আদিল চৌধুরী


১৯৭৩- দেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচনের এমন এক সকাল। আমাদের দেউড়ি ঘরের উঠানে এসে পড়ল একটি হুইলি জীপ। হুড় বিহীন গাড়ি। গাড়ির পিছনে জনা তিনেক মানুষ। ড্রাইভারের পাশের আসনে বসা এক সুদর্শন যুবা। গাড়ির উইন্ড শীল্ডের বাম পার্শ্বে গোলবৃত্তের মাঝে একটি কুঁড়ে ঘরের ছবি। নিবাচনী গাড়ি।

তিনি নামছেন। অতঃপর নামছেন। কিশোর বয়সে এত পরিপাটি একজন মানুষকে যেন আমি এই প্রথম দেখছি। অবাক বিস্ময়ে দেখছি। গাড়ির সুবেশী আগন্তÍÍুক- তাঁর বাম পা গাড়ির বাইরে এনে মাটি স্পর্শ করলেন। পায়ে চকচকে কালো অক্সফোর্ড স্যু জুতা। সকালের রোদ সে কালো জুতায় লেগে ঝিলিক দিয়ে উঠলো। চকচকে এ জুতোয় হয়তো চেহারা দেখা যাবে।

মাথা সামান্য সামনে ঝুঁকিয়ে তিনি গাড়ির বাইরে এলেন। কুঁচ কুঁচে ঘন কালো চুল। পিছনের দিকেব্রাশ করা কালো কমপ্লিট স্যুট। কালো টাই, একে বারে দুরস্ত। সুদর্শন যেন এক যুবরাজ। আমি বিষ্ময় নিয়ে দেখছি। প্রথম বারের এই বিস্ময় এবং মুগ্ধতা বাচনিক এবং লৌকিক।

তাঁর পরিচয় জানি না। জীবনে এই প্রথম তাঁকে দেখছি। তিনি আমার বাবার দর্শন চাইলেন। প্রথমে তাকে দেউড়িতে বসানো হল। বসালেন আমাদের দুই গৃহ শিক্ষক বাবু সাধন কুমার দে এবং জনাব মরহুম ওসমান গণি। বাবু সাধন কুমার দে পরে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হন। বর্তমানে অবসর যাপনে আছেন। দ্বিতীয় জন মরহুম ওসমান গণি তিনি রামু উপজেলার খুনিয়া পালং ইউনিয়নের গোয়ালিয়া গ্রামের বাসিন্দা। যাই হোক এই অতিথির আগমন সংবাদ- সম্ভবত বাড়ির কাজের লোক অন্দরে পৌঁছে দিয়েছিল। অতিথি সম্ভাষণে বাবা দেউড়িতে এসে হাজির। বাবাকে তিনি নানা বলে সম্বোধন করলেন। বাবা বললেন, ‘মোশতাক, কি খবর?’-বুঝলাম আগন্তুক ন্যাপ প্রার্থী মোশতাক আহমদ। তিনি গড় গড় করে বলে চললেন নিবাচর্নী হালচাল।

তিনি আমাদের অন্দরের বৈঠক খানায় এলেন। তাঁর গোছানো কথায় আর একবার মুগ্ধ হলাম। আপ্যায়িত করা হল। তিনি চলে গেলেন। মনে মনে বাসনা এলো তাঁর মত বাচন কৌশল রপ্ত করতে হবে। ছাত্রজীবনে তাঁর সাথে বহুবার সাক্ষাৎ হয়েছে। গভীর কোন আলাপ কখনো জমে উঠেনি।

