পূর্বপশ্চিমবিডি : শেখর কুমার দেব। তিনি দুই বছর আগে সরকারি হওয়া একটি কলেজের শিক্ষক। কলেজটি সরকারি হওয়ায় শেখর কুমার দেব আশা করেছিলেন- তার বেতনভাতা ও মর্যাদা বাড়বে, পেনশন ও বাড়িভাড়া পাবেন। কিন্তু তার আশা ভেঙে গেছে, পেনশন পাওয়ার স্বপ্ন পূরণ হয়নি। দুই বছরেও তিনি সরকারি সুবিধা পাননি। শেখর দেবসহ ওই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-কর্মীদের সরকারি কোষাগার থেকে বেতনভাতা দেয়ার কাজ সম্পন্ন করতে পারেনি সরকার। প্রতিষ্ঠানটি হলো- ব্রাক্ষণবাড়িয়ার কসবা উপজেলার সৈয়দাবাদ ‘আদর্শ মহাবিদ্যালয়’।

২০১৮ সালে সৈয়দাবাদ ‘আদর্শ মহাবিদ্যালয়’কে জাতীয়করণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এই কলেজের কোন শিক্ষক এখন পর্যন্ত সরকারি কোষাগার থেকে বেতনভাতা পাননি, শিক্ষকদের সরকারি কোষাগার থেকে বেতনভাতা প্রদানের কাজ শেষ করতে পারেনি সরকার। এর ফলে শিক্ষকরা আগের নিয়মেই এমপিও সুবিধা পাচ্ছেন।

শিক্ষক শেখর কুমার দেব তার চাকরির বয়সসীমা শেষ হওয়ায় গত ৬ মে অবসরে গেছেন। তিনি বলেন, ‘দুই বছর আগে সরকারি হলেও আমি এর সুবিধা পাইনি। পাব কীনা তাও জানি না। অপেক্ষায় না থেকে আমি বেসরকারি শিক্ষক হিসেবেই আমার কল্যাণ তহবিলের টাকা পেতে আবেদন করেছি।’

শেখর কুমার দেব আরও বলেন, ‘আমি এখন কল্যাণ তহবিলের ১২ লাখ টাকার মতো পাব, সরকারি হলে এই টাকাই পেতাম। তবে সরকারি হলে অবসর সুবিধা ৮/৯ লাখ টাকা বেশি পেতাম, পাশাপাশি পেনশন পেতাম। চাকরি সরকারি হলে আমার বেতন বৃদ্ধি পেত না, তবে বেতনের গত ১২ নভেম্বর অনুষ্ঠিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে, নারায়ণগঞ্জের কদম রসুল কলেজ (সৃষ্টপদ ৪৩টি), সোনারগাঁও ডিগ্রি কলেজ (সৃষ্টপদ ২৩টি) ও রূপগঞ্জের মুড়াপাড়া কলেজ (সৃষ্টপদ ৪১টি) ও মুন্সীগঞ্জের টংগীবাড়ী কলেজের (২১টি) জনবল আত্তীকরণের প্রস্তুাব সম্প্রতি জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়, যাতে ২০/২৫ জন শিক্ষকের নাম বাদ পড়ে। বাদ পড়াদের মধ্যে ৫/৭ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষকও আছেন।’ বাদ পড়ার কারণ জানতে ওইসব শিক্ষক নিয়মিত শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে ধর্ণা দিচ্ছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘বলা হচ্ছে, আমার নিয়োগকালে পেপার কাটিং (নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি) নেই। কলেজে এটি সংরক্ষণের দায়িত্ব কী আমার? তাহলে আমাকে নিয়োগ কীভাবে দেয়া হলো? এমপিওভুক্তি হলাম কীভাবে?’

শুধু সৈয়দাবাদ আদর্শ মহাবিদ্যালয় ও ‘সোনারগাঁও মহাবিদ্যালয় ছাড়াও ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজসহ ৩০২টি কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীই সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় চাকরিও হারাচ্ছেন।

২০১৬ সালের জুন থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে ৩০২টি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়েছে। তবে ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত তিনবছরে ওইসব কলেজের একজন শিক্ষকের চাকরিও আত্তীকরণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়নি। দীর্ঘ আত্তীকরণ প্রক্রিয়া ও বারবার যাচাই-বাছাইয়ের কারণে বয়সসীমা শেষ হওয়ায় ওইসব প্রতিষ্ঠানের অনেকেই নিয়মিত অবসরে গেছেন। আবার নিয়োগ প্রক্রিয়ায় নানা ত্রুটি ও অসঙ্গতির কারণে আত্তীকরণ প্রক্রিয়া বা চাকরি থেকে অনেকের নাম বাদ পড়েছে।

সরকারি হওয়া কলেজ শিক্ষকদের সংগঠন ‘সরকারি কলেজ শিক্ষক সমিতির (সকশিস) সভাপতি জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘সবকটি কলেজের ওপরই মাউশি কর্মকর্তারা প্রতিবেদন করেছে, শিক্ষক-কর্মচারীর তালিকা তৈরি করেছে। এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয় অধিকতর যাচাই-বাছাই করে নথিপত্র জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠাচ্ছে। তারা এক সপ্তাহে মাত্র ২/৩টি কলেজের কাজ শেষ করছেন।’

জহুরুল ইসলাম ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘শিক্ষকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলনের কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হয়েছে। কিন্তু এখন সরকারি সুবিধাতো শিক্ষকরা পাচ্ছেন না, উল্টো অনেকে চাকরি হারাচ্ছেন।’

