মোহাম্মদ ইলিয়াছ

সহ: অধ্যাপক, গণিত বিভাগ
আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ ,লোহাগাড়া, লোহাগাড়া

গণিত শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ হল Mathematics। গণিতের এই ইংরেজি শব্দটির উৎপত্তি নিয়ে বহু মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেছেন “ Mathematik” হতে। কেউ বলেছেন ফরাসী শব্দ “ Mathematique” হতে। কেউ বলেছেন ল্যাটিন শব্দ “Mathematica” থেকে। আবার কেউ বলেছেন গ্রীক শব্দ “Mathematike” থেকে। তবে অধিকাংশই মনে করেন গ্রীক শব্দ “ Mathema” হতে Mathematics শব্দের উৎপত্তি। Mathema শব্দের অর্থ হল জ্ঞান, নিরীক্ষণ ও শিখন। আর বাংলা অর্থ হচ্ছে গণিত। Canada-য় সংক্ষেপে Math ব্রিটেন ও কমনওয়েলথভূক্ত দেশসমূহে Maths রুপে ব্যবহ্নত হয়।
গণিত শব্দটি এসেছে “গণনা” শব্দ থেকে। বাংলায় “গণ” ধাতুর সাথে “ইত” প্রত্যয় যোগে গণিত শব্দটি গঠিত হয়েছে। তাই সহজেই বলা যায় গণিত হল গণনাশাস্ত্র। গণিত বলতে বুঝি পরিমাণ, সংগঠন, স্থান ও পরিবর্তনের গবেষণাভিত্তিক বিশেষ ধরণের জ্ঞান। Oxford Dictionary এর মতে গণিত হল স্থান, সংখ্যা ও পরিমাপ সম্পর্কিত বিজ্ঞান ((Mathematics is the science of space, numbers and quantity.)। যে বিজ্ঞান বিমূর্ত চিন্তনে সাহায্য কওে তাই হল গণিত। প্রয়োজনীয় ও নির্ভুল সিদ্ধান্তে উপনীত হতে সাহায্য করে যে বিজ্ঞান তা হল গণিত। বিভিন্ন জন বিভিন্নভাবে গণিতের সংজ্ঞা দিয়েছেন। Aristotle এর মতে, Mathematics is the science of quantity. Eugene Winger এর মতে, Mathematics is the science of skilful operation with concepts and rules just for the skilful operation বেজ্ঞামিন পিয়ার্সের মতে, যে বিজ্ঞান প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত পৌঁছতে সাহায্য করে তা হল গণিত। রজার বেকনের মতে, গণিত হল সকল বিজ্ঞানের প্রবেশদ্বার ও চাবিকাঠি (Mathematics is the gae and key to all science.)। Lindsayএর মতে, মানুষের মনে চিন্তাশক্তি স্থায়ী করার অভ্যাস গড়ে তোলার পদ্ধতিই হল গণিত। গ্যালিলিও গ্যালিলি এর মতে গণিত হচ্ছে বিশেষ একটি ভাষা, যে ভাষার ঈশ্বা মহাবিশ্বকে লিখেছেন (Mathematics is the language with which God has written the universe.)। আলবার্ট আইনস্টাইন এর মতে, গণিতে আপনার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করবেন না। নিশ্চিত থাকুন আমার সমস্যা আরও বেশি (Do not worry about your difficulties in mathematics. I can assure you mine are still greater.)। উইকিপিডিয়ার মতে, পরিমান (Quantity), গঠন (Structure), পরিবর্তন (Change) ও স্থান (Space) বিষয়ক গবেষণাকে সাধারণ গণিত বলা হয়। কারও কারও মতে, গণিত হল চিত্র ও সংখ্যার গবেষণা। গণিত হল বিভিন্ন ধরণের বিমূর্ত মানসিক খেলা।
আর গণিতবিদদেও কাজ হল এই খেলার নিয়মগুলো বের করা।তবে গণিতের আধুনিক ও গ্রহণযোগ্য সংজ্ঞা হচ্ছে সংখ্যা, প্রতীক, বিভিনন্ন মাত্রিক আকার, বিমূর্ত ধারণা, অবকাঠামো ও তাদেও পারষ্পরিক সম্পর্ক, গতি এবং কালের বিজ্ঞানই হল গণিত।
গণিতে সংখ্যা ও অন্যান্য পরিমাপযোগ্য রাশিসমূহের মধ্যকার সম্পর্ক বর্ণনা করা হয়। এজন্য বলা হয়ে থাকে গণিত বিজ্ঞানের ভাষা। অন্যদিকে গণিত হল চিত্র সংখ্যার গবেষণা। গণিত হল যুক্তি বিজ্ঞান। গণিত বাস্তব জিনিষের গবেষণা। গণিতের ব্যবহার রয়েছে বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায়। এজন্য গণিতকে ডাকা হয় বিজ্ঞানের ভাষা ও সমস্ত বিজ্ঞানের রাণী। একজন বাঙালী গণিতবিদ মীজান রহমান বলেছেন, গণিত হল প্রকৃতির ব্যাকরণ।
১৭শ শতক পর্যন্ত গণিতশাস্ত্রকে পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি হিসেবে গণ্য করা হত। আধুনিক যুগে গণিতের গোড়াপত্তন প্রাচীন গ্রীকরা। পরে এগুলো মুসলমান পন্ডিতরা সংরক্ষণ করেন। মধ্যযুগে খ্রিষ্টান পুরোহিতরা এগুলো ধরে রাখেন। প্রাচীনকাল থেকে মিশর, ব্যাবিলন, মেসোপটেমিয়া,চীন প্রভৃতি দেশে গণিতের অনুশীলন হত। প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার ব্যাবিলনীয়রা ও নীল নদেও অববাহিকায় প্রাচীন মিশরীয়রা সুশৃঙ্খল গণিতের প্রাচীনতম নিদর্শন রেখে গেছেন। তাদের গণিতে প্রাধান্য ছিল পাটিগণিতের। ব্যাবিলনীয়দেও সংখ্যা ব্যবস্থা ছিল ৬০ ভিত্তিক। তারা একেক দিনকে ২৪ ঘন্টায়, প্রতি ঘন্টাকে ৬০ মিনিট ও প্রতি মিনিটকে ৬০ সেকেন্ডে ভাগ করে। তারা খ্রিষ্টপূর্ব ৭০০ অব্দে এসে গণিত ব্যবহার কওে চাঁদ ও গ্রহসমুহের গতি নিয়ে গবেষণা করে। অপরদিকে মিশরীয়দের সংখ্যা ব্যবস্থা ছিল ১০ ভিত্তিক। তারা ১ এর প্রতীক পাঁচবার লিখে ৫, ১০ এর প্রতীক ৬ বার লিখে ৬০ নির্দেশ করত। এখানে বুঝা যাচ্ছে যে, ব্যাবিলনীয় এবং মিশরীয়রা গণিতে সংখ্যা প্রতীক ব্যবহার করত। গণিতে অংক হল সংখ্যা প্রকাশক চিহ্ন। সংখ্যা গঠনের জন্য সেব প্রতীক ব্যবহার করা হয় তাকে অংক বলা হয়। যেমন:১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯,০। এই ১০টি প্রতীককে বলা হয় সংখ্যা প্রতীক। পরিমান বিষয়ক গবেষণার ভিত্তি হচ্ছে সংখ্যা। ১০টি অংকসহ আরও কতকগুলো চিহ্নের সাহায্যে যা তৈরী হয় তাকে সংখ্যা বলে।পীথাগোরাস ও তাঁর অনুসারীদেও মতে বিশ্ব অস্তিত্বের মূল হচ্ছে সংখ্যা। অংক দুই প্রকার- স্বার্থত অংক ও সহকারী অংক। ১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ হল স্বার্থক অংক। আর ০ হল সহকারী অংক। একটি অংকে দুই ধরণের মান থাকে। নিজস্ব মান ও স্থানীয় মান।
