সিবিএন ডেস্ক: রাজধানীর বাইতুল মোকাররম মসজিদ এলাকায় পুলিশ, সরকার সমর্থক নেতাকর্মী ও মুসল্লিদের মধ্যে ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়েছে। শুক্রবার দুপুর দেড়টা থেকে থেমে থেমে এ সংঘর্ষ চলে বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত। এ ঘটনায় অন্তত ৬০ জন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন।
জুমার নামাজের পর এই সংঘর্ষের সূত্রপাত। নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই কয়েকজন মুসল্লি ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ বলে স্লোগান দেওয়া শুরু করেন। এভাবে দেড় মিনিট তারা স্লোগান দেন। এরপর ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীরা মুসল্লিদের ওপর হামলা করেন। এরপরই মোকাররম থেকে মুসল্লিরা বের হয়ে পাল্টাপাল্টি আক্রমণে যান। চলতে থাকে সংঘর্ষ।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ তাদের ছত্রভঙ্গ করতে রাবার বুলেট ছুড়তে শুরু করে। এরপরই সংঘর্ষ চূড়ান্ত রূপ নেয়। দফায় দফায় বাইতুল মোকাররমের ভেতর থেকে ইট-পাটকেল ছুড়তে থাকেন মুসল্লিরা। পাল্টা আক্রমণ হিসেবে মসজিদের উত্তর ও দক্ষিণ গেটে থাকা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ইটপাটকেল ছুড়তে থাকেন। একই সময়ে পুলিশও মুসল্লিদের দিকে রাবার বুলেট ছুড়তে থাকে। এভাবে থেমে থেমে বিকেল পৌনে ৪টা পর্যন্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটতে থাকে।
ত্রিমুখী এই সংঘর্ষের মধ্যে কয়েকজনকে দুইটি মোটরসাইকেলে আগুন ধরিয়ে দিতে দেখা গেছে। এই দুটি মোটরসাইকেলের একটির মালিক সেলিম আজাদ। তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলছিলেন, ‘আমি উত্তর গেটের সামনে মোটরসাইকেল রেখে নামাজ পড়তে ঢুকেছিলাম। পরে দেখি আমার হাং মোটরসাইকেলটি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গাড়ির নেমপ্লেট নম্বর-৩৪৫১৭২।’
বিকেল সাড়ে ৩টা, তখন কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বলতে শোনা যায়, ‘মুসল্লিদের নিরাপদে বের করে দেওয়া উচিত’। কারণ, বাইতুল মোকাররমের ভেতরে তখন অনেক সাধারণ মুসল্লি ছিলেন, যারা সামাজ পড়ার জন্যই ভেতরে ঢুকেছিলেন। সংঘর্ষের ঘটনার পর তারা আর বের হতে পারেননি। এরপর কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা উত্তর গেটে পাশে গিয়ে মুসল্লিদের আহ্বান জানান, ‘আপনারা বের হয়ে আসেন, আপনারা নিরাপদে যার যার বাসায় চলে যান।’ কিন্তু মুসল্লিরা পুলিশের কথায় আস্থা রাখতে না পেরে, তখনও দুই-একবার ইট-পাটকেল ছোড়েন।
বিকেল পৌনে ৪টার দিকে ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের লোকজন ইট-পাটকেল ছোড়া বন্ধ করেন। এর ১৫ মিনিট আগে থেকে পুলিশও রাবার বুলেট ছোড়া বন্ধ করে। পৌনে ৪টার পর কিছু মুসল্লি এসে উত্তর গেটে পুলিশের সঙ্গে কথা বলেন। তারপর থেকে আর কোনো ধরনের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেনি। এভাবে আলোচনা-সমালোচনার পর সন্ধ্যার আগে আগে মুসল্লিরা মসজিদ ত্যাগ করেন।
ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ, মুসল্লি, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা জানিয়েছেন, সরকারের তিন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা সকালের পর থেকেই বাইতুল মোকাররমের চারপাশে অবস্থান নেন। জুমার নামাজ শুরুর আগে, অর্থাৎ দুপুর ১টার দিকে সরকার দলীয় অন্তত ২০০ সমর্থক মসজিদের উত্তর গেটে হাজির হন। সে সময় কয়েকজন মুসল্লির সঙ্গে তাদের বাকবিতণ্ডাও হয়।
