ইমাম খাইর, সিবিএন:
আদিবাসী জনগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সামাজিক আয়োজন “বৈসাবি উৎসব” বৈসু-সাংগ্রাই-বিঝু। প্রতি বছর মহাসমারোহে এই উৎসব পালিত হয়। করোনার থাবায় এবারসহ টানা দুইটি বছর ভাটা পড়েছে আদিবাসী সম্প্রদায়ের আনন্দের দিনটিতে।
করোনা বলে কি এক্কেবারে থেমে যাবে ধর্মীয় উৎসব? না। ছোট্ট পরিসরে হলেও বৈশাখ ঘিরে এই আয়োজন দেখা মেলে।
সোমবার (১২ এপ্রিল) ভোরে কক্সবাজার সাগরতটে বসে আদিবাসী তরুণ-তরুণীদের ফুল দেয়া নেয়ার আয়োজন। বালিয়াড়িতে বসিয়েছে তরতাজা জবা ফুল। বড় উৎসবে ছোট্ট আনন্দে মেতেছে তারা।
সোমবার ভোর ৬টা। তখনো ভোরের আলো তেমন ফোটে নি। শান্ত সাগর। প্রকৃতিতে বইছে হিমেল হাওয়া। ঠিক ওই সময়ে কক্সবাজার সৈকতের কবিতা চত্বর পয়েন্টে জমায়েত। কাছে গিয়ে দেখা গেল সবাই উপজাতি যুবক-যুবতি। যেখানে রয়েছে শিশু, সন্তানসহ দম্পতি।
সেখানে দেখা সোলেন চাকমার। তিনি কক্সবাজার বায়তুশ শরফ হাসপাতালের আইটি অফিসার। সঙ্গে ৫ বছর বয়সী ছেলে মহৎ চাকমা, মেয়ে অপসরা চাকমা, স্ত্রী কক্সবাজার মা ও শিশু কল্যাণকেন্দ্রের নার্স নিতা চাকমা।
সবার হাতে ফুল। গায়ে সজ্জিত নতুন জামাকাপড়।

বৈসাবি উৎসবে দুই হাতে ফুলসহ কক্সবাজার হলিচাইল্ড স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির অপসরা চাকমা।

৫ মাসের শিশু সন্তান ও স্ত্রীসহ দেখা মেলে শহরের বৈদ্যঘোনার মেচকো চাকমাসহ বেশ কিছু চেনা মুখের।
মিশন চাকমা ও ত্রয়া চাকমার মতো অনেক যুবক-যুবতির হাতে ফুলের পাপড়ি, গোলাপ আর জবা ফুলের মালা। ভোর সকালের মিষ্টি দৃশ্যটি চমৎকার দেখাচ্ছিল।
ওই সময় কথা হয় সোলেন চাকমার সঙ্গে।
তিনি বলেন, আমরা “বৈসাবি উৎসব” পালন করতে এসেছি। প্রতিবছর অনেক বড় আয়োজন থাকে। এ বছর করোনা ভাইরাসের কারণে বন্ধ। তবু সামান্য হলেও আনন্দ নেওয়ার চেষ্টা।
তিনি বলেন, আমাদের গ্রামের বাড়িতে খাগড়াছড়িতে বেশ আনন্দ করতাম। গত দুই বছর করোনার কারণে যেতে পারি না। কক্সবাজারেই স্বল্প আয়োজনে উৎসব পালন করি। এর মাঝেও আমরা আনন্দ ভোগ করি। অনেক প্রাণ পাই। পরস্পর বাড়ে সম্প্রীতি।
বাবা-মার সাথে উৎসবে যোগ দিতে সাগরপাড়ে আসে কক্সবাজার হলিচাইল্ড স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণির অপসরা চাকমা ও ৫ম শ্রেণির ত্রয়া চাকমা। তারাও বেশ মজা করেছে।

বৈসাবির ছবিতে সোলেন চাকমার সঙ্গে ছেলে মহৎ চাকমা, মেয়ে অপসরা চাকমা ও স্ত্রী নিতা চাকমা।

উল্লেখ করা যেতে পারে, বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার প্রধান ৩টি আদিবাসী সমাজের বর্ষবরণ উৎসব “বৈসাবি” উৎসব। বৈসাবী নামকরণও করা হয়েছে প্রথম অক্ষর তিনটি নিয়ে। … ‘বৈ’ শব্দটি ত্রিপুরাদের বৈসু থেকে, ‘সা’ শব্দটি মারমাদের সাংগ্রাই থেকে এবং ‘বি’ শব্দটি চাকমাদের বিজু থেকে।
বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় আদিবাসীরা। বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলি বৈসাবি নামে পরিচিত।
সাধারণত বাংলা বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।
এরই ধারাবাহিকতায় কক্সবাজারে অবস্থানরত আধিবাসী জনগোষ্ঠী চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা ও রাখাইন সম্প্রদায়ের উপস্থিতিতে পর্যটন নগরী সমুদ্র সৈকতে ফুল বাসানো হয়।
আগামী ১৩ এপ্রিল মূল বিঝু। মূল বিঝুতে প্রতিটি আধিবাসীদের ঘরে ঘরে ঐতিহ্যবাহী পাঁচন (২০-৩০ প্রকারের মিক্স সবজি) তরকারীসহ বিভিন্ন ধরনের খাবারের আয়োজন করা হয়। এতে ছোট বড় সব বয়সিরা কোন দাওয়াত ছাড়ায় প্রতিটি ঘরে ঘরে উৎসবমূখর পরিবেশে মুল বিঝুটি উদযাপন করে। এই বৎসর বিশ^ মহামারী করোনাভাইরাস এর কারণে সরকারের নির্দেশনা মতে সীমিত পরিসরে আয়োজন করা হয়েছে।