গণিতের প্রধান শাখা হল পাটিগণিত, বীজগণিত ও জ্যামিতি।
পাটিগণিত: পাটিগণিত হচ্ছে গণিতের পুরাতন একটি শাখা।পাটিগণিত ইংরেজি Arithmatic শব্দটি গ্রীক শব্দ Arithmos থেকে এসেছে। Arithmos অর্থ সংখ্যা। বিভিন্ন গাণিতিক প্রক্রিয়া বা অপারেশনে আলোচিত হয় পাটিগণিত। গণিতের যে শাখায় সংখ্যা ও সংখ্যার যোগ, বিয়োগ,গুণ ও ভাগ ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে পাটিগণিত বলে। গণিতের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান যোগ,বিয়োগ,গুণ ও ভাগের মাধ্যমে করা হয়। যোগ, বিয়োগ, গুণ ও ভাগকে বলা হয়ে থাকে পাটিগণিতের মৌলিক অপারেশন। এগুলোকে প্রক্রিয়া প্রতীকও বলা হয়। জীবনের প্রায় সকল কাজে লাগে এই গণিত। যৌক্তিক চিন্তা করতে শিক্ষা দেয় এই গণিত। ভারতীয় গণিতবিদ ও জ্যোর্তিবিদ আর্যভট্টকে (৪৭৬-৫৫০ খ্রি:) পাটিগণিতের জনক বলা হয়। মিশরীয় ও ব্যাবিলনীয় প্রাচীন সভ্যতা পাটিগণিতের উন্নতিতে কাজ করছে।
বীজগণিত: প্রাচীন মিশর, ভারত ও গ্রীক সভ্যতায় বীজগণিতের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে চিন্তা করার ইতিহাস পাওয়া যায়। বীজগণিতের ইংরেজি অষমবনৎধ শব্দটি এসেছে আরবী আলজাবের শব্দ থেকে। যার অর্থ ভাঙা হাড় জোড়া দেয়া। গণিতের যে শাখায় গাণিতিক সমীকরণের অজানা রাশি প্রতীকের সাহায্যে প্রকাশ করা হয় তাকে বীজগণিত বলে। ১৯ শতকের শুরুতে বীজগণিত আধুনিক যুগে প্রবেশ করে। আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতবিদ ডায়াফোন্টাস বীজগণিতের নীতিসমূহ উদ্ভাবন করেন। আর পারস্য গণিতবিদ আবু আবদুল্লাহ মো: ইবনে মুসা আল খারেজমি বীজগণিতকে জনপ্রিয় করার ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। তিনি ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, ভূগোলবিদ ও জ্যোর্তিবিদ। বীজগণিতেই তিনি গণিতশাস্ত্রেও মধ্যে বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন হিসাব সৃষ্টি করেন এবং দৃষ্টি আকর্ষণ করেন সকলের প্রতি। গ্রীক গণিতবিদ ডায়াফোন্টাস বীজগণিত নিয়ে খুব একটা অগ্রসর হতে পারেনি তখন বীজগণিতের হাল ধরেন খারেজমি। ভারতীয়রা প্রথম বীজহণিত নিয়ে গবেষণা করেন। খ্রিষ্টীয় ৬ষ্ট শতাব্দীতে ভারতীয় গণিতবিদদের উদ্ভাবিত দশমিক পদ্ধতি খারেজমি প্রথম ইসলামী জগতে নিয়ে আসেন। তাঁর রচিত আল জাবর ওয়াল মুকাবলা বইটিতে তিনি বীজগণিত নিয়ে আলোচনা করেছেন। এই বই থেকেই বীজগণিতের ইংরেজি নাম অ্যালজেবরা উৎপত্তি হয়েছে। অষমড়ৎরঃযস শব্দটি অষশযধিৎরুসর নামের ল্যাটিন শব্দ অষমড়ৎরংসর হতে উৎপত্তি। গণিতে শূন্যের ব্যবহার, ভগ্নাংশ পদ্ধতি, ত্রিকোণমিতি, জ্যামিতি, ভূগোল ও জ্যোর্তিবিজ্ঞানে তাঁর অবদান রয়েছে। এজন্য খারেজমিকে বীজগণিতের জনক বলা হয়। বীজগণিত প্রাত্যহিক জীবনের নানা গণনায় বীজগণিত কাজে লাগে। বীজগণিতে পাটিগণিতের মৌলিক অপারেশনগুলো ও নির্দিষ্ট সংখ্যা ব্যবহার না করেই সম্পাদন করা যায়।
জ্যামিতি: জ্যামিতিকে বলা হয়ে থাকে স্থান বা জগতের বিজ্ঞান হিসেবে। প্রাচীন জ্যামিতিকিদরা ভূমির ক্ষেত্রফল ও ঘরবাড়ি নির্মাণের সময় সঠিকভাবে সমকোণ নির্ণয়ের

সমস্যা নিয়ে চিন্তা করতেন। মিশর হল নীলনদেও দান। আফ্রিকার ১০টি দেশের উপর দিয়ে নীলনদ প্রবাহিত হয়েছে। প্রাচীন মিশরে প্রতি বছর নীল নদেও বন্যায় নষ্ট হয়ে যেত জমির
সীমানা। জমির সীমানা নিয়ে জমির মালিকদের মধ্যে ঝগড়া হত। এই সীমানা পুনরুদ্ধারে জ্যামিতির সাহায্য নেয়া হত। প্রাচীন মিশরে জ্যামিতির উদ্ভব হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। শুধু তা নয় মিশরীয়দের পিরামিড তৈরীর কলাকৌশল জ্যামিতি থেকে হয়েছিল।
জ্যামিতির ইংরেজি Geometry এসেছে জিও ও মেট্রিয়া শব্দ থেকে। জিও অর্থ পৃথিবী বা ভূমি। মেট্রিয়া অর্থ পরিমাপ। গণিতের যে শাখায় ভূমির পরিমাপ নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে জ্যামিতি বলে। খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার অব্দ থেকে Mesopotamia ( বর্তমান ইরাক),Egypt ( বর্তমান মিশর) এবং সিন্ধু উপত্যকায় জ্যামিতি ব্যবহার হতো বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। প্রাচীন মিশরীয়রা তাদের গ্রীক গণিতবিদ ইউক্লিড ৩০০ খ্রিষ্টপূর্বে জ্যামিতির ধারণা বিন্যস্ত কওে বৈজ্ঞানিক কাঠামোয় রুপান্তরিত করেন। এ কারণে তাকে জ্যামিতির জনক বলা হয়। ইউক্লিড জ্যামিতিতে রেখা একটি মৌলিক ধারণা। ইউক্লিড প্রথমে রেখাকে সংজ্ঞায়িত করেন প্রস্থহীন দৈর্ঘ্য হিসেবে। সপ্তদশ শতকের প্রথমার্ধে বিখ্যাত দার্শনিক ও রেনে দেকার্ত জ্যামিতির সংগে বীজগণিতের সম্পর্ক এবং বীজগণিতের সাহায্যে জ্যামিতির প্রয়োগ তুলে ধরেন। দেকাতের প্রবর্তিত জ্যামিতিকে বিশ্লেষণমূলক জ্যামিতি বলে। প্রাচীন মিশরীয়রা কৃষি জমির সীমানা সঙক্রান্ত কাজে সর্বপ্রথম জ্যামিতির সূত্রপাত করেন। জ্যামিতির জ্ঞান থাকার কারণে মিশরীয়, ভারত, গ্রীকরা সুউচ্চ নান্দনিক দালান বা স্থাপত্য তৈরী করতে পেরেছে। দার্শনিক প্লেটো জ্যামিতিকে উচ্চতর বুদ্ধিবৃত্তিক কাজ মনে করতেন। প্লেটো মনে করতেন সুস্থ চিন্তা ও যুক্তির জন্য জ্যামিতির প্রয়োজন রয়েছে। তাঁর শিষ্য হতে হলে শর্ত ছিল জ্যামিতিক জ্ঞান। তাঁর একাডেমিক দরজায় লেখা ছিল জ্যামিতিক জ্ঞান যার নেই, সে যেন আমার দরজার ভিতর না ঢোকে।
