বিদেশ ডেস্ক:

ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ব্যাপকভাবে বদলে গেছে। সেই বদলে যাওয়া সম্পর্কের মাত্রা ঠিক কতটা ছিল সেটিই যেন এখন দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। বিশ্ব রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে পরিচিত রাশিয়া, চীন এমনকি ন্যাটো মিত্র তুরস্কের কাছ থেকেও এখন পর্যন্ত অভিনন্দন বার্তা পাননি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। কিন্তু ঠিক কেন এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে?

বিশ্ব রাজনীতির মোড়ল হিসেবে হিসেবে পরিচিত যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্টকে অভিনন্দন জানাতে কেন অনীহা ভ্লাদিমির পুতিন, রজব তাইয়্যেব এরদোয়ান কিংবা শি জিনপিং-এর মতো শক্তিমান নেতাদের? এমন প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে বিবিসি ও সিএনএন-এর মতো আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো।

২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বড় গলা করে বলেছিলেন কীভাবে চকলেট কেক খাওয়ার মধ্য দিয়ে তিনি এবং চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি করেছেন। কিন্তু দ্রুত কথিত এই বন্ধুত্ব ধসে পড়েছে। কয়েক দশকের মধ্যে চীন-মার্কিন সম্পর্ক এখন সবচেয়ে তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে।

চীনকে এক হাত নেওয়ার কোনও সুযোগ সাম্প্রতিক সময়ে ট্রাম্প ছাড়েননি। করোনাভাইরাস মহামারির জন্য এককভাবে তিনি চীনকে দায়ী করেছেন। করোনাভাইরাসের নাম দিয়েছেন ‘চায়না ভাইরাস’। চীনের ওপর একের পর এক বাণিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন।

প্রশ্ন হচ্ছে জো বাইডেন কি আলাদা কিছু করবেন? বিবিসি-র যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর বিষয়ক সংবাদদাতা বারবারা প্লেট উশের মনে করেন, চীনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা এবং চীনের “অন্যায় বাণিজ্য নীতির ‘শক্ত বিরোধিতার নীতিতে তেমন কোনও পরিবর্তন হবে না। তবে তার মতে, ‘সুর এবং কৌশলে’ হয়তো কিছুটা বদল দেখা যেতে পারে।

বারবারা প্লেট বলছেন, মি ট্রাম্প যেমন এককভাবে চীনকে চাপে রাখার চেষ্টা করে গেছেন, চাপ দিয়ে বাণিজ্য সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করেছেন। জো বাইডেন হয়তো চীন বিরোধিতায় মিত্রদের আরও সম্পৃক্ত করতে চাইবেন। একইসঙ্গে তিনি হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে চীনের সাথে সহযোগিতার রাস্তা খুঁজবেন।

বেইজিং থেকে বিবিসির জন সাডওয়ার্থ বলছেন, চীনা নেতৃবৃন্দের জন্য জো বাইডেনের বিজয় আরেকটি চ্যালেঞ্জ সামনে এনে দিয়েছে।

তিনি বলেন, ‘অনেক চীনা বিশ্লেষক মনে করেন ট্রাম্পের পরাজয়ে হয়তো চীনা নেতৃত্ব ভেতরে ভেতরে কিছুটা অখুশি। এটা নয় যে তারা ট্রাম্পকে পছন্দ করেন। কিন্তু চীনা নেতারা মনে করেন তিনি আরও চার বছর ক্ষমতায় থাকলে আমেরিকার ভেতর বিভেদ বাড়তো। ফলে আন্তর্জাতিক পরিসরে যুক্তরাষ্ট্র আরও বিচ্ছিন্ন হতো।’

সাডওয়ার্থ বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বড় ইস্যুতে জো বাইডেন সহযোগিতার যে কথা বলছেন সেই সুযোগ হয়তো চীন নেওয়ার চেষ্টা করবে। তবে বিশ্বজুড়ে নতুন করে মিত্রদের সঙ্গে শক্ত জোট তৈরির যে প্রতিশ্রুতি বাইডেন দিয়েছেন সেটা চীন তাদের স্বার্থের পরিপন্থী হিসাবে দেখছে। এর চেয়ে বরং ট্রাম্পের ‘একলা চলো’ নীতিই চীনা নেতৃবৃন্দের কাছে কম বিপজ্জনক ছিল। আর এ কারণেই হয়তো এখনও তারা বাইডেনকে অভিনন্দন বার্তা পাঠাননি।

চীনের মতো রাশিয়াও এখন পর্যন্ত বাইডেনের বিজয় নিয়ে চুপ। বিবিসি-র বারবারা প্লেট মনে করেন, বাইডেনের বিজয়ের ফলে শীর্ষ নেতৃত্ব স্তরে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক বদলে যাবে। ডোনাল্ড ট্রাম্প রাশিয়ার ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা চাপালেও ভ্লাদিমির পুতিনের ব্যাপারে চুপচাপ থাকতেন। একাধিকবার খোলাখুলি বলেছেন, তিনি পুতিনকে পছন্দ করেন। কিন্তু পুতিন সম্পর্কে বাইডেনের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই অন্যরকম হবে।

সিএনএন-কে বাইডেন বলেছেন, রাশিয়াকে তিনি ‘বিরোধী পক্ষ’ বলে মনে করেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এবং আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের টার্গেট করার জন্য তালেবানকে পয়সা দেওয়ার যে অভিযোগ রাশিয়ার বিরুদ্ধে উঠেছে তার শক্ত জবাব তিনি দেবেন।

বারবারা প্লেট বলেন, ‌‘রাশিয়ার ওপর ট্রাম্পের চাপানো নিষেধাজ্ঞা অব্যাহত তো থাকবেই। সেই সঙ্গে বাইডেন রাশিয়ার নীতিতে আরও স্পষ্ট হবেন।’ তবে অস্ত্র সীমিতকরণ চুক্তিতে বাইডেন মস্কোর সঙ্গে কথা বলার পক্ষপাতী। কিন্তু রাশিয়া বাইডেনের বিজয়কে কীভাবে দেখছে?

