তাওহীদুল ইসলাম নূরী

২০২০ সাল। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম যখনই বছরটির কথা উচ্চারণ করবে তখনই করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন, সামাজিক দূরত্ব, মাস্ক এবং হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার, নিজে আক্রান্ত বা স্বজনদের করোনায় আক্রান্ত হওয়া কিংবা এতে বাংলাদেশসহ বিশ্বের লাখ লাখ তাজা প্রাণ ঝরে যাওয়া প্রত্যক্ষ করার করুণ স্মৃতি নাড়া দিবে তাদের মাঝে। নিষ্ঠুর এই বছরটিতে প্রাপ্তির তেমন কিছু না থাকলেও রয়েছে হাজার লাখ হারানোর বেদনা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে আমাদের দেশে বছরের শুরু থেকেই করোনার যে শঙ্কা দেশে লক্ষ্য করা যায়, সেটির বাস্তব দেখা মিলে মার্চের শুরুর দিকে (০৮ মার্চ)। বাড়তে থাকে করোনা আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা। একপর্যায়ে দেশে ২৬ মার্চ থেকে লকডাউন ঘোষণা করা হয়। যারফলে, ২০২০ সালে স্বাধীনতা দিবস পালিত হয় নি, যেটা বছরের পর বছর স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তারপরও ক্রমবর্ধমান হারে বাড়তে থাকে করোনা রোগী ও এতে মৃত্যুর সংখ্যা। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত যেটার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ১৩ হাজার ৫১০ জনে, যারমধ্যে ৭ হাজার ৫৫৯ জনের মৃত্যু হয়েছে।

মহামারির এই সময়েও ছিল রেকর্ড সংখ্যক খুন,ধর্ষণ,লুটপাট এবং সড়ক, নৌ পথে দুর্ঘটনা ও এতে নিহতের মিছিল। সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত অফিসার মেজর সিনহা হত্যা, অক্টোবরের দিকে ধর্ষণের হিড়িক এবং বছরের শেষে এসে ভাস্কর্য বিষয়ে দেশের আলেমওলামা এবং সরকারদলীয় লোকজনের পক্ষেবিপক্ষে অবস্থান ছিল দেশব্যাপী আলোচ্য বিষয়। ধর্ষণ ইস্যুতে পূর্বের অনেক বছরকেও হার মানিয়েছে বছরটি। আর, ফ্রান্সের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় আদর্শের বিশ্বমানব হযরত মোহাম্মদ (স.) কে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রদর্শন করার প্রতিবাদে বিশ্বের কোটি কোটি মুসলিম প্রতিবাদের ঝড় তুললে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মসুলমানও সারাদেশে ফ্রান্স সরকারের বিরুদ্ধে মিছিল,সমাবেশ করে তাদের অবস্থান জানাান দেয়।

করোনাভাইরাসের কারণে লকডাউন যেমন ছিল অকল্পনীয়, তেমনি এটার ফল সর্বস্তরের মানুষের জন্য বড় ধরনের নির্মমতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দেশের অর্থনৈতিক চাকা গতিশীল রাখতে করোনার মাঝেও লকডাউন শিথিল করে সামজিক দূরত্ব ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস, আদালত, কলকারখানা খোলার অনুমতি দিলেও ১৭ মার্চ থেকে এখনো বন্ধ রয়েছে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এরফলে একদিকে যেমন শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি শিক্ষকদের বিশেষকরে কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলোর সাথে জড়িত শিক্ষকদের করুণ অবস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছে। জীবন-জীবিকার তাগিদে অনেকে স্কুল বিক্রি কিংবা অনিশ্চয়তার মধ্যে স্কুলের চাকরির আশায় না থেকে দিনমজুরের পথ বেছে নিয়েছেন। তাইতো, এখন সবার একই প্রশ্ন সবকিছু সচল হলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো এখনো বন্ধ কেন? করোনা কি শুধু শিক্ষাঙ্গনে? ২০২০ সালের এইচএসসি পরীক্ষা না নিয়ে পরীক্ষার্থীদের জেএসসি এবং এসএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে অটো পাশের সিদ্ধান্ত এবং অনলাইন ক্লাস ছিল কল্পনাতীত।