ত্রিকোণমিতি: ত্রিকোণমিতির জন্ম প্রাচীন মিশরে। খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকে গ্রীক জ্যোতির্বিদ হিপারচাস গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করতে গিয়ে ত্রিকোণমিতির চর্চা শুরু করেন। তাঁকে ত্রিকোণমিতির জনক বলা হয়। ত্রিকোণমিতি গণিতের গুরুরত্বপূর্ণ অংশ। ইংরেজি ঞৎরমড়হড়সবঃৎু শব্দটি গ্রীক শব্দ ঞৎরমড়হ ও গবঃৎড়হ থেকে এসেছে। ঞৎরমড়হ এর অর্থ তিন কোণ আর গবঃৎড়হ এর অর্থ পরিমাপ। গণিতের যে শাখায় তিনকোণের পরিমাপ নিয়ে আলোচনা করা হয় তাকে ত্রিকোণমিতি বলে। খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছরেরও পূর্বে প্রাচীণ মিশরীয় ও গ্রীক গণিতবিদগণ ত্রিকোণমিতি বিষয়ে অধ্যয়ন করতেন। ভারতবর্ষে গুপ্ত আমলে আর্যভট্টের কারণে ত্রিকোণমিতির প্রসার ঘটে। মধ্যযুগের মুসলমানরা উদঘাটন করেন ত্রিকোণমিতির গুরুরত্বপূর্ণ তত্ত্ব। ১৭শতকে স্যার আইজ্যাক নিউটন ও জেমস স্টালিং

এর হাত ধরে আধুনিক গণিতের গুরুরত্বপূর্ণ শাখা হিসেবে প্রতিষ্ঠালাভ করে ত্রিকোণমিতি। বর্তমানে ত্রিকোণমিতির সাইন, কস, টেন, কট, সেক, কোসেক, থেটা ইত্যাদি বিষয়ে যে
ত্রিকাণমিতি ব্যবহ্নত হয় তার উদ্ভাবক তিন মুসলিম গণিতবিদ। তাঁরা হলেন আবু আবদুল্লাহ আল বাতানি, হাবাস আল হাসিব ও আবুল ওয়াফা আল বুজানি। জ্যামিতিতে কোণের ধারণা সীমাবদ্ধ। জ্যামিতিতে কোণ সর্বদাই ধনাত্মক এবং ০ হতে ৩৬০ এর মধ্যে কোণের মান সীমাবদ্ধ। কিন্তু ত্রিকোণমিতিতে কোণের মান সীমাবদ্ধ নয়। ত্রিােকাণমিতিতে কোণ উৎপন্ন হয় একটি রশ্মি ঘূর্ণনের ফলে। রশ্মি অবিরাম ঘূর্ণনের ফলে যেকোন মানের কোণ উৎপন্ন করতে পারে। রশ্মিটি ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে ঘুরে পজেটিভ কোণ এবং ঘড়ির কাঁটার দিকে ঘুরে নেগেটিভ কোণ উৎপন্ন করে। ত্রিকোণমিতির ছয়টি অনুপাত সাইন,কস, টেন,কট, সেক, কোসেক চতুর্ভাগে অবস্থান করে। ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের চিহ্ন কোণের উপর নির্ভর করে না। ঘূর্ণায়মান সরলরেখার শেষ অবস্থানের উপর নির্ভর করে। প্রথম চতুর্ভাগে সকল অনুপাতই ধনাত্মক, ২য় চতুর্ভাগে সাইন আর কোসেক পজেটিভ এবং বাকীরা নেগেটি, ৩য় চতুর্ভাগে টেন আর কট পজিটিভ এবং বাকীরা নেগেটিভ, ৪র্থ চতুর্ভাগে কস আর সেক পজিটিভ এবং বাকীরা নেগেটিভ। এই চতুর্ভাগের উপর নির্ভও কওে ত্রিকোণমিতিক ছয়টি অনুপাতের হিসাব-নিকাশ। এ জন্য বলা হয়ে থাকে ত্রিকোণমিতিক অনুপাতের হিসাব-নিকাশের প্রাণ হচ্ছে চতুর্ভাগ। দু‘টি পরষ্পরচ্ছেদী লম্ব সরলরেখা একটি সমতলকে চারটি অংশে বিভক্ত করে। এক-একটি ভাগকে বলা হয় চতুর্ভাগ।
গণিতের জ্ঞান ছাড়া কোন মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। মানবের জীবন থেকে মৃত্যু পর্যন্ত গণিতের প্রয়োজন হয়। মানুষ জন্মের আগে ও মৃত্যুর পওে দিন তারিখের হিসাব হয়। মা গর্ভবতী হওয়ার পর থেকে শুরু হয় দিন তারিখ। মৃত্যুর পরও মানুষ তারিখ রেখে যায়। এখানে উঠে এসেছে গণনার হিসাব। গণনা থেকেই জন্ম হয়েছে গণিতের।
আদিম যুগেও গণনা ছিল। এ যুগে নাকি এক-দুই পর্যন্ত গণনা ছিল। আগেকারদিনের মানুষরা আঙুল থেকে দশ পর্যন্ত গুণতে শিখেছিল। আমরা দেখেছি অশিক্ষিত মানুষরা টাকা গণনা কওে কুঁড়ি উপর নির্ভও করে। যেমন ৪৫ টাকার হিসাব করত দুই কুঁড়ি পাঁচ। গাত মেপে দৈর্ঘ্যরে হিসাব করত। আমেরিকার আদিম অধিবাসীরা ৫,১০,২০ ব্যৗবহার কওে গণনা করত। গ্রীকরা আলফাকে এক, বিটাকে দুই বলে হিসাব করত। চীন, জাপান, রাশিয়ার কোন কোন অঞ্চলে গণনায় হিসাব তক্তা ব্যবহার করত। তক্তার উপর লম্বা দাগ দিয়ে হিসাব করত। এ হিসাক মিশর, ভারত গ্রীস ও রোমে ব্যবহ্নত হত।্ সংখ্যার ধারণা প্রাচীন। সংখ্যার উৎপত্তি কখন হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসারের ফলে সংখ্যার ধারণা স্পষ্ট হয়ে উঠে। ১ থেকে ৯ এবং ০ হয়ে উঠে সংখ্যার মূল ভিত্তি। এসব ভিত্তি সংখ্যা জন্ম হয়েছে বৃহত্তর সংখ্যার। যেমন ১ এর পাশে ২ দিলে হয় ১২ ইত্যাদি। খ্রিষ্টীয় নবম শতাব্দীর আগেই ভারত বর্ষে চালু হয় বর্তমান সংখ্যা লিখন পদ্ধতি। বিখ্যাত গণিতবিদ আল খারেজমীর মতে, ০(শূন্য) উদ্ভাবন হয়েছে ভারতে। ০ এর আরবি
শব্দ সিফর। ইংরেজি শব্দ সাইফার(cipher) সিফর থেকে এসেছে। যিরো শব্দও এসেছে সিফর থেকে। সিফর শব্দের ইটালি ভাষা যেপিরো।যেপিরো থেকে ইংরেজি শব্দ যিরো(zero) হয়েছে।
গণিতশাস্ত্রেও পাটিগণিত , বীজগণিত, জ্যামিতি ও ত্রিকোণমিতি ছাড়াও আরো শাখা ও উপশাখা রয়েছে। মানব সভ্যতার উন্নতিতে এগুলোর অবদান রয়েছে। স্থিতিবিদ্যা ও গতিবিদ্যার কথা যদি বলি এ গণিত প্রাচীনকাল থেকেই ব্যবহার চলে আসছে। বড় বড় দালান, সেতু ও অত্যাধুনিক শক্তিশালী বোমা ও মেশিনারী যন্ত্রপাতি তৈরীতে স্থিতিবিদ্যার অবদান অনর্স্বীকার্য। বিজ্ঞানের অসামান্য দিকপাল, গণিতবিদ, পদার্থবিদ ও জ্যোর্তিবিদ গতিবিদ্যা ও বলবিদ্যার বিখ্যাত সব সুত্রের মাধ্যমে ইতিহাসের পাতায় অমর হয়ে থাকবেন। গণিতের এমন কোন বিষয় নেই যেগুলো মানবজাতির কাজে লাগে না। অর্থনীতি, ব্যবসায় গণিত, প্রকৌশলবিদ্যা ইত্যাদি ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে ব্যবহ্নত হয় সরলরেখার সমীকরণ। বায়োটেকনোলজি, ভিডিও গেমস ও কম্পিউটার গ্রাফিক্সে ব্যাপক ব্যবহার ত্রিকোণমিতি।