মস্কো থেকে বিবিসির স্টিভেন রোজেনবার্গ এ প্রসঙ্গে রুশ একটি সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় উদ্ধৃত করেন। এতে বলা হয়েছে, ‘ট্রাম্পের আমলে আমেরিকা-রাশিয়া সম্পর্ক সাগরের তলে গিয়ে ঠেকেছে। আর বাইডেন হলেন ড্রেজারের মতো যিনি সাগরের তল খুঁড়ে ওই সম্পর্ক আরও নিচে নিয়ে যাবেন।’

অনেক রুশ বিশ্লেষক বলছেন একটি ইতিবাচক দিক হলো, বাইডেনকে বোঝা সহজতর হবে। সে কারণে নিরস্ত্রীকরণ চুক্তির মতো ইস্যুতে আপস-মীমাংসা করাটা সহজ হবে। মস্কো হয়তো চেষ্টা করবে ট্রাম্প জামানা পেছনে রেখে হোয়াইট হাউজের সাথে একটি কাজের সম্পর্ক তৈরি করতে। তবে তাতে সাফল্যের কোনও নিশ্চয়তা নেই।

স্বভাবতই বাইডেনের বিজয়ে মস্কো একবারেই খুশি নয়। বরং বাইডেনকে একজন বার্ধক্যগ্রস্ত ব্যক্তি হিসেবে আখ্যায়িত করেছে রুশ মিডিয়া। আর নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্টকে পুতিনের এখনও অভিনন্দন না জানানোর কারণ হিসেবে রুশ সংবাদমাধ্যমগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্রে আনুষ্ঠানিকভাবে ভোট গণনার কার্যক্রম এখনও শেষ হয়নি। ফলে বোধগম্য কারণেই এক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করছে ক্রেমলিন।

তুরস্ক

২০১৬ সালের ১৫ জুলাই তুরস্কের ব্যর্থ সামরিক অভ্যুত্থানের ঘটনায় ওয়াশিংটনের সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কে প্রভাব পড়ে। ব্যাপকভাবে মনে করা হয়, তৎকালীন ওবামা প্রশাসনের পৃষ্ঠপোষকতায় ওই অভ্যুত্থানের চক্রান্ত করা হয়েছিল। আর জো বাইডেন ছিলেন ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট। ওই অভ্যুত্থানের কিছুদিন আগেই তিনি তুরস্ক সফরে গিয়েছিলেন। সর্বশেষ ২০১৯ সালে নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ক্ষমতায় এলে তুরস্কে সরকার পরিবর্তনে উদ্যোগী হওয়ার অঙ্গীকার করেন জো বাইডেন। অন্যদিকে ২০১৬ সালের সামরিক অভ্যুত্থান নস্যাৎ করে দেওয়ায় এরদোয়ানের প্রশংসা করেন বাইডেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নানা বিষয়ে তুরস্কের মতভিন্নতা থাকলেও টাম্পের সঙ্গে এরদোয়ানের ব্যক্তিগত সম্পর্ক কিছু ক্ষেত্রে আঙ্কারাকে সুবিধা এনে দিয়েছে।

মার্কিন এয়ার ডিফেন্স মিসাইল কিনতে ব্যর্থ হয়ে আঙ্কারা রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সংগ্রহ করলে ক্ষুব্ধ হয় ওয়াশিংটন। এ ঘটনায় তুরস্কের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধ আরোপের সুপারিশ করে মার্কিন সিনেট। তবে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতাবলে ট্রাম্প সেটি ঠেকিয়ে দেন।

দুই দেশের সম্পর্কের জটিলতা শুধু সরকার পরিবর্তনের হুমকি কিংবা অর্থনৈতিক ও সামরিক অবরোধের ঝুঁকির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। বরং সিরিয়া ইস্যুতেও দুই দেশের জোরালো মতপার্থক্য রয়েছে। নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারেও সিরিয়ার কুর্দি বিদ্রোহীদের সমর্থন দেওয়ার ইঙ্গিত দেন বাইডেন। আর তুরস্ক জানে, সিরিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে কুর্দি বিদ্রোহীরা যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে পৃথক রাষ্ট্র গঠনে সমর্থ হলে সেটি তুরস্কের ভেতরকার কুর্দি বিদ্রোহীদের উদ্দীপ্ত করে তুলবে।

গত কয়েক বছরে লিবিয়া, ভূমধ্যসাগর ও আজারবাইজানে তুরস্ক যে শক্তিশালী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে; বাইডেন প্রশাসন সেটিকে কীভাবে বিবেচনায় নেবে তা নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে আঙ্কারার।

বাইডেনের আমল আঙ্কারার জন্য সুখকর হবে না এটা বলাই যায়। তবে বাইডেন প্রশাসন তুরস্কের ওপর ভয়াবহ অবরোধ চাপিয়ে দিলে তার পরিণতিতে আঙ্কারা-মস্কোর মধ্যে একটি জোরালো বলয় তৈরি হতে পারে। সেক্ষেত্রে ওয়াশিংটন হয়তো দীর্ঘমেয়াদে ন্যাটো মিত্র একটি দেশকে পুরোপুরি রাশিয়ার দিকে ঠেলে দিতে চাইবে না। তবে শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটা সময়ই বলে দেবে। সূত্র: বিবিসি, সিএনএন, আল জাজিরা।