বদরুল ইসলাম বাদল 

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। শুধু একটি দিনের আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে মনে করার নয়। বাংলাদেশের অগ্রযাত্রার প্রতিটি ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হয় বলে আমি এবং অনেকেই বিশ্বাস করে। এই তো কয়েক দিন আগে মাতারবাড়ীতে পানামার পতাকাবাহী বিশালাকার জাহাজ নোঙরের অনুভূতির মাঝে বঙ্গবন্ধুর দেশে ফেরার উচ্ছ্বাস খুঁজে পাই। বিজয়ের মাসে পদ্মা সেতুর শেষ স্প্যান বসানোর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে এবং দেশের মানুষের আনন্দ উল্লাসের মাঝে জাতির মহানায়কের দেশে ফেরার প্রতিচ্ছবি ভেসে উঠে। আমরা কক্সবাজার বাসী রেলের লাইনে ,আন্তর্জাতিক মানের বিমান বন্দর, কয়লা বিদ্যুৎসহ বিশ্বের সাথে তুল্যমান মেগা প্রকল্পের সমস্ত জায়গায় বঙ্গবন্ধুর দেশের মাটিতে ফিরে আসার আত্মহারা আত্মপ্রকাশ দেখতে পাই। মনে ভেসে উঠে সত্তরের দশকের জনপ্রিয় গান

মুজিব বাইয়া যাও রে, নির্যাতিত দেশের মাঝে, জনগণের নাও রে মুজিব, বাইয়া যাও রে- হাজার ঝড় তোপানের মাঝেও জাতিকে সঠিক ঠিকানায় পৌঁছে দেয়ার আবেদন বঙ্গবন্ধুর প্রতি।সেই থেকে আজ পর্যন্ত জাতির মাঝে শক্তি যোগিয়ে যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গীতি কবির ভাষায় ,অন্যায় অবিচার জোর জুলুমের প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুই পারেন আমাদের পথ দেখাতে। তাই আজও বাঙালি গেয়ে চলে-“মুজিব বাইয়া যাও রে–।

উপনিবেশীক পাকিস্তান শাসক গোষ্ঠীর নাগপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করতে লড়াই করে, শক্ত হাতে বৈইঠা ধরে দেশকে স্বাধীনতা এনে দেন বঙ্গবন্ধু। সেই থেকে উন্নয়ন কিংবা আন্দোলন সংগ্রামের প্রতিটি পদক্ষেপের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর চেতনা ফিরে পায় জাতি। হাজার বছর আগে থেকে বাঙালি জাতি একটি উদিত সূর্যের অপেক্ষা করেছিল। যার হাতের যাদুর পরশে বাঙালি জাতি নিজের অস্তিত্বের জায়গা খুঁজে পায়।কিন্তু সভ্যতার ক্রমবিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন জনে ভিন্ন দৃষ্টি কোন থেকে স্বাধীনতার সপ্ন দেখান।কিন্তু ভূখন্ডের এই অঞ্চলের শ্রেণি বৈষম্য, শ্রেণি বিন্যাস, আবেগ অনুভূতি বুঝতে পারেন বঙ্গবন্ধু মুজিব। কারণ তিনি মানুষের দুঃখ, দৈন্যতা অবলোকন করেন গাঁয়ের মেঠো পথে হেটে হেটে। নদীমাতৃক এই দেশের বিভিন্ন নদী পথ দিয়ে পালতোলা নৌকায় চড়ে। তাই তিনি স্বাধীনতা ভিন্ন বিকল্প কিছু চিন্তা করেন নাই।বিশ্বসেরা রাজনৈতিক গবেষকদের ধারণায় পৃথিবীর বিখ্যাত রাজনীতির কবি বঙ্গবন্ধুর সহজ সরল ভাষায় বাস্তব ভিত্তিক বক্তব্য উপস্থাপনার মাধ্যমে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যায়। তিনি জাতিকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছেন, উজ্জীবিত করতে পেরেছেন, স্বাধীনতার মন্ত্রে।

কিন্তু সে পথটি ছিল বড় পিচ্ছিল। তাই অনেক কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে বঙ্গবন্ধুকে। জাতিকে। সুদীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনের বারটি বছর বিভিন্ন সময়ে কারাগারে কাটিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। মামলা মোকদ্দমা লেগেই থাকতো। এক মামলা থেকে খালাসের পর কারাগারের গেইটে আবার অন্য মামলার আসামি দেখিয়ে গ্রেফতার করা হয়েছে অনেক বার। অমানবিক অত্যাচার করা হয়েছে।