জাতির সভ্যতার বৈপ্লবিক চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয় যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামকে। গণিতের জটিল সংখ্যার কারণে আমরা মোবাইল ফোনে কথা বলা আর রেডিও শুনতে
পারছি। গণিতের বহুপদ ও বহুপদী সমীকরণের সাহায্যে শেয়ারবাজারের পরিবর্তন, বাজেট বিশ্লেষণ, দ্রব্যমূল্য হ্রাসবৃদ্ধি ও পরিমাপ, মিসাইলের গতিপথ, ভোল্টেজের উঠানামা ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়। দ্বিপদী উপপাদ্য ব্যাপকভাবে ব্যবহ্নত হয় জটিল হিসাব-নিকাশে। প্লেটো বলেছেন, কেউ জননেতা হতে চাইলে তার উচিত গণিতশাস্ত্র নিয়ে শিক্ষালাভ করা। মানুষের নেতা হলে বুদ্ধি, বিচার ও শক্তির প্রয়োজন রয়েছে। আব্রাহাম লিংকন চিন্তাশক্তি-বিচারশক্তির উৎকর্ষতার জন্য ইউক্লিডের বই পড়েছিল। ইউক্লিডের ছয় খন্ড বই পড়ে আব্রাহাম লিংকন চিন্তাশক্তি-বিচারশক্তি আয়ত্ত করে ফেলেছিলেন। গ্রীক গণিতশাস্ত্রবিদ ইউক্লিড এর অংকশাস্ত্র প্রথমে আরবি ভাষায় রচিত হয় এবং ল্যাটিন ভাষায় অনুমোদিত হয়। আইনস্টাইন ইউক্লিডের জ্যামিতির সূত্রের সাহায্যে আপেক্ষিক তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। ইউক্লিডের অংকশাস্ত্রের উপর গবেষণা কওে জার্মান অংকশাস্ত্রবিদ রেইম্যান ইউক্লিডিয়ান জিওম্যাট্টি আবিষ্কার করেন। ডেমেক্রিটাস নামের এক গ্রীক পন্ডিত বলেছিলেন- রাজসিংহাসনের চেয়ে জ্যামিতির উপপাদ্য তার কাছে বেশি লোভনীয়। গণিতবিদ ও পদার্থবিদ আর্কিমিডিস এর হাত ধরে গণিতের বহু প্রধান প্রধান শাখার সূচনা হয়েছেন। তিনি বহু কলা-কৌশল যেমন দন্ড যন্ত্র, পানি পাম্প করে উপনে তোলার যন্ত্র ইত্যাদি। তিনি যন্ত্রপাতির বৈজ্ঞানিক গুরুত্ব দিতেন না। জ্যামিতির খেলা বলতেন। এক রাজা স্বর্ণকারকে নির্দিষ্ট পরিমান সোনা দিয়ে বলেছিলেন মুকুট তৈরি করতে। রাজার সন্দেহ হল মুকুটে রুপা মিশানো হয়েছে। আর্কিমিডিস রাজাকে সমাধান দিয়েছিলেন। কোন কঠিন পদার্থ কোন সম্পূর্ণ ভরা পাত্রের মদ্যে ডুবিয়ে রাখলে ঐ পদার্থদেও সমপরিমান পানি উপচে পড়ে। এ কৌশল অবলম্বন কওে তিনি রাজাকে সমাধান দিয়েছিলেন। তিনি বলেছেন গণিত তার কাছেই প্রকৃত সৌন্দর্য সহকারে ধরা দেয়, যে বিশুদ্ধ মন ও ভালবাসা নিয়ে গণিতের দিকে অগ্রসর হয়। গণিত আমাদের জীবনের অনেক দেখা ও অদেখা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন মহাকাশ ভ্রমণ, ক্রেডিট কার্ডের গোপনীয়তা রক্ষা, ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত ও শেয়ার বাজার সম্পর্কে ভবিষ্যত বাণী ইত্যাদি। গণিত আমাদের চারপাশের পৃথিবীকে জানতে সাহায্য করে। আমাদেরকে চ্যালেঞ্জ নিতে শিখায়।গ্যলিলিও বলেছেন প্রকৃতির বিরাট গ্রন্থটি গণিতের ভাষায় লেখা। এজন্য গণিতকে বলা হয় ব্যবসা, প্রকৌশল বা অন্যান্য বিজ্ঞানের প্রধান অস্ত্র। গণিতবিদরা গণিতকে বিজ্ঞানের মাও বলেছেন।
গণিত সত্যিকার অর্থেই বিচিত্র। অন্যদিকে গণিত হচ্ছে শুধু বুদ্ধিও খেলা। আমরা যা কিছু সত্য বলে মনে করি তা গণিতের মাধ্যমে প্রমাণ করি। হিসাবে আশ্রয় নিই গণিতে। ১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১,৩৪,৩৫.৮৯——- অংকের এই সিরিজটি অনেকের কাছে অচেনা মনে হচ্ছে। এটি হচ্ছে ফিবোনাচিচ সিরিজ। লিওনার্দো ফিবোনাচিচ এটি আবিষ্কার করেন।
এই সিরিজের একটা সংখ্যা পাওয়া যায় তার আগের দুইটি সংখ্যাকে যোগ করে। যেমনÑ ১+১=২, ১+২=৩, ৩+৫=৮ ইত্যাদি। বিজ্ঞানের নতুন নতুন আবিষ্কাওে গণিতের প্রয়োজন
রয়েছে। আর জীবকে উপলব্ধি করার এবং জীবন ব্যবস্থা উন্নয়নের জন্য গণিতের জ্ঞান থাকা জরুরী। মানুষের জীবনের সাথে গণিত ওতপ্রোতভাবে জড়িত রয়েছে। গণিত সর্বকালে, সর্বদেশে ব্যক্তিগত-সমাজ জীবন এবং দেশের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতে মানুষকে সর্বদা সাহায্য করে চলছে। জীবনকে নিয়মের মধ্যে আনার জন্য গণিতের জ্ঞান থাকা প্রয়োজন। মানুষসহ পৃথিবীর সকল প্রাণীর মধ্যে গণিতের জ্ঞান থাকা দরকার। এক কথায় আল্লাহর সব সৃষ্টির মধ্যে ছোঁয়া লেগেছে গণিতের। গাণিতিক নিয়ম ছাড়া কোন কিছুই চলমান রাখা সম্ভব নয়। প্রাচীন ও মধ্যযুগে সকলেই দক্ষ হতেন গণিতে। পেশাগত দক্ষতা গণিত ছাড়া সম্ভব নয়। মাথা ছাড়া যেমন মানুষ কল্পনা করা যায় না তেমনি গণিত ছাড়া বিজ্ঞান কল্পনা করা যায় না। গণিত হল বিজ্ঞানের জ্বালানী। তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চালানো সম্ভব নয় তদ্রুপ গণিত ছাড়া বিজ্ঞান শিক্ষা পরিপূর্ণ হয় না। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রধান হাতিয়ার হচ্ছে গণিত। অন্যদিকে গণিতের কারণে জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ হয়। বিকাশ ঘটে চিন্তাশক্তি ও যৌক্তিক ক্ষমতা। সত্য অনুসন্ধানে উৎসাহী করে তোলে। বাস্তব সমস্যার সমাধান করা যায়। নির্দিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সাহায্য করে। তৈরী হয় গবেষণামূলক মনন।