আমাদের গৃহ শিক্ষক সাধন কুমার দে তিনি রামু উপজেলা সদরের বাসিন্দা হওয়ার সুবাদে সেদিন রাতে পড়াতে বসে অধ্যাপক মোশতাক সম্পর্কে- আমরা তিন ভাইয়ের কৌতুহল নিভালেন। জানলাম তিনি বৈচিত্র্য সন্ধানি। কখনো সরকারি কলেজের শিক্ষক, কখনো সামরিক বাহিনীর কর্মকর্তার পদ থেকে পদত্যাগও করেছেন। কোন পেশায় সুনির্দিষ্ট ভাবে আটকে ছিলেন না। বৈচিত্র্য পিয়াসী এই মানুষ কোন পেশাকে একমাত্র অবলম্বন হিসাবে নেননি। ইংরেজি সাহিত্যে তাঁর বিশাল পা-িত্যের খবরও সে রাতে সাধন স্যার দিলেন। ইংরেজির মত কঠিন বিষয় তিনি কিভাবে উতরে উঠলেন তা ভেবে মনে মনে সে রাতে অবাক হয়েছি। কারণ সেই কিশোর বয়েসেই গণিত এবং ইংরেজি ছিল আমার কাছে মূর্তিমান বিভীষিকা। আর ওসমান গণি স্যারের মারের চোঁটে আমি রীতিমত পক্ষাঘাত গ্রস্থ রোগীর মত হয়ে যেতাম। সেই ইংরেজিতেই তিনি…!

দীর্ঘ সময় পার করে বাঙলা সাহিত্যে ¯œাতকোত্তর হয়েছি। গ্রামে ফিরে এসে অখ- অবসর। সময় কাঁটে, আবার সময় কাঁটে না। কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর সাহিত্য আসরে তাঁকে পেলাম। ১৯৭৩-এ আমার দেখা প্রফেসর মোশতাক আর আজকের দেখা মোশতাকের মধ্যে বিশাল পার্থক্য দেখলাম। আজকের দেখা মোশতাক আহমদ কৃশ, পক্ককেশ, ঢিলে ঢালা এবং ইস্ত্রি বিহীন পোষাক পরিহিত। আগের মত কোন জৌলুস নেই। প্রশান্তি তাঁর সারা অবয়বে ছড়িয়ে আছে। বুঝতে বাকী রইল না। প্রচলিত বৃত্তের বাইরে তাঁর অবস্থান তৈরি হয়েছে। আগের রাজ্যপাট পরিত্যাক্ত হয়েছে। বুঝতে পারলাম তিনি অন্যত্র বসতি গেড়েছেন। নিশ্চিত তিনি বিশাল দ্বীপখ- দখল করেছেন। অনুসন্ধানী দৃষ্টি তাঁর মাঝে। তাঁর তীক্ষ্ম পা-িত্যের আঁচ আমার হাঁড়ে এসে লাগল। এ যেন হাঁড় ভাঙ্গে তবুও মন জুড়ায় এমন অবস্থা। আরো ভাল বলা যায়, হাঁড়ে বাতাস লাগা। এ যেন অন্যরকম আরাম লাগা। মাসে দু’বার তাঁর সাথে বসার সুযোগ পেয়ে গেলাম। কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী যেন তাঁর জন্য নির্দিষ্ট করা মঞ্চ। প্রফেসর মোশতাক আহমদের বক্তব্যের জন্য বসে থাকি। তিনি বলে যান আমরা শ্রোতা। সাহিত্য, সঙ্গীত, গল্প, উপন্যাস, ইতিহাস, রাজনীতি, ধর্ম, অর্থনীতি ইত্যাদি ইত্যাদি।

মুগ্ধতা যেন কাটে না। কোন এক আড্ডায় প্রফেসর মোশতাককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ‘রাজনীতি ছাড়লেন কেন?’ তিনি উত্তর দিলেন, ‘‘যেদিন বুঝতে পারলাম রাজনীতি আমার জন্য নয় সেদিন রাজনীতি ছাড়লাম।’’ তাঁর এ কথায় আমি দ্বিতীয় বার মুগ্ধ হলাম। কপিলাবস্তুর যুবরাজ মহামতি সিদ্ধার্থ রাজ্য এবং রাজনীতি ছেড়েছিলেন। দীর্ঘ সময় বিদর্শন জ্ঞান ভাবনায় নিঃসঙ্গ হয়েছিলেন। প্রফেসর মোশতাক আহমদ জনারণ্য ফেলে জনান্তিকে যাত্রা, সেই বোধি লাভের আকাঙ্খা হয়তো। যুবরাজ সিদ্ধার্থ আর যুবরাজ থাকেন নি। তিনি গৌতম বুদ্ধে রূপান্তরিত হয়েছে। বোধি এবং দর্শন তাঁকে নির্বাণ এনে দিয়েছে। দীর্ঘ সময় বিদর্শনের অতলান্তের ডুবে থেকে প্রথম চোখ খুলে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘ইহার উৎপত্তি, উহার উৎপত্তি/ইহা না থাকিলে, উহা থাকে না/ ইহা নিরোধ হইলে, উহা নিরোধ হয়/ পৃথিবীর সকল কিছু, শর্ত সাপেক্ষে হয়/ প্রফেসর মোশতাক সেই শর্তে শর্তবান। তিনি এখন শর্ত মেনে চলেন’।

