এনাম আবেদীন ,  কালেরকন্ঠ

দানা বাঁধছে না সরকারবিরোধী আন্দোলন, চলমান স্থানীয় নির্বাচনে দেখা মিলছে না আলোর রোশনাই, রাজনৈতিক মাঠেও নেই সুবাতাস। সব কিছু মিলিয়ে হতাশায় বুঁদ বিরোধী শিবির। সেই হতাশা থেকে বেরিয়ে আসতে মাঝেমধ্যেই গুঞ্জন ওঠে তৃতীয় শক্তির। হয় মুখরোচক আলোচনা, মেলে ডালপালা। একসময় ‘শক্তি’ হারায় তৃতীয় শক্তি।

আবারও গুঞ্জন উঠেছে তৃতীয় শক্তির তৎপরতার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বাইরে কোথাও নতুন কোনো উদ্যোগের কথা উঠলেই ফুলে ওঠে প্রত্যাশার বেলুন। এবারের তৎপরতায় উচ্চপদস্থ সামরিক ও বেসামরিক সাবেক আমলাদের পাশাপাশি সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারাও ভিড় করছেন, যদিও তাঁদের অনেকে না বুঝে আবার কেউ কেউ ব্যক্তিগত সম্পর্কের সূত্র ধরেও সেখানে ছুটছেন। তবে বিএনপি ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ওই তৎপরতার ওপর চোখ রাখলেও বিষয়টিতে খুব বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে না।

সর্বশেষ গত শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল (অব.) সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের উদ্যোগে এক দোয়া মাহফিলে হাজির হয়েছিলেন অর্ধশতাধিক সামরিক ও বেসামরিক সাবেক আমলা। এ ছাড়া বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের জামায়াত ও ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি শরিক দলের নেতাদের পাশাপাশি সমর্থক সুধীসমাজের প্রতিনিধি এবং তৃতীয় ধারার এবি পার্টির নেতাসহ অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সিগুলো নজর রাখলেও ওই তৎপরতায় কোনো বাধা দেওয়া হয়নি।

গেল শনিবারের জমায়েতে উপস্থিত বিএনপির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘হোটেলের প্রধান গেটে পাঁচ পুলিশ সদস্য দাঁড়িয়ে থাকলেই সেদিন ভয়ে অনেকে যেতেন না। সম্ভবত সরকার এখন মনে করছে এরা এসব নিয়ে আশায় আশায় দিন পার করুক।’

ওই জমায়েতে উপস্থিত নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, মেজর জেনারেল (অব.) ইবরাহিমের ডাকে কৌতূহলবশত তাঁরা সেখানে গেছেন। এ ছাড়া সরকারবিরোধী (পক্ষান্তরে বিএনপিপন্থী) বলে পরিচিত এসব নেতার মধ্যে ওই ধরনের আয়োজন ঘিরে ‘যদি কিছু হয়’ এমন এক ধরনের প্রত্যাশাও আছে। কারণ রাজপথের বিরোধী দল হওয়ার পরও এক যুগে বিএনপি জোটের নেতৃত্বে বড় ধরনের কোনো আন্দোলন দানা বাঁধেনি। ফলে সরকারবিরোধীদের মনে বাসা বেঁধেছে হতাশা। ‘বিএনপি পারছে না, দেখি না অন্য কেউ পারে কি না’—এমন প্রত্যাশা থেকে সেদিন অনেকে অংশ নিয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট নেতাদের কথায় উঠে এসেছে।

সূত্র মতে, এ কারণে বিএনপি এ ধরনের উদ্যোগে বাধাও দিচ্ছে না। কারণ তৎপরতার সঙ্গে যুক্ত থাকা ব্যক্তিরা সরকারবিরোধী। আবার সর্বশক্তি নিয়ে বিএনপি শামিলও হচ্ছে না। কারণ সরকারবিরোধী আন্দোলন বা অন্য কোনো ঘটনার নিয়ন্ত্রণ তারা হাতে রাখতে চাইছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে ক্ষমতার পালাবদলে শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর অবস্থানও তারা দেখে নিতে চায়। পাশাপাশি এসব উদ্যোগের নেপথ্যের কুশীলব ও শক্তি কারা এবং তাদের অর্থ জোগানদাতার উৎস ও উদ্দেশ্য নিয়েও বিএনপির মধ্যে প্রশ্ন আছে। ফলে দ্বিদলীয় রাজনীতির বাইরের ওই তৎপরতার দিকে তারা আপাতত পর্যবেক্ষণ করার পক্ষপাতী।

