মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে দীর্ঘ ২৬ দিন কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে থাকার পর লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ রামু’র কাউয়ার খোপ জাদিমুরা বৌদ্ধ মহাশ্মশানে সৎকার করা হয়েছে। সোমবার ৪ জানুয়ারী বিকেল ৫ টার দিকে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ সৎকার করা হয়। এর আগে আদালতের নির্দেশে লাকিং মে চাকমা’র ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করার পর সোমবার ৪ জানুয়ারী বিকেল ৩টার দিকে মৃতদেহটি তদন্তকারী কর্মকর্তা লাকিং মে চাকমা’র পিতার কাছে হস্তান্তর করেন।

বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম কক্সবাজার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক মং থ্যালা রাখাইন বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। মং থ্যালা চাকমা আরো জানান, লাকিং মে চাকমা’র অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকায় হয়ত বিচারকার্যের প্রয়োজনে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ পূণ ময়নাতদন্ত করাও হতে পারে। এছাড়া লাকিং মে চাকমা’র গ্রামের বাড়ি টেকনাফের বাহারছরা ইউনিয়নের শীলখালী চাকমাপাড়ায় মৃতদেহটি সৎকার করা হলে দুষ্কৃতিকারীরা হয়তোবা সেখান থেকে গোপনে লাশটি উঠিয়ে নিরুদ্দেশ করে ফেলার আশংকাও রয়েছে। তাই লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ পোড়ানো হয়নি। চাকমা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে রামু’র কাউয়ারখোপ ইউনিয়নের জাদিমুরা বৌদ্ধ মহাশ্মশানে মাটি চাপা দিয়ে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহটি সৎকার করা হয়েছে।

আদিবাসী ফোরামের নেতা মং থ্যালা রাখাইন আরো জানান, লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ সৎকার করার সময় রামু সীমা মহাবিহারের প্রধান প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু ও তার শিষ্যগণ, লাকিং মে চাকমা’র পিতা লালা অং চাকমা, মাতা-মা কেচিং চাকমা সহ প্রায় অর্ধশত চাকমা ধর্মালম্বী নারীপুরুষ উপস্থিত ছিলেন।

ছবি: লাকিং মে চাকমা’র স্বামী দাবিদার আতাউল্লাহ।

প্রসঙ্গত, টেকনাফের বাহারছরা ইউনিয়নের শীলখালী চাকমাপাড়ার লালা অং চাকমা ও মা কেচিং চাকমা’র প্রায় ১৫ বছর বয়সী কণ্যা লাকিং মে চাকমা ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারী নিখোঁজ হয়। একই সালের ১৫ জানুয়ারী লাকিং মে চাকমা’র পিতা লালা অং চাকমা বাদী হয়ে তার মেয়ে লাকিং মে চাকমাকে অপহরণ করা হয়েছে মর্মে অভিযোগ এনে কক্সবাজার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এ একটি মামলা দায়ের করে। মামলা নম্বর সিপি : ১৭/২০২০ ইংরেজি। মামলায় টেকনাফের বাহারছরা ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের মাথারভাঙ্গা গ্রামের নুর আহমদের পুত্র আতাউল্লাহকে প্রধান করে মোট ৯ জনকে আসামী করা হয়।

বিজ্ঞ আদালত মামলাটি তদন্তের জন্য কক্সবাজার পিবিআই কে নির্দেশ দেন। লাকিং মে চাকমাকে অপহরণ করা হয়নি, সে স্বেচ্ছায় মামলার প্রধান আসামী আতাউল্লাহ’র সাথে চলে গেছে বলে উল্লেখ করে পিবিআই এর উপপরিদর্শক এবং মামলার আইও কৈশনু মার্মা গত ২০২০ সালের ৯ আগস্ট আদালতে তার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদন আগামী আগামী ১০ ফেব্রুয়ারী শুনানির জন্য দিন ধার্য করেন।

এরই মধ্যে গত ২০২০ সালের ১০ ডিসেম্বর কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ ময়নাতদন্তের জন্য আনা হয়। তখন লাকিং মে চাকমা’র পিতা লালা অং চাকমা খবর পেয়ে মর্গে এসে তার নিখোঁজ কন্যা লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ দেখতে পায়। লালা অং চাকমা তার কন্যাকে হত্যা করা হয়েছে বলে দাবি করে তার কন্যার লাশ তাকে দেওয়ার আবেদন জানায়।