প্রফেসর মোশতাক সেই জ্ঞানী সন্যাসীতে রূপান্তর হলেন হয়তো। তিনি রাজনীতিকে মুক্তির পথ ভাবতে পারেননি সম্ভবত। কারণ মানুষের সমস্যা এবং নির্বাণ রাজনীতির চাইতেও আর বড় কিছুতে। মানুষের শক্তির বিশালত্ব তাঁর আত্মায় এবং বোধিতে। এ সত্য তিনি বুঝলেন। তিনি রাজনীতি ছাড়লেন। তাঁর দেয়া উত্তরে আমি তৃপ্ত। তাঁর উত্তরে আমি প্রচ- শীতের রাতে বারকোশ জ্বেলে আগুন পোহানোর আরাম অনুভব করলাম, হৃদয়ের গভীরে। আমার দ্বিতীয় বারের এই মুদ্ধতা বাচনিক ও নয়, লৌকিক ও নয়। আমার দ্বিতীয় বারের এই মুদ্ধতা সম্পূর্ণ আত্মিক ও আধ্যাত্মিক। এ দ্বিতীয় বিষ্ময় সম্পূর্ণই দর্শন ও দর্পনে। অনেক দিনের অমীমাংসিত কিছু উত্তর আমি আমার ভিতর হতে ভিতরে চালান করে দিলাম। সেটি নিতান্তই আমার সম্পদ। সম্পত্তি নয়।

দর্শন এবং ধর্মে আছে পরম জ্ঞানী ইশ্বর, তিনি নিজেও নিঃসঙ্গ এবঙ একা। জ্ঞানের পথে যাঁদের যাত্রা- তাঁদের যাত্রা ঈশ্বর মুখী হয়। তাঁরা ও কোন না কোন সময়ে এসে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন। হয়ে পড়েন একা। এই একা অবস্থাতেই মানব বিশাল দর্পনের সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রফেসর মোশতাক সেই নিঃসঙ্গতায় ভুগছেন হয়তো। সেখানে রাজনীতি তাঁর জন্য নয। আমি নিশ্চিত হলাম তিনি বিশাল আয়নার সামনে দাঁড়ানো। তিনি সেখানে শুধু নিজকেই দেখছেন। প্রচলিত মানব সমাজ এবঙ রাজনীতি সেখানে অনুপস্থিত। আয়না জুড়ে যারা অন্ধকার দেখেন রাজনীতি তাদের জন্য। আমার জীবনের মধ্যাহ্নে তাঁর প্রসঙ্গে যতবার ভেবেছি, ততবার ইচ্ছে হয়েছে, আমি তাঁর মত নিঃসঙ্গ হব। একা হব। কিন্তু সমাজ এবঙ বাস্তবতা ভিন্ন।

পুনশ্চঃ

এই লিখাটির মুসাবিদা আরো আগে করা হয়েছিল। ইচ্ছে ছিল আমার প্রকাশিতব্য, গ্রন্থ ‘স্মৃতি’তে এটি তুলে দেব। চেয়েছিলাম এটি পত্রিকান্তরে প্রকাশ করবো না। কিন্তু কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি জনাব মুহম্মদ নূরুল ইসলাম ভাইয়ের ক্রমাগত চাপে লিখাটি অধ্যাপক মোশতাক আহমদ- স্মারক গ্রন্থে প্রকাশের জন্য পেশ করা হল।

লেখক : কবি, সদস্য, স্থায়ী পরিষদ, কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী, সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, উখিয়া উপজেলা।