মুসল্লিদের অভিযোগ, সে সময় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের কর্মীরা মুসল্লিদের বলেন, ‘নামাজ পড়ার জন্য পাড়ার মসজিদ নেই? এখানেই কেন নামাজ পড়তে হবে?’ সে সময় কয়েকজন মুসল্লিকে বের করে দেওয়ারও অভিযোগ করেন মুসল্লিরা। তাদের বক্তব্যের রেকর্ড এই প্রতিবেদকের কাছে রয়েছে।
তবে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ সেই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। ছাত্রলীগ কর্মী নামজুল হুদা বলেন, ‘নামাজের পর মুসল্লিরা মোদি বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। তারপরই পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটে। এতে আমাদের কয়েকজন আহত হয়েছে।’
সে সময় বাইতুল মোকাররমের উত্তর গেটে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) এনামুল হক মিঠু। মিঠু বলেন, “নামাজ শেষ হওয়ার পরপরই মুসল্লিরা ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন। এভাবে তারা দেড় মিনিটের মতো স্লোগান দেন। সে সময় সেখানে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ৪০০ থেকে ৫০০ জন নেতাকর্মী ছিলেন। মুসল্লিরা মোদি বিরোধী স্লোগান দিতেই সেখানে দাঁড়িয়েছিলেন বলে আমরা জেনেছি। তবে ‘নারায়ে তাকবির, আল্লাহু আকবার’ বলার পরে আর কিছু বলার সুযোগ পায়নি। তার আগেই সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে উভয় পক্ষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে আমরা কাঁদানে গ্যাসের শেল ছুড়তে শুরু করি। এরপর আমাদের ওপরও হামলা করা হয়। পরে আমরা রাবার বুলেট ছুড়ি। দুপুরের আগে থেকেই আমরা সতর্ক অবস্থায় ছিলাম। সে সময় দেখেছি, সরকার সমর্থকেরা বাইতুল মোকাররমের চারপাশে অবস্থান নিয়েছিলেন।’
পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা শেষ হলে বাইতুল মোকাররম মসজিদের ভেতরে ঢুকে দেখা যায়, শতশত মুসল্লি শুয়ে বা বসে আসেন। সবাইকে আতঙ্কগ্রস্ত মনে হচ্ছিল। আর ভেতরে অন্তত ১০ জন মুসল্লিকে দেখা গেছে, যারা রক্তাক্ত অবস্থায় শুয়ে ছিলেন। ইট-পাটকেল আর রাবার বুলেটের আঘাতে তারা রক্তাক্ত হন। তাদের ভেতরে হামলার শিকার একজনের নাম আবুল। তিনি বলেন, ‘আমি এসেছিলাম নামাজ পড়তে। অনেক সময় বসে বসে বের হতে যাব, এমন সময় আমার শরীরে ইটের খোয়া এসে লাগে। আমি গুরুতর আহত। এখন হাসপাতালেও যেতে পারছি না।’
পাশে সামাদ নামের এক মুসল্লি রাবার বুলেটের আঘাতে রক্তাক্ত হয়ে পড়ে ছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমার শরীরে গুলি (রাবার বুলেট) লেগেছে।’
সংঘর্ষের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মোট ৬০ জনের বেশি প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। ঢামেক পুলিশ ক্যাম্পের দায়িত্বরত পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া বলেন, ‘সন্ধ্যা পর্যন্ত মোট ৬০ জন লোক এসে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়েছেন। চিকিৎসা শেষে তারা চলেও গেছেন। এখন আর কেউ হাসপাতালে ভর্তি নেই।
সন্ধ্যার আগে আগে বাইতুল মোকাররমে আটকে পড়া মুসল্লিদের নিরাপদে বের করে দেয় পুলিশ। এ ব্যাপারে ডিএমপির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) সৈয়দ নুরুল ইসলাম বলেন, ‘সন্ধার আগে আগে আমরা মুসল্লিদের নিরাপদে উত্তর ও পূর্ব গেট দিয়ে বের করে দিয়েছি। এ ঘটনায় এখনও কাউকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়নি।’
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।