তাওহীদুল ইসলাম নূরী

দিনের পর দিন দেশে বেড়েই চলছে ধর্ষণের সংখ্যা। “ধর্ষণ, গণধর্ষণ, ধর্ষণের পর হত্যা, আত্নহত্যা” এসব নিত্যকার সংবাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০১৮ সালে যেখানে দেশে ৭৩২ জন ধর্ষণের শিকার হয়েছিল সেখানে ২০১৯ সালে এই নির্মমতায় পড়েছে ১৪১৩ জন নারী। অর্থাৎ আগের বছরের চেয়ে দ্বিগুণ। সংঘটিত ধর্ষণের ঘটনাগুলোর কয়েকটি আমাদের চোখে আসলেও পর্দার অন্তরালে থেকে যায় অসংখ্য ঘটনা। সামাজিক সম্মান এবং আত্নমর্যাদার ভয়, অর্থ ও ক্ষমতার অভাবে অসংখ্য নারী চোখের পানিতেই এই গ্লানি সহ্য করে পার করে দেয় জীবন। সাম্প্রতিক সময়ে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে আলোচিত ঐ নারীর জবানবন্দি থেকে জানা যায় তাকে ইতোপূর্বে একই বাহিনীর হাতে দুই বার ধর্ষিত হতে হয়েছে। আর, ঐ নারীকে বিবস্ত্র করে নির্যাতনের ৩২ দিন পরেই কিন্তু ঘটনাটি আমাদের সবার চোখের সামনে আসে। অপরাধীরা বীরদর্পে একের পর এক ঘটনা করেই যায়। তাইতো, একই ধর্ষককে কয়েকটি ধর্ষণের সাথে জড়িত থাকতে দেখা যায়।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে দেখা গেলেও আমাদের দেশে তেমনটা লক্ষ্যণীয় নয়। বরং, দেশে বিদ্যমান আইন অনুযায়ী শাস্তিই কার্যকর হয় না ধর্ষকদের বিরুদ্ধে। এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, আমাদের দেশে নারী যখন যৌন হয়রানি, ধর্ষণ কিংবা প্রভৃতি স্পর্শকাতর বিষয়ে আদালতের দারস্থ হয়, তখন তাদের অধিকাংশের অভিযোগ শুনানি পর্যন্ত যায় না। আর, গেলেও পরবর্তীতে তা বাতিল হয়ে যায়। এই কঠিন বাস্তবতার ফাঁদে ৯৭ শতাংশ নারীই ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়। আর, একটি পরিবারের পক্ষে টাকা খরচ ও সময় দিয়ে মামলা পরিচালনা করা কঠিন। তাইতো, শতকরা ৯০ ভাগ মামলাই আলোর মুখ দেখে না।

অথচ, বিশ্বের প্রায় সব দেশের মত আমাদের দেশেও নারীর প্রতি সকল বৈষম্য ও সহিংসতার বিরুদ্ধে জানান দিতে প্রতি বছর ২৫ নভেম্বর পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। আমরা সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সেখানে নীতি কথার ঝড় তুলি। তারপরও দেশে বেড়ে চলছে ধর্ষণ। কোনভাবেই যেন বন্ধ হচ্ছে না এই মিছিল। কারণ, ধর্ষণের জন্য ধর্ষকদের নৈতিক অবক্ষয়,দায়বদ্ধতাহীনতা, মানবিক বিপর্যয়, অপসংস্কৃতির চর্চা এবং রাজনৈতিক রং তো আছেই, আমরা সুশীল সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও এজন্য একইভাবে দায়ী। আমরা দিবস ভেদে দিবসের প্রয়োজনে নীতি কথা বলতে অভ্যস্ত। কিন্তু, সেই নীতি কথাগুলো সমাজ,দেশ এবং পৃথিবীর মাঝে বাস্তবায়ন করার কাজকে বিরক্তবোধ করি। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য মতে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগষ্ট) দেশে নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৮৯ জন, শুধু ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬৯২ জন, গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ১৯২ জন নারী। অন্যদিকে,ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪১ জনকে, এই গ্লানি সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছে ০৯ জন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়েছে ১৯২ জনকে। অবস্থা এমনটা চলতে থাকলে বিগত বছরগুলোকেও ছড়িয়ে যাবে ২০২০ সালে ধর্ষণের সংখ্যা এতে কোন সন্দেহ নাই। তাইতো, আজ জনমনে প্রশ্ন জেগেছে “তারপরও বন্ধ হবে তো ধর্ষণ???”

অনেক সময় আতঁকে উঠি,শরীর শিউরে উঠে। ধর্ষণ করে নিজের খায়েশ মিটাবে ধর্ষক, পরে একটা জীবন্ত নারীকে হত্যা করবে। একটা মানুষ কতটা অসভ্য, বর্বর এবং অমানবিক হলে এমন ঘৃণ্য কাজ করতে পারে! নারী হয়ে জন্ম নেয়াটাই কি মেয়েদের অপরাধ? স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও যখন ৩০ লক্ষ শহীদের রক্তস্নাত বাংলাদেশে একটা নারী শিক্ষার্থী ধর্ষণের প্রতিবাদে “এরপর কি আমি???” প্ল্যাকার্ড নিয়ে রাস্তায় নেমে আসে তখন প্রশ্ন জাগে দেশ স্বাধীনের প্রায় ৫০ বছর পরও কতটা স্বাধীন, স্বাধীন দেশে থাকা আমার মা,বোন? ১০/১২ বছরের কোন শিশু বার বার টেলিভিশনের সংবাদ কিংবা সংবাদপত্রের পাতায় ‘ধর্ষণ’ শব্দটি দেখে যখন এই শব্দের অর্থ জিজ্ঞাসা করে তখন চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোন উত্তর খুঁজে পাই না।

তাই, আমাদের সবাইকে জাগতে হবে। সোচ্চার হতে হবে চলমান এই ধর্ষণের বিরুদ্ধে। প্রতিটি ধর্ষণের সাথে জড়িত ধর্ষকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। দেশে চলমান আইন সংশোধন করে ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ডের আইন পাশ করতে হবে। কয়েকটি ধর্ষণের ঘটনায় জড়িতদের যদি মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা যায় তাহলে আর কেউ এই ঘৃণ্য কাজ করতে সাহস পাবে না। অন্যথায়, পরিস্থিতি আরও বেশি ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে তাতে কোন সন্দেহ নাই। আদালত যখন ধর্ষণের সাথে অভিযুক্তদের কঠোর হস্তে দমন না করে নিরব থাকে, তখন তা তাদেরকে সমর্থন করার মত হয়ে দাঁড়ায়। ফলে দিন দিন বেড়ে চলে একের পর এক ধর্ষণ। ধর্ষকদের সুষ্ঠু বিচার হলেই ধর্ষণের ঘটনা রেকর্ড পরিমাণে কমে আসবে। সুতরাং,ধর্ষণ বন্ধে ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি হোক মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে। অন্যথায়, ধর্ষণ যে আগামীর জন্য অশানী সংকেত এতে কোন সন্দেহ নাই।

লেখকঃ
তাওহীদুল ইসলাম নূরী,
আইন বিভাগ (অধ্যয়নরত),
আন্তর্জাতিক ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রাম।
শাহারবিল সদর, চকরিয়া, কক্সবাজার।