গণিত খুবই মজার বিষয়। কিন্তু আমরা গণিত কষতে গিয়ে জটিল করে ফেলি। গণিতে দক্ষ হতে হলে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। নিয়মিত অনুশীলন না করার কারণে গণিতের প্রতি আগ্রহ হারিয়ে যায়। তাই প্রতিদিন সমাধান করতে হবে কিছু না কিছু
গাণিতিক সমস্যা। বাস্তবসম্মত উদাহরণ দিয়ে শিখলে গণিত সহজ হয়। তাই গণিত শিখতে হলে কিংবা জানতে হলে সর্বোপরি গণিতে ভাল করতে হলে কিছু কৌশল অবলম্বন করতে হবে। গণিত জানার বা ভাল করার বহু কৌশল আছে। কিছু কৌশল এখানে আলোচনা করা হল।

১) প্রস্তুতি: গণিতে ভাল করতে হলে ছোটবেলা থেকে প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রাথমিক শিক্ষায় ভালভাবে গণিতের প্রস্তুতি নিতে পারলে ভাল ফল পাওয়া যায়। ছোট ছেলে-মেয়েদেও কাছে আকর্ষণীয়ভাবে অংক বা জ্যামিতি তুলে ধরতে হলে দার্শনিক প্লেটোর মতামত অনুসরণ করতে হবে।
২) আত্ম বিশ্বাসী হওয়া: গণিতে ভাল করতে হলে আত্মাবশ্বাসী হতে হবে। গণিত আমি শিখতে পারব এই বিশ্বাস মনে-প্রাণে ধারণ ও লালন-পালন করতে হবে। তাহলে সহজেই গণিত শিখা যাবে। গণিতে দক্ষ হওয়া যাবে।
৩)ইতিবাচক হওয়া: গণিতকে স্বাভাাবিকভাবে নিয়ে শিখতে হবে। যেকোন গণিত বা অংক দেখলে মনে ভয় আনা যাবে না। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে কষা শুরু করতে হবে।
৪) বুঝে করা: গণিত মুখস্থ করা যাবে না। গণিতে মুখসআত করার অভ্যাস ত্যাগ করতে হবে। বুঝে গণিত করতে হবে। কোন অংক না বুঝলে সেটি বাদ দিয়ে পরের অংক কষা ঠিক নয়। বুঝে গণিত করলে মন থেকে কঠিন চিন্তাধারা চলে যাবে।
৫) নিয়মিত অনুশীলন: গণিতে দক্ষ হতে হলে নিয়মিত অনুশীলন করতে হবে। প্রতিদিন কিছু না কিছু সমস্যা সমাধান করতে হবে। বারবার অনুশীলন করলে গণিত সহজেই নিজের আয়ত্বে এসে যাবে। অধ্যায়ের সূত্রগুলো বারবার লিখে ও পড়ে অনুশীলন করতে হবে। তখন গণিত সহজ হয়ে যাবে। বেড়ে যাবে গণিতের প্রতি আগ্রহ। সৃজনশীল গণিতে ভাল করার জন্য বশি বেশি সূত্র অনুশীলন করতে হবে। মৌলিক বিষয় না জানলে সৃজনশীল গণিতে ভাল করা যায় না। একটি বিষয়ের উপর পুরোপুরি ধারণা হলে সৃজনশীলে ভাল করা যাবে।
৬) একদিনে সব অংক শেষ না করা: একদিনে বইয়ের সব অংক শেষ করা যাবে না। এই রকম টার্গেট নেয়া ভাল নয়। নির্দিষ্ট অধ্যায়ে পারদর্শী বা দক্ষ হওয়া ভাল। হাতে-কলমে অংক কষার চেষ্টা থাকতে হবে।
৭) বারবার আলোচনা: একটি অধ্যায় শেষ হয়ে গেলে সেই অধ্যায়কে আবারো ঝালাই করে নিতে হবে। নিজে কিংবা বন্ধুদের সাথে বসে সেই অধ্যায়ের অংক নিয়ে আলোচনা ভাল কাজ দেয়। নরওয়ের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, গণিতে ভাল করার জন্য প্রতিভার চেয়ে অনেক বেশি কার্যকর অনুশীলন। বারবার অনুশীলনে গণিতে পারদর্শী হওয়া যায়। চংুপযড়ষড়মরপধষ জবঢ়ড়ৎঃ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে জানা যায়, গণিতের ক্ষেত্রে জন্মগত প্রতিভার কোন দাম নেই। যত বেশি অনুশীলন করা হয় ততই
গণিতে ভাল করা যায়। গবেষণায় গণিতে প্রতিভার তেমন গুরুত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। গণিতে ভাল করার জন্য প্রতিভার চেয়ে বেশি কার্যকর অনুশীলন।
৮) ভুলগুলো ঠিক করা: গণিত কষার সময় ভুল হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। গণিত কষার সময় কি ভুল হয়েছে তা শুধরে নিতে হবে। ভুলগুলো নিজে বের করতে না পারলে অপরের সাহায্য নিতে হবে। কি ভুল করেছি তা নিজের আয়ত্বে আনতে হবে।
৯) চিত্রের সাহায্যে সমাধান: চিত্রের সাহায্যে সমাধান গণিতকে সহজ করে তোলে। চিত্রের সাহায্যে গণিত আয়ত্ব করতে পারলে গণিতের প্রতি আকৃষ্টতা বাড়বে। শিক্ষার্থীদের কাছে গণিত শিক্ষা প্রাণবন্ত হবে। জ্যামিতি অংকনে রুলার ও কম্পাস ব্যবহারের উপর জোর দিতে হবে। আগেকারদিনে গণিতবিদরা বালুর উপর জ্যামিতি অংকন করতেন। বর্তমানে যে জ্যামিতি শিখানো হয় তা বেশির ভাগই ২২০০ বছর আগে বালির থালার উপরেই প্রথমে আঁকা হয়েছিল।
১০) উদাহরণ দিয়ে শেখা: যেকোন জিনিষ উদাহরণ দিয়ে শিখলে তা ভালভাবে বুঝা যায়। গণিতে বাস্তব সম্মত উদাহরণ দিয়ে শিখলে গণিত সহজ হয়। অংক বা গণিত কষার সময় উদাহরণ দিয়ে কষার চেষ্টা থাকতে হবে।
১১) আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা: গণিতের প্রতি অনুরাগ জন্মাতে হলে গণিত শিখানোর সাথে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থা করতে হবে। অংক বা গণিতে অনেক ম্যাজিক বা খেলা আছে। গণিত শিখানোর শুরুতে কিংবা মাঝে কিংবা শেষে কিছু অংকের খেলা উপস্থাপন করা দরকার । মনকে চাঙ্গা ও গণিতকে আকর্ষণীয় করতে আমোদ-প্রমোদের ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে।
১২) মনযোগী হওয়া: গণিত শিখতে হলে মনযোগী হতে হবে। প্রার্থনা করা সময় যে মনযোগ থাকে গেন রকম মনযোগ গণিত শিখার সময় থাকতে হবে। কিংবা শরীরে আগুন লাগলেও অনুভব হবে না যে শরীরে আগুন লেগেছে। এমন মনযোগী হতে হবে। মনযোগ মেধাকে ত¦রান্বিত করে। তাই গণিত শিখার সময় মনযোগী হতে হবে।
গণিতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। বিশুদ্ধ গণিত ও ব্যবহারিক গণিত। বিশুদ্ধ গণিত তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করে। ব্যবহারিক গণিতে সাধারণ দৈনন্দিন জীবনের সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করা হয়।