পঁচিশের মার্চের কালো রাতে পাক হানাদার বাহিনী নির্বিচারে নিরস্ত্র বাঙালির উপর হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। সাথে সাথে বঙ্গবন্ধু মুজিব ছাব্বিশের মার্চের প্রথম পহরে আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলে বঙ্গবন্ধুকে বন্দী করে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তার পরের ইতিহাস জানা সকলের জানা ইতিহাস।নানা অত্যাচার নির্যাতন এবং মেরে ফেলার ভয় দেখায়ে ও বঙ্গবন্ধুকে বশ্যতা স্বীকার করাতে পারে নাই। স্বাধীনতার প্রশ্নে অনড় থাকে।নিজের প্রাণকে তুচ্ছ ভেবে জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার শপথে অবিচল থাকে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের লালিত সপ্ন স্বাধীনতা ছাড়া আপোসের দিকে যান নাই। এরকম ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন নেতা এ অঞ্চলে কার ও সাথে তুলনা করা যায় না। শুধু বঙ্গবন্ধুর সাথে তুলনা করা যায় আমেরিকার আব্রাহাম লিংকনের সাথে,ইন্দোনেশিয়ার সুকার্নো,ভিয়েতনামের হো চি মিন আর দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন মেন্ডেলার সাথে। তাই আন্তর্জাতিক চাপ এবং বিশ্ব জনমতের কারণে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাঙালি জাতির বিজয়ের পর পরই বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে দিতে বাধ্য হয় পাকিস্তান সরকার।

দশই জানুয়ারী বাহাত্তর বীরের বেশে দেশের মাটিতে ফিরে আসেন বঙ্গবন্ধু। আর বাঙালি জাতি তাদের ঘরের ছেলে কে মুক্ত জীবন্ত ফিরে পেয়ে খুশীতে আত্মহারা হয়ে যায়। গগন বিদারী শ্লোগানে শ্লোগানে বাংলাদেশের আকাশ বাতাস মুখরিত করে স্বাগত জানায়। দেশের মানুষের ভালবাসা উপলদ্ধি করে বঙ্গবন্ধু আবেগাপ্লুত হয়ে যায়। শিশুদের মত কেঁদে ফেলে।

তারপর জাতিকে পুনঃগঠনের জন্য দীপ্ত শপথ করেন। কারণ তিনি স্বাধীনতার আন্দোলনকে শুধু পাকিস্তান উপনিবেশ থেকে মুক্ত করার আন্দোলন হিসেবে দেখেননি ।বাংলাদেশের মানুষের মৌলিক অধিকার তথা অর্থনৈতিক,রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি,ক্ষুধা মুক্ত বৈষম্যহীন দেশ গড়ার সংগ্রাম হিসেবে দেখেন। সমস্ত জাতিকে ভেদাভেদ ভুলে গিয়ে এক সাথে কাজ করার আহ্বান জানান। সেই নিরিখে তিনি পরবর্তী পর্যায়ে “শোষিতের গনতন্ত্রের” কথা বলেন।

কিন্তু এই ঘোষণা মেনে নিতে পারে নাই-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। পুঁজিবাদী বিশ্ব এবং সুবিধাভোগী মুৎসুদ্দী গোষ্ঠী। স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি এবং দেশীয় এজেন্টরা সে সুযোগ ব্যবহার করে বিদেশি ষড়যন্ত্রের সাথে একাত্ম হয়ে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। কে বা কারা হত্যা করেছে আজ কারও অজানা নয়। হত্যাকারীদের শাস্তি না দিয়ে পুরস্কৃত করে বাংলাদেশ পররাষ্ট্র মন্ত্রানালয়ের অধীনে কারা চাকরি দিয়েছেন সবার জানা। শুধু তাই নয় ১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় প্রচার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর নাম কিংবা ছবি প্রদর্শন নিষিদ্ধ ছিল।

বঙ্গবন্ধু কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর আজ নতুন ভাবে বঙ্গবন্ধুর দেখা সোনার বাংলার প্রাণ ফিরে পায়। হাজার প্রতিকুল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আজ বাংলাদেশ বিশ্ব দরবারে অনুকরণীয় মডেল। তাই বলা যায় বঙ্গবন্ধু আছে আমাদের চেতনায়। আমাদের উন্নয়নে। শিক্ষা সংস্কৃতি ও প্রগতির বিকাশের মাঝে। প্রতিদিন প্রত্যাবর্তন হয় বঙ্গবন্ধুর। বাংলাদেশের মানুষের চেতনায়,আনন্দ আহ্লাদে, মাঠের সোনালি ফসলে, কৃষকের হাসি আর বাঙালীর বাঙালীপনায়। প্রেরণার উৎস হয়ে বেচে থাকবে আজীবন। কবির ভাষা-

যতদিন রবে পদ্মা যমুনা

গৌরী যমুনা বহমান

ততকাল রবে কৃর্তি তোমার

শেখ মুজিবুর রহমান।

বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসের তাৎপর্য ও রাজনৈতিক আলোচনা করার সাথে সাথে নতুন প্রজন্মকে বঙ্গবন্ধু দর্শন এবং সপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের কর্মসূচি নিয়ে জ্ঞান অর্জনের উদ্বুদ্ধ করা দরকার। কারণ বঙ্গবন্ধু কন্যা আজ ক্ষমতায়। কর্মীর সংখ্যা কিংবা সমর্থকদের অভাব নাই। সু-সময়ে বন্ধুর অভাব হয় না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। দুর্যোগে হাল ধরে দলকে প্রতিকুল পরিস্থিতি থেকে টিকিয়ে রাখতে একমাত্র আদর্শীক কর্মীদের দ্বারাই সম্ভব। তাই বঙ্গবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের বছরে বঙ্গবন্ধু চর্চা করা অতীব জরুরী।

জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ চিরজীবী হউক ।

 

লেখক: বদরুল ইসলাম বাদল, ঢেমুশিয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার ও নব্বই দশকের সাবেক ছাত্রনেতা।