বাংলাপিডিয়ায় বৈসাবি:
বৈসাবি বাংলাদেশে তিন আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব। বৈসু, সাংগ্রাই, বিজু এই তিন নামের আদ্যাক্ষর নিয়ে বৈসাবি নামের উৎপত্তি। তারা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পুরনো বছরের কালিমা আর জীর্ণতাকে ধুয়ে নতুন বছরকে বরণ করে নেয় তারা। আদিবাসীরা বর্ষবরণ উৎসব পালন করে বিভিন্ন নামে। কেউ বৈসু, কেউ সাংগ্রাই আবার কেউ বিজু। বর্ষবরণ উৎসবকে ত্রিপুরারা বৈসু, মারমারা সাংগ্রাই ও চাকমারা বিজু বলে অভিহিত করে এবং এগুলি বৈসাবি নামে পরিচিত। সাধারণত বছরের শেষ দুইদিন এবং নতুন বছরের প্রথম দিন বর্ষবরণ উৎসব বৈসাবি পালিত হয় বান্দরবান, রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায়।
চাকমা, মারমা, ত্রিপুরাদের বৈসাবি উৎসব:
ত্রিপুরাদের বর্ষবরণ উৎসবের নাম বৈসু। বৈসু উৎসব এদের জীবনের সবচেয়ে বড় উৎসব। বৈসু উৎসব একটানা তিন দিন পালন করা হয়। এই তিন দিনের অনুষ্ঠানগুলির নাম হলো হারি বৈসু, বিসুমা বৈসু ও বিসিকাতাল বা আতাদাং বৈসু। বৈসু উৎসবের প্রথম দিন হারি বৈসু। এই দিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে তারা ঘরদোর লেপেপোঁছে, বসতবাড়ি কাপড়চোপড় পরিস্কারপরিচ্ছন্ন করে। ত্রিপুরারা বিশেষ একপ্রকার গাছের পাতার রস আর হলুদের রস মিশিয়ে গোসল করে। ফুল দিয়ে ঘরবাড়ি সাজায়। গবাদিপশুদের গোসল করানো হয় এবং ফুল দিয়ে সাজানো হয়। শিশুরা বাড়ি বাড়ি ফুল বিতরণ করে। তরুণতরুণীরা প্রিয়জনকে ফুল উপহার দেয়। দেবতার নামে নদীতে বা ঝর্ণায় ফুল ছিটিয়ে খুমকামীং পূজা দেওয়া হয়। কেউ কেউ পুষ্পপূজা করে। এদিন মহিলারা বিন্নি চাউলের পিঠা ও চোলাই মদ তৈরি করে। পুরুষেরা বাঁশ ও বেত শিল্পের প্রতিযোগিতা ও খেলাধুলায় মেতে উঠে। এদিন এরা দাং, গুদু, চুর, সুকুই, উদেং ও ওয়াকারাই খেলায় অংশগ্রহণ করে। জুম কৃষক পাড়ার মধ্যে হাঁসমুরগির জন্য শস্যদানা ছিটিয়ে দেয়। হারি বৈসু উৎসবের দিন থেকে এরা গরয়া নৃত্য পরিবেশন শুরু করে। এ নৃত্য সাত দিন থেকে আটাশ দিন পর্যন্ত চলে। ঢোলের তালে তালে সারিবদ্ধভাবে লোকজন নাচে। নাচ শেষে গরয়া পূজার ব্যবস্থা করা হয়।
উৎসবের দ্বিতীয় দিন বিসুমাতে ত্রিপুরারা নববর্ষকে স্বাগত জানায়, ধূপ, চন্দন ও প্রদীপ জ্বেলে পূজা দেয় ও উপাসনা করে। সবাই গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুর বেড়ায়। বাড়ি বাড়ি গিয়ে পাচন, সেমাই ও মিষ্টি খায় এবং কলাপিঠা, চুয়ান পিঠা, জাল পিঠা, উন পিঠা ও মায়ুং পিঠা খায়। এছাড়া এদিন তারা নিরামিষ ভোজন করে। কোনো প্রাণি বধ করে না। অনুষ্ঠানের তৃতীয় দিন বিসিকাতালে আমিষ খাবার গ্রহণে বাধা নেই। এদিনও ফুল দেওয়া হয় ও উপাসনা করা হয়। তারা বয়োজ্যেষ্ঠদের গোসল করিয়ে পায়ের কাছে পূজার নৈবেদ্য হিসেবে ফুল রাখে এবং প্রণাম করে। কেউ কিছু না খেয়ে ফিরে না যায় সেজন্য সারাদিন ঘরের দরজা খোলা থাকে। এতে গৃহস্থের কল্যাণ হবে বলে মনে করা হয়।
