বাংলা ট্রিবিউন:

মিয়ানমার সীমান্তবর্তী টেকনাফ বলতে গেলে ইয়াবা পাচারকারীদের কাছে স্বর্গরাজ্য। দীর্ঘদিনের চেষ্টায়ও এই অঞ্চলের জমজমাট ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কেন্দ্র করেও এই মাদক পাচার চলছে। সম্প্রতি নোয়াখালীর ভাসানচর দ্বীপে স্থানান্তর করা রোহিঙ্গাদের কাছ থেকেও পাওয়া গেছে ইয়াবা। ফলে প্রাণঘাতী এই মাদক পাচারের গতিপথ ও বিস্তৃতি নিয়ে শঙ্কা আরও বাড়লো। তবে পুলিশের দাবি, কক্সবাজার থেকে নোয়াখালীর ওই দ্বীপে যাওয়ার সময়ই শরণার্থীরা সেখানে এই মাদক নিয়ে গেছেন।

ভাসানচর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ মাহে আলম জানান, গত ১৯ জানুয়ারি থানাটি উদ্বোধনের পর থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২৩৩ পিস ইয়াবাসহ চার রোহিঙ্গাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা দিয়ে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

তিনি জানান, সর্বশেষ গত বুধবার (৭ এপ্রিল) ৬০৩ পিস ইয়াবাসহ নুর মোহাম্মদ নামের এক রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। এর আগে ৬৩০ পিস ইয়াবাসহ তিন জনকে আটক করে পুলিশ। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানিয়েছে, কক্সবাজারের শরণার্থী শিবির থেকে ভাসানচরে আসার সময় নিজেদের জিনিসপত্রের মধ্যে করে এসব ইয়াবা নিয়ে এসেছিল তারা।

কক্সবাজারের শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ডিসেম্বর থেকে ছয় দফায় মোট ১৭ হাজার ৯৯৫ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে গেছে সরকার। এর আগে গত বছরের মে মাসে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করা ৩০৬ রোহিঙ্গাকে সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে সেখানে নিয়ে রাখা হয়েছিল। সব মিলে এখন দ্বীপটিতে রয়েছেন ১৮ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা।

ভাসানচরে ইয়াবা পৌঁছে যাওয়া দুশ্চিন্তার

কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরগুলোতে সহিংসতার অন্যতম কারণ ছিল ইয়াবা ব্যবসা- এমনটা দাবি করে ভাসানচরের রোহিঙ্গা নেতা নুরুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, ‘সেখানকার পরিস্থিতি খুবই খারাপ ছিল। ভেবেছিলাম ভাসানচরে এসে অন্তত শান্তিতে থাকা যাবে। কিন্তু এখানেও ইয়াবা পৌঁছে যাওয়াটা আমাদের জন্য দুশ্চিন্তার বিষয়।’

ভাসানচরেও মাদক ব্যবসা শুরু হলে অশান্তি নেমে আসবে মন্তব্য করেন টেকনাফের লেদা ডেভলমেন্ট কমিটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আলম। তিনি বলেন, ‘যারা সেখানে মাদক ব্যবসা চালুর চেষ্টা করছে তাদের চিহ্নিত করে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি। বিশেষ করে রোহিঙ্গাদের দ্বীপে নেওয়ার সময় তাদের মালপত্রের ব্যাগগুলো কঠোরভাবে তল্লাশি না করায় তারা মাদক বহনের সুযোগ পাচ্ছে।’

কক্সবাজারের শিবিরগুলো থেকে ভাসানচরগামী রোহিঙ্গাদের প্রথমে উখিয়ার ট্রানজিট ক্যাম্পে এনে রাখা হয়। সেখান থেকে তাদের চট্টগ্রামে জাহাজ পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ পাহারায়। তবে ওই সময় কাউকে তল্লাশি করা হয় না বলে জানান আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন-৮ (এপিবিএন) এর অধিনায়ক শিহাব কায়সার খান। তিনি বলেন, ‘উখিয়া ট্রানজিট পয়েন্ট থেকে জাহাজ পর্যন্ত তাদের নিরাপদে পৌঁছানোর দায়িত্ব পালন করি আমরা। এর আগে অন্যান্য বাহিনী তাদের দেখভাল করে।’

তবে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দৌজা জানান, ক্যাম্প থেকে বের হওয়ার সময় রোহিঙ্গাদের দেখভালের বিষয়ে তাদের কর্মকর্তারা দায়িত্ব পালন করেন। এর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।

বিশ্লেষকদের মতে, বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ার কারণে ভাসানচরকে কেন্দ্র করে নতুন কোনও মাদকের রুট তৈরি হওয়া কঠিন হলেও সেই আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘কক্সবাজারে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মাদক ব্যবসার সম্পর্কটা সর্বজনবিদিত। সেখান থেকে যারা ভাসানচরে গিয়েছে, তাদের মধ্যে কেউ কেউ হয়ত সেই চক্রের সঙ্গে যুক্ত ছিল।’

গত কয়েক দশক ধরে মাদক ব্যবসাই কর্মক্ষম রোহিঙ্গাদের মূল পেশা মন্তব্য করেন জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ড. অরূপ রতন চৌধুরী। তিনি মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থার (মানস) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি বলেন, ‘তাদের ইয়াবা ব্যবসার যে নেটওয়ার্ক আছে, তা ভাসানচরের চেয়ে বিচ্ছিন্ন এলাকায় নিয়ে গেলেও তারা বিস্তৃত করার চেষ্টা করবে। যতদিন পর্যন্ত তারা এখান থেকে মিয়ানমারে ফেরত না যাবে, ততদিন এখানে এটা বন্ধ করা যাবে না।’ ।

ভাসানচর ছাড়ার চেষ্টা

অবৈধভাবে সাগরপথে মালয়েশিয়া যেতে ব্যর্থ হয়ে গত বছরের মে মাসে বাংলাদেশে ফিরে আসেন ৩০৬ জন রোহিঙ্গা। তাদের সমুদ্র থেকে উদ্ধার করে ভাসানচর নিয়ে যায় সরকার। এদের মধ্যে ৯ রোহিঙ্গাকে ভাসানচর থেকে পালানোর চেষ্টাকালে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভাসানচরের ওসি মাহে আলম। তিনি বলেন, ‘তারা দলগতভাবে পালানোর পরিকল্পনা করেছিল। কিন্তু আমরা সেটা ব্যর্থ করে দিয়েছি।’

ওসি আরও জানান, এর আগে বহুবার কক্সবাজারের শিবিরে স্বজনদের কাছে ফেরার দাবি জানিয়েছিল ওই ৩০৬ শরণার্থী। সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়টি বিবেচনার কথা বলা হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি।

উল্লেখ্য, ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন। আগের ও তখনকার মিলিয়ে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা কক্সবাজারে বসবাস করছেন। ওই বছরের নভেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। বর্তমানে ধাপে ধাপে স্থানান্তরের কাজ চলছে।