তিনি উদাহরণ টেনে বলেন, ‘ময়মনসিংহের ভালুকা কলেজের (জাতীয়করণ হওয়া) ৫৪ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ১৮ জনই বাদ পড়েছে, ত্রিশাল কলেজের ৫২ জন শিক্ষক-কর্মচারীর মধ্যে ২০ জন বাদ পড়েছে। তারা কেন বাদ পড়বেন? আমাদের কাছে এরকম ২০/৩০টি কলেজের উদাহরণ রয়েছে।’

জনবল আত্তীকরণ প্রক্রিয়ার সর্বশেষ অবস্থা সর্ম্পকে যাচাই-বাছাই কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘১৯টি প্রতিষ্ঠানের যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। আরও শতাধিক প্রতিষ্ঠানের তালিকা যাচাই-বাছাইয়ের কাজ শেষ হয়েছে। জনপ্রশাসন থেকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে একটি প্রতিষ্ঠানের জনবলের তালিকা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে আমরা জেনেছি।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী, সরকারি কলেজ নেই- এমন সব উপজেলায় একটি করে বেসরকারি কলেজ জাতীয়করণ করা হয়। ২০১৬ সালে এই প্রক্রিয়া শুরু হয়, ২০১৮ সালের মধ্যে ৩০২টি কলেজ জাতীয়করণের প্রজ্ঞাপন জারি হয়। এরমধ্যে ২০১৮ সালের আগস্টের মধ্যে ২৭১টি এবং পরবর্তীতে ওই বছরের মধ্যেই আরও ৩১টি কলেজকে সরকারি করা হয়। সব মিলিয়ে মোট ৩০২টি বেসরকারি (এমপিওভুক্ত) কলেজ সরকারি বা জাতীয়করণ করা হয়।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মাহবুব হোসেন সম্প্রতি এক প্রেস কনফারেন্সে জানান, ‘জাতীয়করণ হওয়া কলেজগুলোর জনবল আত্তীকরণের কাজ আগে একটি কমিটি করেছিল, তা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আমি পাঁচটি কমিটি করে দিয়েছি। তারা নিয়মিত কাজ করছেন। কোন শিক্ষক-কর্মচারীই ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হবেন না।’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, সরকারি হওয়া ৩০২টি কলেজের মোট ১২ হাজার ৫৫৬ জন এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন। আর নন-এমপিও শিক্ষক-কর্মচারী ছিলেন ৪ হাজার ৫৬৫ জন। সব শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) প্রতিনিধি ছিলেন। কিন্তু বারবার যাচাই-বাছাইয়ের কারণে অনেক শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি পাওয়া যাচ্ছে, এতে তারা চাকরি থেকে বাদ পড়ছেন।

জাতীয়করণ প্রক্রিয়ায় শিক্ষক-কর্মচারী চাকরি হারালে এর জন্য সরকারি প্রতিনিধিরা (নিয়োগকালীন) দায় এড়াতে পারেন কীনা জানতে চাইলে মাউশি’র পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) প্রফেসর শাহেদুল কবির চৌধুরী বলেন, ‘নিয়োগ প্রক্রিয়ায় অনিয়ম, গাফিলতি থাকলে মাউশির প্রতিনিধি দায় এড়াতে পারেন না। কিন্তু নিয়োগের পর অনেকের সার্টিফিকেটে (সনদ) ত্রুটি ধরা পড়লেও প্রতিনিধিকে দায়ী করা যায় না, কারণ নিয়োগের সময় শর্ত থাকে সনদ যাচাই-বাছাইয়ে ত্রুটি থাকলে আবেদনকারী দায়ী থাকবেন। তবে ত্রুটিপূর্ণ সার্টিফিকেটে কেউ যদি এমপিও পেয়ে থাকে সেক্ষেত্রে এমপিও প্রদানকারী কর্মকর্তারা দায় এড়াতে পারেন না।’

এ ব্যাপারে ‘সকশিস’ সাধারণ সম্পাদক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘সরকারি বিধিবিধানের আলোকেই এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ দেয়া হয়। প্রত্যেক শিক্ষকের নিয়োগ কমিটিতেই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা মাউশি’র একজন প্রতিনিধি থাকেন। এক্ষেত্রে নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি থাকলে শিক্ষক দায়ী হবেন কেন?’

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন যুগ্মসচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানে সব শিক্ষকের নিয়োগ প্রক্রিয়ায় একজন সরকারি প্রতিনিধি থাকেন। পরবর্তীতে ওই শিক্ষকের এমপিওভুক্তির আবেদন করলে থানা বা উপজেলা, জেলা ও বিভাগীয় কর্মকর্তা এবং মাউশি’র পক্ষ্য থেকে যাবতীয় কাগজপত্র পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর এমপিওভুক্তি করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় আবেদনকারীর চেয়েও বেশি দায়ী সরকারি কর্মকর্তারা।’

চাকরি থেকে বাদপড়া শিক্ষক-কর্মচারীর বিষয়ে ওই কর্মকর্তা জানান, নিয়োগ প্রক্রিয়ায় ত্রুটি, জনবল কাঠামো উপেক্ষা করে শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগ, শূন্যপদের অতিরিক্ত শিক্ষক নিয়োগ, আগে নিয়োগ পরে সনদ ও জাল সনদে নিয়োগ দেয়ার কারণেই কেউ কেউ বাদ পড়ছেন। এছাড়া অনার্স-মাস্টার্স পাঠদানকারী শিক্ষকও আছেন, যাদের এমপিওভুক্তির সুযোগ নেই।