১৩) নিয়মিত বিদ্যালয়ে যাওয়া: গণিতে পারদর্শী কিংবা গণিত শিখতে হলে নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে হবে। নিয়মিত ক্লাস করতে হবে। এ পর্যন্ত জ্ঞানার্জনের জন্য কোন শর্টকার্ট পথ আবিষ্কৃত হয়নি। জ্ঞানের জন্য নিয়মিত পড়তে হবে। ক্লাসে প্রতিদিন যেতে হবে। দুইদিন গেলাম তার পরের দিন গেলাম না- এ রকম হলে গণিত শিখা যাবে না। অসীম ধৈর্য, অনুশীলন, অধ্যাবসায় ও মনোযোগ থাকতে হবে। গণিত অনেকের কাছে নীরস মনে হয়। মনে রাখতে হবে গণিত বিজ্ঞানের ভাষা আর বিজ্ঞান উন্নয়ন ও গতির ধারক। গণিত বিষয়ের মধ্যে একবার ডুবে যেতে পারলে গণিতের কোন বিষয় আর নীরস থাকে না।
১৪) নিয়মিত গণিত কষা: হাতে-কলমে গণিত না শিখলে গণিতে দক্ষ হওয়া যায় না। বুঝে-শুনে গণিত শিখতে হবে হাতে-কলমে। নিয়মিত গণিত কষতে হবে। গণিত শিখায় কোন বিরতি নেই। বিরতীহীনভাবে শিখতে হবে গণিত। বিরতীহীন মানে প্রতিদিনই গণিত কষতে হবে। যারা গণিতে ভাল হয় তারা সবকিছুতে ভাল হয়। মেধাবী হয় তারা। কেননা

বিজ্ঞানের সমস্ত শাখায় গণিতের ব্যবহার হচ্ছে। গণিত হচ্ছে বিজ্ঞানের ভাষা। গণিতকে সমস্ত বিজ্ঞানের রানী বলে ডাকা হয়।
১৫) যখন-তখন অনুশীলন: গণিতের প্রস্তুতিকে আরো গতিশীল করার জন্য যখন-তখন অনুশীলন নেয়া যেতে পারে। কম্পিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, ট্যাব বা সাধারণ মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যখন-তখন অনুশীলন করা যায়। ওয়েবসাইটে গিয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়ের যথাযথ অনুশীলন করা যায়।
১৬) ধারাবাহিকতা রক্ষা করা: গণিতে দক্ষ হতে হলে ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে হবে। গণিতের যে বিষয় নিয়ে পড়াশুনা শুরু করব সে বিষয় শেষ না হওয়া পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে। একদিন পড়াশুনা করলাম তারপর দু‘দিন পর করলাম তা হবে না। প্রতিদিন ঐ বিষয়ের উপর পড়াশুনা চালিয়ে যেতে হবে। তাহলে গণিতে দক্ষ হওয়া যাবে।
১৭) বেশি বেশি গণিতের সূত্র জানা: গণিতকে নিজের কব্জায় নিয়ে আসতে হলে বেশি বেশি গণিতের সূত্র জানতে হবে। যে যত বেশি সূত্র জানবে সে তত বেশি গণিত আয়ত্বে করতে পারবে। শুধু সূত্র জানলে হবে না সূত্রের প্রয়োগও জানতে হবে।
গণিতকে বলা হয় বিজ্ঞানের মা। ফলে গণিতের ক্ষেত্র বিশাল। আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গণিতের প্রয়োজন রয়েছে। গণিত মানুষের জীবনের সংগে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। গণিত ব্যবসা, প্রকৌশল এবং অন্যান্য বিজ্ঞানের প্রধান ভাষা।জ্ঞান-বিজ্ঞান,, অর্থনীতি,কৃষ্টিসহ যা কিছু মানব সভ্যতার নিদর্শন, তার মূলে রয়েছে গণিতের অবদান। চিতিৎসা অর্থনীতিতে গণিত ব্যবহ্নত হচ্ছে। মানব সভ্যতার অগ্রগতির সাথে গণিত জড়িত। গণিতের ইতিহাস সভ্যতার ইতিহাস। গণিতের ইতিহাসের সাথে অনেক স্থান ও অনেক মনীষীর নাম জড়িত। যেমন-মেসোপটেমিয়, মিশর, গ্রীস,রোম, ভারতবর্ষ। রোমের কথা যদি বলি তারা ব্যবহারিক জীবনে জমি জরীপ, গৃহ নির্মাণ প্রস্তুতি কাজে গণিত ব্যবহার করতেন। মিশররা গণনায় দশমিক পদ্ধতি ব্যবহার করতেন। গণিতে ভারতীয়দেও অবদান কম নয়। সংখ্যার বর্তমান প্রতীক ০,১,২,৩,৪,৫,৬,৭,৮,৯ এবং দশমিক স্থানীয় মান অনুযায়ী সংখ্যা লিখন প্রণালী ভারতেই প্রথম আবিষ্কৃত হয়। “০” প্রতীকের আবিষ্কার ভারতীয়রাই করেন। “০” আবিষ্কার গণিতের এক অভূতপূর্ব সাফল্য। গণিত আমাদেরকে শিখায় চ্যালেঞ্জ নিতে। গণিত ভালভাবে জানা থাকলে পুরো পৃথিবী হাতের মুঠোয় চলে আসবে। গণিতের উন্নতির সাথে সাথে মানব সভ্যতার উন্নতি হয়েছে। জীবনকে নিয়মে পরিচালনার গণিতের প্রয়োজন রয়েছে। ন্যুনতম গণিতের জ্ঞান না থাকলে জীবন এলোমেলো হয়ে যাবে। গণিত ছাড়া
মানুষ বেঁচে থাকতে পারে না। জীবনকে উপলব্ধি করার জন্য গণিতের জ্ঞান থাকা জরুরী। তাই আধুনিক বিজ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির মূলে রয়েছে গণিতে ভূমিকা। অন্যদিকে দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহারিক প্রয়োগের জন্য গণিত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যোগাযোগের মাধ্যম , দৈনন্দিন প্রয়োজনে, পরিবেশকে জানার জন্য, উন্নত জীবন-যাপনে, মানবিক শিক্ষায়, পেশাগত উৎকর্ষ সাধনে, প্রজ্ঞালাভে ইত্যাদিতে গণিত ব্যবহ্নত হচ্ছে।

এছাড়াও যৌক্তিক চিন্তার বিকাশ ও মনোযোগের শক্তি বৃদ্ধিতে গণিতের প্রয়োজন রয়েছে। ফলে আমাদেরকে গণিত শিখতে হবে। প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তওে গণিত বিষয় রয়েছে। প্রাথমিক স্তরে প্রাথমিক গণিত একটি আবশ্যকীয় বিষয়। প্রাথমিক স্তরের প্রথম শ্রেনী থেকে পঞ্চম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের জন্য গণিত রয়েছে। মাধ্যমিক স্তরে রয়েছে সাধারণ গণিত ও উচ্চতর গণিত। সাধারণ গণিত সব শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক। কিন্তু উচ্চতর গণিত বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্য হলে বাধ্যতাতামূলক নয়। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে উচ্চতর গণিত বিজ্ঞান শিক্ষার্থীদের জন্যও বাধ্যতামূলক নয়। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, নানা কারণে শিক্ষার্থীদের মাঝে “গণিত ভীতি” পরিলক্ষিত হয়। ফলে শিক্ষার্থীর শিক্ষার ক্ষেত্রে নানাবিধ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এবং উচ্চতর শিক্ষালাভে সমস্যা হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত না থাকলে বিজ্ঞানের অনেক বিষয় ও টেকনিক্যাল শিক্ষা গ্রহণ বাধাগ্রস্ত হয়। চাকুরীক্ষেত্রেও গণিতের দখল না থাকলে কাঙ্খিত ফলাফল পাওয়া যায় না। এজন্য বলা হয়ে থাকে সুরা ফাতেহা যেমন কোরাআনের সারবস্তু তেমনি গণিত হল বিজ্ঞানের জ্বালানী। তেল ছাড়া যেমন গাড়ি চলে না গণিত ছাড়া বিজ্ঞান চলে না। কি চাকুরীক্ষেত্রে, কি ব্যবসায়, কি প্রযুক্তিগত শিক্ষায় সর্বক্ষেত্রে গণিতের ব্যবহার হচ্ছে। গণিতের যোগাশ্রয়ী প্রোগ্রামের কথা যদি আমরা বলি এটিকে বর্তমান সময়ে মানবজাতির তথা সভ্যতার বৈপ্লবিক উন্নতির চাবিকাঠি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কেননা এটি বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে কর্মদক্ষতা, উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি নির্ধারণ কওে নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে সর্বতোভাবে সহায়তা করে। জটিল সংখ্যার কথা বললে বলতে হয় এটি না হলে আমরা মোবাইল ফোনে কথা বলা কিংবা রেডিও শুনতে পারতাম না। পাইপের ভিতর পানির প্রবাহ, ইলেকট্রিক সার্কিট, রেডিও তরঙ্গ প্রেরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এটি অভিনব সমস্যার সমাধান করে। বহুপদী সমীকরণের সাহায্যে অর্থনীতির ব্যয় বিশ্লেষণ, শেয়ার বাজারের পরিবর্তন, বাজেট বিশ্লেষণ, দ্রব্য-মূল্য হ্রাস বৃদ্ধির পরিমাপ, মিসাইলের গতিপথ, ভোল্টেজের উঠানামা ইত্যাদি পরিমাপ করা হয়। এভাবে গণিতের প্রতিটি বিষয় মানবজাতির উন্নতির চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে। তাই নিজের ও দেশের উন্নতির জন্য গণিতের শিক্ষালাভ অত্যন্ত জরুরী। গণিতে যারা দক্ষ হয় তারা মেধাবী ও বিচক্ষণ হয়। যুক্তিতে হয় তারা পারদর্শী। প্রাথমিক স্তর থেকে শিক্ষার্থীরা যেন গণিতে পারদর্শী হয় সে চেষ্টা আমাদের করা উচিত। গণিতে পারদর্শীতার ধারাবাহিকতাও যেন থাকে।
শিক্ষার্থীদের মনে গণিতভীতির অনেকগুলো কারণ রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম কারণ হিসেবে আমি মনে করি শুরুতেই গণিতকে কঠিন বলে চালিয়ে দেয়া। অভিভাবকরা বলে থাকেন বিজ্ঞান কিংবা গণিতে লেখাপড়ায় খরচ বেশি। গণিতে প্রাইভেট পড়তে হয়। প্রাইভেট না পড়লে ভাল করা যায় না। এক্ষেত্রে একটি গবেষণার কথা বলা যেতে পারে। আমরা গণিত বিষয়ের কিছু কলেজ শিক্ষক ২০০৪ সালে কুমিল্লার কোটবাড়ীতে উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে ১০ ফেব্রুয়ারী হতে ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৫৬ দিন ব্যাপী
২৫তম ব্যাচ হিসেবে বিষয়ভিত্তিক শিক্ষক প্রশিক্ষণে অংশ গ্রহণ করি। প্রশিক্ষণে ছিল সারাদেশের বিভিন্ন কলেজের ৩৯ জন কলেজ শিক্ষক। প্রশিক্ষণে আমরা ছাত্র বনে গেলাম। প্রশিক্ষণ একটি বিশেষ অংশ ছিল এ্যাকশন রিসার্চ বা কার্যোপযোগী গবেষণা। শিক্ষাক্ষেত্রে কোন বিশেষ সমস্যার কারণ অনুসন্ধান ও সমাধানের নির্দেশনা প্রদানের জন্য এই গবেষণা। আমাদের গবেষণার বিষয় ছিল“ উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদের গণিত শিক্ষায় অনীহা ও দূর্বলতা: কারণ ও প্রতিকার”। গবেষণার জন্য প্রশিক্ষণার্থীদের থেকে পীথাগোরাস ও আলজাবির নামে দুইটি কমিটি গঠন করা হয়। প্রতি কমিটিতে সদস্য সংখ্যা ছিল ৫জন। আমি (লেখক) আলজাবির গ্রুপের আহবায়ক ছিলাম। উক্ত বিষয়ের গবেষণার ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম কুমিল্লা ক্যাডেট কলেজ, কুমিল্লা সরকারি মহিলা কলেজ, কুমিল্লা সরকারি কলেজ, কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, সিলেট এমসি কলেজ, চন্দনাইশ গাছবাড়িয়া সরকারি কলেজ ও চট্টগ্রামের লোহাগাড়া আলহাজ্ব মোস্তফিজুর রহমান কলেজ। তথ্যের উৎস ছিল গণিতের শ্রেনী শিক্ষক, শিক্ষাবিদ(গণিত), শিক্ষার্থী, অভিভাবক ও অধ্যক্ষ। গবেষণার তথ্য সংগ্রহের জন্য আমরা প্রশ্নোত্তরিকা বিতরণ করি। আমরা ভিন্ন ভিন্ন উৎসের জন্য ভিন্ন ভিন্ন প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করি। প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয় গণিত বিষয়ের শ্রেনী শিক্ষকের জন্য, শিক্ষাবিদগণের জন্য, শিক্ষার্থীদের জন্য এবং অভিভাবকদের জন্য। গণিত শ্রেনী শিক্ষকের জন্য ১০টি, গণিত শিক্ষাবিদগণের জন্য ১২টি, শিক্ষার্থীদের জন্য ১১টি ও অভিভাবকদের জন্য ১১টি প্রশ্ন করা হয়। প্রাপ্ত ফলাফল বিশ্লেষণের মাধ্যমে গণিত শিক্ষার অনীহার কারণগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হল:
১) মাধ্যমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থীদেও পাঠ্যবিষয়ে উচ্চতর গণিত না রাখা।
২) শিক্ষার্থীদেও নিকট গণিতকে সহজ, সরল ও আকর্ষণীয়ভাবে উপস্থাপন না করা।
৩) শিক্ষার্থীদেও কাছে গণিত কঠিন বলে ভীতি দেখানো।
৪) মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকের অভাব থাকা।
৫) প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ও দক্ষ শিক্ষকের অভাব।