অপরদিকে, অপহরণ মামলার প্রধান আসামী আতাউল্লাহ লাকিং মে চাকমা’কে তার স্ত্রী দাবি করে লাকিং মে চাকমা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাকে বিয়ে করেছে বলে জানায়। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর লাকিং মে চাকমা’র নাম রাখা হয়-হালিমাতুল সাদিয়া। লাকিং মে চাকমা তার স্বামী আতাউল্লাহ’র সাথে ঝগড়া করে বিষপানে আত্মহত্যা করেছে বলে জানিয়ে স্ত্রী হিসাবে লাকিং মে চাকমা’র লাশ সেও দাবি করে। লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ নেওয়ার দাবি নিয়ে ২ পক্ষের টানাটানিতে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালের মর্গে রেখে দেওয়া হয়।

ছবি: লাকিং মে চাকমা’র মাতা কেচিং চাকমা।

এ অবস্থায় লাকিং মে চাকমা’র পিতা লালাঅং চাকমা গত ১৫ ডিসেম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এ কন্যার লাশ দাবি করে আবেদন করেন। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৩ এর বিজ্ঞ বিচারক (জেলা ও দায়রা জজ) জেবুন্নাহার আয়শা আবেদনটি শুনানি শেষে তদন্তপূর্বক মর্গে রাখা লাশের ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে প্রকৃত হকদারকে লাশ হস্তান্তরের জন্য র‍্যাব-১৫ কে নির্দেশ দেন।

র‍্যাব-১৫ এর তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই অঞ্জন চৌধুরী তদন্তকালে জানতে পারেন-লাকিং মে চাকমা’র পিএসসি সনদ ও জন্মনিবন্ধন সনদ মতে জম্ম তারিখ ২০০৫ সালের ২ মার্চ। অর্থাৎ অপহরণের দিন লাকিং মে চাকমা’র বয়স ছিলো ১৪ বছর ১০ মাস ৩ দিন। লাকিং মে চাকমা’র কথিত স্বামীর দাবিদার আতাউল্লাহ সূদুর কুমিল্লাতে লাকিং মে চাকমাকে নিয়ে জাল জন্মনিবন্ধন সনদ তৈরি করে প্রথমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ ও পরে সেই জাল জন্মনিবন্ধন সনদ কাজী অফিসে দিয়ে বিয়ে করেন। আইনের দৃষ্টিতে লাকিং মে চাকমা এখনো শিশু বিবেচনায় মর্গে রাখা তার লাশ পিতা লালা অং চাকমাকে হস্তান্তর করা যেতে পারে মর্মে র‍্যাব-১৫ এর আইও এসআই অঞ্জন চৌধুরী আদালতকে অবহিত করেন। পরে সোমবার ৪ জানুয়ারী বিকেল ৩ টার দিকে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ মারা যাওয়ার ২৬ দিন পর আইও এসআই অঞ্জন চৌধুরী ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ লালা অং চাকমাকে হস্তান্তর করেন।

লাকিং মে চাকমা’র অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যু নিয়ে আদালতে মামলা চলমান থাকায় হয়ত বিচারকার্যের প্রয়োজনে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ পূণ ময়নাতদন্ত করাও হতে পারে। এছাড়া লাকিং মে চাকমা’র গ্রামের বাড়ি টেকনাফের বাহারছরা ইউনিয়নের শীলখালী চাকমাপাড়ায় মৃতদেহটি সৎকার করা হলে দুষ্কৃতিকারীরা হয়তোবা সেখান থেকে লাশটি উঠিয়ে নিরুদ্দেশ করে ফেলার আশংকাও রয়েছে। তাই লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহ পোড়ানো হয়নি। চাকমা ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পন্ন করে রামু’র কাউয়ার খোপ ইউনিয়নের জাদিমুরা বৌদ্ধ মহাশ্মশানে মাটি চাপা দিয়ে লাকিং মে চাকমা’র মৃতদেহটি সৎকার করা হয়েছে।

এদিকে, বিজ্ঞ আদালতের নির্দেশনা মতে লাকিং মে চাকমা’র ধর্মীয় পরিচয় নিশ্চিত করে তার লাশ পিতা লালা অং চাকমাকে হস্তান্তর করায় সন্তোষ প্রকাশ করছেন-বৌদ্ধ ধর্মীয় কল্যান ট্রাস্টের ট্রাস্টি ও কক্সবাজার জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি এডভোকেট দীপংকর বড়ুয়া পিন্টু।