সূত্র জানায়, রাজনীতির এই হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় নিয়েই শেষ মুহূর্তে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আমন্ত্রিত হওয়ার পরও ওই দোয়া মাহফিলে যাননি। তিনি গেলে উদ্যোক্তারা আরো বেশি সফল হতেন। একই কারণে গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. রেজা কিবরিয়াও ওই অনুষ্ঠানে যাননি। তিনি গেলে পক্ষান্তরে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টেরই অংশ নেওয়া হতো।

যদিও ওই অনুষ্ঠানে গেছেন নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না। তিনি বলেন, ‘আগে থেকে ওই অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমি কিছু জানতাম না। তা ছাড়া জোটগতভাবে নয়, ব্যক্তিগতভাবে ওই অনুষ্ঠানে গিয়েছি।’

সরকার পতনের লক্ষ্যে গত ১৪ ডিসেম্বর মুক্তাঙ্গনে সরকারবিরোধী সমাবেশও ‘তৃতীয় শক্তির’ তৎপরতা হিসেবে রাজনীতিতে আলোচিত হয়। তবে সিদ্ধান্ত নিয়েই বিএনপির হাইকমান্ড ওই সমাবেশ ‘দুর্বল’ করে দেয়। দলের ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ ও শওকত মাহমুদকে শোকজ করেও দলের নেতাকর্মীদের বার্তা দেন তারেক রহমান।

শনিবারের সমাবেশে শওকত মাহমুদ না গেলেও অংশ নিয়েছেন হাফিজ উদ্দিন আহম্মদ, সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এহছানুল হক মিলন, নিলোফার চৌধুরী মনি ও ব্যারিস্টার মেজর (অব.) সারোয়ার হোসেন।

এ ব্যাপারে হাফিজ উদ্দিন বলেন, ‘ইবরাহিম সাহেবের দাওয়াতে অনেক মুক্তিযোদ্ধা অংশ নিয়েছেন। একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে অংশ নিয়েছি। এর মধ্যে কোনো রাজনীতি নেই।’

মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘ইবরাহিম সাহেব ২০ দলীয় জোটে আছেন। তিনি বিএনপির কর্মসূচিতে আসেন। সে হিসেবে আমরাও গেছি।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগে লং টার্ম কিছু থাকতে পারে। তবে শর্ট টার্ম কোনো লাভ হবে বলে মনে হয় না।’

সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম বলেন, ‘বিভিন্ন সময় উচ্চপদে থেকে যাঁরা দেশকে শার্প করেছেন—এমন ব্যক্তিরা মনে করেন, দেশ এভাবে চলতে পারে না। তাই এক ধরনের প্রত্যাশা থেকে মানুষ আমার ডাকে সাড়া দিয়েছে। তা ছাড়া বিএনপি অনেক দিন চেষ্টা করেও সরকারের বিরুদ্ধে কিছু করতে পারছে না। সমাজের সচেতন মহল তাই হতাশা থেকেও নতুন পথ খুঁজছে।’

বিএনপি কিছু পারছে না—এমন অজুহাতে এর আগে ২০১৯ সালের জুনে এলডিপির সভাপতি ড. অলি আহমদের নেতৃত্বে জাতীয় মুক্তমঞ্চ নামের আলাদা একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা হয়। ওই সময়ও জামায়াত ও কল্যাণ পার্টির সৈয়দ ইবরাহিমসহ ২০ দলীয় জোটের কয়েকটি দলের নেতারা তাঁর পাশে ছিলেন। ‘অলি আহমদ সিগন্যাল পেয়ে মাঠে নেমেছেন’—এমন গুঞ্জন তৈরি হয় তখনো। কিছুদিন পরে অবশ্য অলির তৎপরতা থেমে যায়। এরপর গত ১৪ ডিসেম্বর মুক্তাঙ্গনের ঘটনা বেশ আলোচিত হয়।

ইবরাহিমের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ পেয়েছেন কি না জানতে চাইলে অলি আহমদ গতকাল সোমবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমন্ত্রণ পেলেও করোনার কারণে দোয়া মাহফিলে যাইনি। এলডিপির মহাসচিবও নির্বাচনে ব্যস্তততার কারণে যেতে পারেননি।’

জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম শনিবারের বৈঠকে উপস্থিত হওয়া সম্পর্কে বলেন, ‘মিলাদ মাহফিলে উপস্থিত সবার মধ্যে ঐক্যের সুর লক্ষ করা গেছে। ঐক্যবদ্ধ হয়ে সবাই আন্দোলন-সংগ্রাম চায়, এটাই বক্তব্যে সবাই বলেছেন। দেশের এই দুঃসময়ে সবাই উত্তরণ ঘটানোর পক্ষে।’