিতে স্থানান্তরের পর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসে জিজ্ঞাসাবাদ করলেও কোনো আসামি গ্রেফতার না হওয়ায় উদ্বেগ জানান তিনি। মুঠোফোনে পাওয়া না গেলেও সামাজিক মাধ্যমে অবশ্য হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী এসব অস্বীকার করেই চলেছেন।

মামলা দায়েরের পর থেকে আসামি সাকিব, জাবেদ, পারভেজসহ অন্যদের মুঠোফোনে সংযোগ পাওয়া যাচ্ছে না। চাঞ্চল্যকর এ মামলার তদন্ত ও অপরাধী গ্রেপ্তার প্রক্রিয়া সম্পর্কে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের (সিএমপি) ডিসিডিবি (নর্থ) এম সালাম কবির বলেন, ‘মামলার ডকেট বুঝে পেয়েছি। বিধিবিধান অনুযায়ী তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) নিয়োগ দিয়ে তাকে আসামি গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

অফিস ও বাড়িতে দফায় দফায় হামলা, মামলা ও অপহরণের হুমকির অভিযোগ এনেছেন স্বামীহারা অসহায় এই নারী। অভিযোগে বলা হয়, ২০১৯ সালের ২৯ মে হুইপপুত্র শারুন চৌধুরী ও চিটাগাং চেম্বারের সাবেক দুই পরিচালক দুটি গাড়িতে করে ১০-১২ জন যুবককে সঙ্গে নিয়ে মোরশেদের বাসভবনে প্রবেশ করেন। পারভেজ ইকবাল দলের অন্যদের নিয়ে লিফট বেয়ে ওপরে উঠে বাসার দরজা ধাক্কাতে থাকেন। এ সময় দরজা খুলতে না চাইলে লাথি মারতে থাকেন তিনি। ‘লাথি মেরে দরজা ক্র্যাক করে দেওয়া হয়’ বলে জানান ব্যাংকারের স্ত্রী। এ সময় ভবনটির নিচে নেমপ্লেটবিহীন গাড়িতে হুইপপুত্র শারুন ও সাবেক ছাত্রনেতা আরসাদুল আলম বাচ্চু বসা ছিলেন বলেও জানান তিনি। আক্রমণের ভয়াবহতায় ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ব্যাংকার মোরশেদ তার স্ত্রী-সন্তানসহ পালিয়ে নিকটাত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন। সহযোগিতা চেয়ে দ্বারস্থ হন পুলিশের। থানায় জিডি করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাননি মোরশেদ। পরিবারটি এখনো চরম নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছে।

হয়রানি থেকে বাঁচতে সিএমপির ডিসি অফিসে শারুনদের সঙ্গে সমঝোতা বৈঠক ও চুক্তি হয় জানিয়ে ইশরাত বলেন, সেখানে বাচ্চুও ছিলেন। এ ঘটনার প্রায় দুই বছর পর দফায় দফায় আসল ও সুদ (মতান্তরে লভ্যাংশ) পরিশোধের পরও অতিরিক্ত টাকার জন্য টেলিফোনে চাপ প্রয়োগ করেন তারা। পারভেজ ও জাবেদের হয়ে কড়া ভাষায় ফোনালাপের এক দিন পরই ব্যাংক কর্মকর্তা মোরশেদ আত্মহত্যা করেন।

মোরশেদের স্ত্রী ইশরাত এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘মোরশেদের সঙ্গে সরাসরি লেনদেন না থাকলেও শারুন চৌধুরী, বাচ্চু ও কেন্দ্রীয় যুবলীগ নেতা রাসেল কেন এ রকম টর্চার করল, এর জবাব মিলছে না।’

অন্যদিকে ইশরাতের তথ্যের অভিন্নতা ও সত্যতা মেলে নিকটাত্মীয় এমপি দিদারুল আলমের বক্তব্যে। এমপি দিদারুল সমঝোতা করার চেষ্টা করেছিলেন। ‘কিন্তু শেষ পর্যন্ত জাবেদ ইকবালের ভাই পারভেজের অনাগ্রহে এমপি দিদারের সেই উদ্যোগ ভেস্তে যায়’ বলে জানান মোরশেদের স্ত্রী।

ব্যাংকার মোরশেদ চৌধুরীর সঙ্গে এই বিনিয়োগ, বাসায় হামলা, টাকা উদ্ধার প্রক্রিয়ায় সমঝোতা বৈঠকে শারুন-বাচ্চুর উপস্থিত থাকার তথ্য পাওয়া যায়। তবে নিজের সম্পৃক্ততার বিষয়টি অস্বীকার করেন বাচ্চু। -ঢাকাটাইমস