মারমারা পুরাতন বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে বরণ করার উৎসবকে সাংগ্রাই উৎসব বলে। তারা বৈশাখের প্রথম দিনে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে পালন করে বাংলা নববর্ষ। পাচন, পিঠা এবং নানা মুখরোচক খাবারের আয়োজন করে মারমা জনগোষ্ঠী। সবাই নতুন পোশাক পরে, একে অপরের বাড়ি যায় এবং কুশল বিনিময় করে। সববয়সের নারীপুরুষ সম্মিলিতভাবে নাচ আর গানে মেতে উঠে। মারমা বৃদ্ধরা অষ্টশীল পালনের জন্য মন্দিরে যায়। এদিন বুদ্ধ মূর্তিকে চন্দন জলে স্নান করানোর পর বৃদ্ধবৃদ্ধারাও স্নান করে এবং নতুন পোশাক পরিধান করে। বয়স্করা মন্দিরে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়। মারমা জনগোষ্ঠীর এ দিনের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে জল অনুষ্ঠান বা পানি খেলা। মারমা ভাষায় জল অনুষ্ঠানকে বলা হয় রিলংপোয়ে। বাড়ির আঙিনায় আগে থেকে পানি খেলার জন্য প্যান্ডেল তৈরি করা থাকে। মারমা যুবকরা বাদ্য আর গানের তালে তালে এসে উপস্থিত হয় অনুষ্ঠানস্থলে। সেখানে ফুলে ফুলে সজ্জিত প্যান্ডেলের ভিতরে পানি নিয়ে অপেক্ষায় থাকে মারমা তরুণীরা। চলে যুবকযুবতীদের এক অপরের প্রতি জল ছিটানো। পানিকে পবিত্রতার প্রতীক ধরে নিয়ে মারমা তরুণতরুণীরা পানি ছিটিয়ে নিজেদের শুদ্ধ করে নেয়।
চাকমাদের বর্ষবরণ উৎসব হলো বিজু। এরা তিন ভাগে ভাগ করে বিজু উৎসব পালন করে। চৈত্র মাসের ২৯ তারিখে ফুল বিজু, ৩০ তারিখে মূল বিজু এবং বৈশাখের প্রথম দিনে গজ্যাপজ্যা বিজু নামে অনুষ্ঠান পালন করে। ফুল বিজুর দিন গভীর অরণ্য থেকে ফুল সংগ্রহ করে চারভাগে ভাগ করে একভাগ ফুল ও নিমপাতায় ঘরবাড়ি সাজায়, দ্বিতীয়ভাগ ফুল বৌদ্ধ বিহারে বুদ্ধের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে প্রার্থনা করে ও ভিক্ষুসংঘ কর্তক প্রদত্ত ধর্মোপদেশ শ্রবণ করে, তৃতীয়ভাগ ফুল নদী, খাল বা পুকুরের পাড়ে তৈরি পূজামন্ডপে রেখে প্রার্থনা করে এবং চতুর্থভাগ ফুল প্রিয়জনকে উপহার দেয় এবং বয়োজ্যেষ্ঠদের ফুলেল শুভেচ্ছা জানায়। মূল বিজুর দিনে অসংখ্য কাঁচা তরকারি সংমিশ্রণে পাচন বা ঘণ্ট তৈরি করা হয়। এছাড়া পায়েস ও নানা ধরনের পিঠা তৈরি করা হয় এবং মাছ-মাংস রান্না করা হয়। বিন্নি ধানের খই, নাড়ু, সেমাই ও পাহাড়ি মদও থাকে। এই দিনে চাকমারা ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে র‌্যালিতে যোগ দেয়, অবালবৃদ্ধবনিতা পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়ায় এবং শিশুকিশোর তরুণতরুণীরা খেলাধুলায় মেতে উঠে। সন্ধা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বাড়িঘর, উঠান ও গোশালায় প্রদীপ জ্বালিয়ে সবার মঙ্গল কামনা করা হয়। মন্দিরে গিয়ে মোম জ্বালিয়ে ফুল দিয়ে বুদ্ধের পূজা করা হয়।
গজ্যাপজ্যা অনুষ্ঠিত হয় নববর্ষের প্রথম দিনে। এদিন চাকমারা বিছানায় গড়াগড়ি দিয়ে বিশ্রাম করে। তারা বড়দের স্নান করিয়ে দিয়ে আশীর্বাদ প্রার্থনা করে। সন্ধ্যায় সবাই বৌদ্ধবিহারে গিয়ে ধর্ম অনুশীলনে রত হয়, ভিক্ষু সংঘের ধর্মোপদেশ শুনে এবং বিশেষভাবে প্রার্থনায় অংশগ্রহণ করে।