মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

রামু কলেজের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, জেলার বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ-বুদ্ধিজীবী, ভাষা সৈনিক, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শিক্ষাবিদ প্রফেসর মোশতাক মোস্তাক আহমদ (৮৫) আর নেই। মঙ্গলবার ১ ডিসেম্বর দিবাগত রাত পৌনে ১২ টার দিকে কক্সবাজার জেলা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাহি–রাজেউন)। তাঁর বাড়ি রামু’র ফঁতেখারকুল ইউনিয়নের হাইটুপী এলাকায়।

এর আগে একইদিন বার্ধক্যজনিত বিভিন্ন জটিল রোগে প্রফেসর মোশতাক আহমদ গুরতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতালে ভর্তি করে সেখানে আইসিইউ (নীবিড় পর্যবেক্ষণ কক্ষ)-তে রাখা হয়।

আমাদের গর্বের ধন, কক্সবাজার জেলার অহংকার, কক্সবাজারের বাতিঘর, কক্সবাজার ফাউন্ডেশন কর্তৃক রচিত তিনি কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থের পূণর্লিখন ও ইংরেজিতে অনুবাদ করেন।, মনিষী প্রফেসর মোশতাক আহমদের মৃত্যুর খবরে সমগ্র জেলায় শোকের ছায়া নেমে আসে।

প্রফেসর মোশতাক আহমদের বর্ণাঢ্য জীবন :

মোশতাক আহমদ কক্সবাজার জেলার রামু উপজেলার ফতেখারকুল ইউনিয়নের মন্ডল পাড়া গ্রামে ৮ জানুয়ারি, ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতা: রশিদ আহমদ মাস্টার। তিনি অবসরপ্রাপ্ত সমবায় কর্মকর্তা ছিলেন। পরবর্তীতে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে সহকারি শিক্ষক হিসেবে দীর্ঘদিন নিয়োজিত ছিলেন। মাতা: মুনিরা বেগম।
গ্রামের মক্তবে ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষাজীবন শুরু। ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষা পাশ করেন। ১৯৫৭ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই.এ. পাশ। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে অনার্স সহ বি, এ, পাশ। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইংরেজি বিষয়ে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এম, এ পাশ। সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন।

সাতকানিয়া কলেজে ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক হিসাবে কর্মজীবন শুরু করেন মোশতাক আহমদ। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দে কক্সবাজার কলেজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। উক্ত কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসাবে যোগদান করেন। পরবর্তীতে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজে যোগ দেন। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা কলেজে ইংরেজির প্রভাষক পদে যোগদান করেন। তৎপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ, সিলেট সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম সরকারি কমার্স কলেজে ইংরেজির প্রভাষক হিসাবে কর্মরত ছিলেন। ১৯৬৯ খ্রিস্টাব্দে পদোন্নতি নিয়ে সিলেট সরকারি কলেজে ইংরেজির প্রফেসর হিসাবে যোগদান।

ইতোপূর্বে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে কমিশন্ড অফিসার হিসাবে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে যোগদান। পাকিস্তানীদের সাথে মতবিরোধের কারণে চাকুরীতে ইস্তফা দেন।
১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে রামু থানার ছাত্র-যুবকদের সংগঠিত করে মুক্তিযুদ্ধ সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন। অতঃপর পাক হানাদার বাহিনীর হাতে কক্সবাজারের পতন ঘটলে প্রতিবেশি রাষ্ট্র বার্মায় (মিয়ানমার) শরণার্থী হিসাবে আশ্রয় গ্রহণ। ক্যাপ্টেন (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুস সোবহান এর সহযোগিতায় শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত ছাত্র-যুবক ই,পি,আর (বর্তমান বি, জি, বি) ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের সংগঠিত করে মুক্তিযোদ্ধা বাহিনী গঠন করতঃ কক্সবাজার বিভিন্ন অঞ্চলে শত্রু সেনার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অপারেশনে অংশ গ্রহণ।