অন্যদিকে দেশের অর্থনীতির অবস্থা কয়েক বছর ধরে ভঙ্গুর বললেই চলে। করোনায় সেই ভঙ্গুর অর্থনীতিতেও বড় ধরনের ধ্বস নেমেছে । প্রবাসীদের আয় ছাড়া অর্থনীতির অন্যসব সূচকের নিম্নগামীতাকে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে থাকেন অর্থনীতিবীদরা। করোনার কারণে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো এবং বিশ্বের বিভিন্ন
দেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের আয় রোজগার বন্ধ থাকায় সেই খাত থেকেও দেশের তেমন একটা আয় হয় নি। দেশে করোনা সংক্রমণের আগে অর্থাৎ ২০২০ সালের শুরুর দিকে ব্যাংকে সুদের হার নির্ধারণ নিয়ে চরম বিতর্ক দেখা যায়। আর, বছরের শেষে এসে এই সালকে ঋণখেলাপী ও দাপুটেদের বছর হিসেবে অবিহিত করছেন বিশ্লেষকরা। একইসাথে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে বলছেন এখন থেকে যদি এ ব্যাপারে সবাই সতর্ক না হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে পারে আমাদের অর্থনীতি।

বিশ্বে এ পর্যন্ত করোনায় প্রায় ১৮ লাখ মানুষের প্রাণ ঝরেছে এবং আক্রান্ত হয়েছে আট কোটির উপরে। তাইতো, শুধু বাংলাদেশ নয় সমগ্র বিশ্বেরই অগ্রযাত্রার পথে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে এই করোনা। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক কোন ক্ষেত্রেই করোনার কারণে এমন মহামারীর পরিস্থিতি এবং কিছু দুষ্ট লোকের অপতৎপরতা কিন্ত কারও কখনও কাম্য ছিল না। তবে আশার কথা হচ্ছে করোনা প্রতিরোধক ভ্যাকসিন অতিশীঘ্রই সকলের নাগালে ভিতরে চলে আসতেছে। তাই, আমাদের প্রত্যাশা একটাই ‘একুশে নতুন আলো দেখুক বসুন্ধরা’। আমাদের সবার স্বপ্ন নতুন প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর,সুশৃঙ্খল,কল্যাণময় পৃথিবী। এই স্বপ্ন দেখার কথা আমরা যতটা মুখে বলি তার চেয়ে, আমরা যে যে স্তরে আছি সেখান থেকে কাজের মাধ্যমে আমাদের দায়িত্ববোধের পরিচয় দিতে হবে। মহামারী করোনার বর্তমান পরিস্থিতিতে সমাজিক দূরত্ব বজায় রেখে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর ব্যাপারে স্ব স্ব স্তরের দায়িত্বশীলরা একটি যুগপৎ পরিকল্পনা নিয়ে এগুলে সমস্যাগুলোর অধিকাংশই অদূর ভবিষ্যতে নিরসন হবে এমনটাই বলছেন বিশ্লেষকরা ।

২০২০ সালেই আমরা বাংলাদেশে হারিয়েছি হেফাজত ইসলাম বাংলাদেশের আমরণ আমীর আল্লামা শাহ আহমদ শফি, বায়তুশ শরফের পীর আল্লামা শাহ মোহাম্মদ কুতুব উদ্দিন সাহেবের মত বড় মাপের আধ্যাত্মিক রাহবার এবং বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এমাজউদ্দীন আহমদ ও জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানসহ অনেক কৃতিমানকে। বিশ্ব হারিয়েছে ফুটবল কিংবদন্তি ডিয়েগো ম্যারাডোনাকে।

পরিশেষে প্রত্যাশা একটাই করোনা মহামারীসহ সকল দুঃখ,গ্লানি,অশুভ এবং অকল্যাণের অন্ধকার ভেদ করে ২০২১ সালে আমাদের জীবনে সূচনা হোক একটি সুন্দর,শুভ এবং কল্যাণময় আগামী,…

তাওহীদুল ইসলাম নূরী
আইন বিভাগ (অধ্যয়নরত)
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
শাহারবিল সদর, চকরিয়া, কক্সবাজার।