৬) পরিকল্পনাবিহীন পাঠদান।
৭) অভিভাবকের অসচেতনতা।
৮) ছাত্র, শিক্ষক ও অভিভাবকের সমন্বয়হীনতা।
৯) শিক্ষার্থীদেরকে গণিতের গুরুত্ব অনধাবন না করানো।
১০) উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিতকে আবশ্যিক না করা।
১১) পাঠ্যসূচির পরিধি বৃদ্ধি।
১২) সহজ পদ্ধতিতে প্রণয়ন না করা।
১৩) গণিত শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত না করা।
১৪) গণিত পাঠে উদ্বুদ্ধকরণে অভিভাবকদের সচেতন না করা।

বিজ্ঞান শিক্ষার জ্বালানী হিসেবে গণিত শিক্ষাকে উপযুক্ত স্থানে প্রয়োগ করতে না পারলে কোনদিনই কর্মমূখী শিক্ষার উন্নতি হবে না। আমাদের কষ্ঠ লাগে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে গণিত নি¤œমূখী অবস্থানে চলে যাচ্ছে। প্রাথমিকের “লার্নিং টু রিয়ালাইস এডুকেশনস প্রমিজ-২১৮” শীর্ষক বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের যা অংক শেখানো হচ্ছে তা পর্যাপ্ত নয়। ফলে ৭৫শতাংশ শিক্ষার্থীই পাঠ্যবইয়ের অংক বোঝে না। এ সমস্যা সমাধানে বিশ্বব্যাংক তিনটি সুপারিশ করেছে। ১) বাংলাদেশের শিক্ষার মান মূল্যায়ন করতে হবে ২) প্রাথমিক পর্যায়ের বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা ও শিক্ষকদের মান বাড়াতে হবে ৩) প্রাক-প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার্থীদের পুষ্টি ও শিক্ষার প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদেও শিক্ষাব্যবস্থায় বিজ্ঞান শিক্ষার উন্নয়নের জন্য “গণিত”কে দিয়ে সঠিক ও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত।
একটি কাজ শুরুর আগে ভয় থাকলে সে কাজে সফল হওয়া যায় না। পারি কি না পারি কাজ শুরু করে দিতে হবে। সাহস নিয়ে করতে হবে। অংক বা গণিত কষা শুরু করি দেখি কি হয়। কোন সূত্র বা নিয়মের কারণে গণিত কষা বন্ধ হয়ে গেল তা শেখার আগ্রহ করব। প্রয়োজনে শিক্ষকদের তাৎক্ষণিক সহযোগিতা নিব। থামব না। চালিয়ে যাব। একবার না পারলে দেখব শতবার। এ রকম সাহস ও মানসিকতা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।
গণিতভীতি দূর করার জন্য বর্তমানে নানা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। হাতে-কলমে গণিত শেখার কথা, গণিত ক্লাব, গণিত কুইজ প্রতিযোগিতা ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষার্থীদেরকে গণিত বিষয়ে আগ্রহী করে তোলার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মনে রাখতে হবে গণিত বিষয় সম্পূর্ণ একটি আলাদা বিষয়। গণিত বিষয়ে শিক্ষার্থীদেরকে পরিশ্রম ও সময় দিতে হবে। থাকতে হবে পড়ালেখার ধারাবাহিকতা। শিক্ষার্থীরা নিয়মিত ক্লাস করলে গণিতভীতির পরিবর্তে সহজ হয়ে যাবে। মনযোগ, নিয়মিত চর্চা ও প্রয়োগ গণিত শেখার অন্যতম সিঁড়ি। মনযোগও আছে এবং নিয়মিত চর্চাও আছে। নেই প্রযোগের ক্ষমতা। তাহলে হবে না। প্রযোগের ক্ষমতা থাকতে হবে। এভাবে সিঁড়িতে উঠতে পারলেই গণিতভীতি দূর হবে। গণিত সহজ হয়ে যাবে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ্যতাভিত্তিক শিক্ষাক্রম ১৯৯২ সালে প্রবর্তন করা হয়। ২০১১ সালে করা প্রাথমিক শিক্ষাক্রম পুনরায় পরিমার্জন। প্রাথমিক শিক্ষার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও প্রান্তিক যোগ্যতা থেকে শুরু করে বিষয়ভিত্তিক প্রান্তিক যোগ্যতা ও শিখনফল নতুনভাবে নির্ধারণ করা হয়। পাঠ্য-পুস্তকের বিষয়বস্তু উপস্থাপনে আন্তর্জাতিক পদ্ধতি ও কৌশল অনুসরণ করা হয়। যাতে করে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষার্থীরা শিক্ষক দ্বারা গণিতের বিষয়বস্তু সংশ্লিষ্ট জ্ঞানার্জনের পাশাপাশি গাণিতিক ধারণা-প্রক্রিয়া ও গাণিতিক সমস্যা সমাধান করতে
পারে। একইভাবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরেও একই ব্যবস্থা করা হয়। শুধু প্রয়োজন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক দ্বারা পাঠদান এবং শিক্ষার্থীদেরকে ক্লাসে নিয়মিত

উপস্থিতি। না হয় দেশে গণিতের জ্ঞান পূরণ হবে না এবং দেশের উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। কেননা গণিত হচ্ছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষার প্রধান হাতিয়ার। এই হাতিয়ার মাধ্যমে আমাদের প্রাণপ্রিয় দেশকে সাজাতে হয়ে। পরিণত করতে হবে একটি সমৃদ্ধশালী ও উন্নত দেশে। বর্তমান দ্রুত পরিবর্তনশীল বিশ্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে দেশকে উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা খুবই প্রয়োজন। একটি দক্ষ ও সু-শিক্ষিত জনগোষ্ঠীই দেশকে উন্নয়নের দিকে নিয়ে নিয়ে যেতে পারে। মেধা আর জনশক্তিকে ডিজিটাল ও উন্নয়নের কাজে লাগাতে হবে। ডিজিটাল যত উন্নত হবে তত বেশি বিশ্বের সংগে তাল মেলানো সহজ হবে। একজন শিক্ষিত তরুণ তার মেধা সবক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারবে। ফলে তৈরী হবে উন্নয়নের সেতু।

সহায়ক গ্রন্থ:
১) গণিত শাস্ত্রের ইতিহাস- কাজী মোতাহের হোসেন
২) গণিত আমাদের কী কাজে লাগে- সফিক ইসলাম
৩) ঙীভড়ৎফ উরপঃরড়হধৎু
৪) ২৫তম ব্যাচের কার্যোপযোগী গবেষণা। উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কোটবাড়ি, কুমিল্লা।