১৯৭৪ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম জেলার পটিয়া হুলাইন ছালেহ-নুর কলেজে অধ্যক্ষ পদে যোগদান। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারি মাসে সোভিয়েট ইউনিয়ন গমন। “ইন্টারন্যাশনাল লেনিন স্কুল” অধ্যয়ন করেন। ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দে জুলাই মাসে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। ১৯৮৯ খ্রিস্টাব্দে রামু কলেজ প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় অংশ গ্রহণ ও উক্ত কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে ২০০৫ খ্রিস্টাব্দে এপ্রিল মাসে অবসর গ্রহণ। কক্সবাজার জেলার উচ্চশিক্ষা বিস্তারে পথিকৃতের ভূমিকা পালন। শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর কক্সবাজার জেলার সর্বপ্রথম উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান কক্সবাজার কলেজ (বর্তমানে কক্সবাজার সরকারি কলেজ) স্থাপনে ১৯৬২ সালে উদ্যোগী ভূমিকা গ্রহণ করেন মোশতাক আহমদ।

নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ড. মুহম্মদ ইউনুছ, বিচারপতি তোফাজ্জল ইসলাম, বিচারপতি আমিরুল কবির চৌধুরী, বিচারপতি এম, এ আজিজ, সাবেক সচিব মোফাজ্জল করিম, সাবেক সচিব মঞ্জুর এ মওলা প্রমুখ তাঁর ঘনিষ্টবন্ধু ও সহপাঠি ছিলেন।

তিনি কক্সবাজারের ইতিহাস গ্রন্থের পূণর্লিখন ও ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। গ্রন্থের শিরোনাম “Glimpses of Cox’s Bazar” কক্সবাজার ফাউন্ডেশন কর্তৃক ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত। প্রয়াত কবি আবুল ফারুখ খানের কবিতা গ্রন্থ ‘আত্মক্ষরণ’ এর ইংরেজি অনুবাদ। গ্রন্থের শিরোনাম “”I Bleed” ঢাকা বইমেলায় প্রকাশিত। জীবনানন্দ দাশের নির্বাচিত কবিতার ইংরেজি অনুবাদ। গ্রন্থের শিরোনাম “Gleanings From Jibananda Das কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমী কর্তৃক ২০০২ প্রকাশিত। কবি শাহেদ সাদুল্লাহর কবিতা বইয়ের ইংরেজি অনুবাদ। শিরোনাম Voyage to Destiny.


পুরস্কার : ১৯৯৮ খ্রিস্টাব্দে কক্সবাজার জেলার শ্রেষ্ঠ কলেজ শিক্ষক হিসেবে সরকার কর্তৃক পুরস্কৃত ও সনদপ্রাপ্ত।
২০০৩ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রাম বিভাগের শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান প্রধান (কলেজ) হিসেবে পুরস্কৃত ও সনদ প্রাপ্ত হন মোশতাক আহমদ।
২০০৩ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে জেলার কৃতি কলেজ শিক্ষক হিসেবে পুরস্কৃত ও সনদ পান তিনি। ২০০৫ খ্রীস্টাব্দে কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমীর সাহিত্য পুরস্কার প্রাপ্ত। হেমন্তিকা পুরস্কারে ভূষিত।
২০০৯ সালে ফজল-আম্বিয়া উচ্চ বিদ্যালয় ও কক্সবাজার রাষ্ট্র বিজ্ঞান সমিতি কর্তৃক শিক্ষা ক্ষেত্রে অবদানের স্বীকৃতি
স্বরূপ সম্মাননা প্রদান। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য কালের কন্ঠ ও কক্সবাজার স্বপ্নের সিঁড়ি কর্তৃক পুরস্কৃত।
শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ২০০৯ খ্রিস্টাব্দে প্রথম আলো পুরস্কারে ভূষিত। তিনি বাংলাদেশ বেতার, কক্সবাজার
কেন্দ্রের নিয়মিত কথক ও আলোচক ছিলেন।
সেবামূলক কর্মকাণ্ড : মা ও শিশু হাসপাতালের উপদেষ্টা বোর্ডের সদস্য। রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ (১৯৯১-২০০৬ খ্রিস্টাব্দে নভেম্বর পর্যন্ত) পরিচালনা পরিষদের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন।
জীবন দর্শন “Friendship to all, malice to none তথা বিশ্বমানবতার কল্যাণ সাধন।

(তথ্য সুত্র ও কৃতজ্ঞতা : মুহম্মদ নুরুল ইসলাম, সাবেক সভাপতি, কক্সবাজার প্রেসক্লাব ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি-কক্সবাজার সাহিত্য একাডেমি)।