মুহাম্মদ আবু সিদ্দিক ওসমানী :

একুশে পদক প্রাপ্ত, রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের সাবেক অধ্যক্ষ পন্ডিত ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের’র প্রথম প্রয়াণ দিবস আজ শনিবার ৩ অক্টোবর। ২০১৯ সালের এদিনে দিবাগত রাত পৌনে ১টার দিকে ঢাকাস্থ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (সাবেক পিজি হাসপাতাল) এ চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৌদ্ধ ধর্মের এ পন্ডিত পরলোক গমন করেন।

অধ্যক্ষ পন্ডিত ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপ-সংঘরাজ ও বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের অন্যতম শীর্ষ ধর্মীয় গুরু ছিলেন। তিনি ২০১৫ সালে দেশের অন্যতম জাতীয় মর্যাদাসম্পন্ন পুরস্কার ‘একুশে পদক’ লাভ করেন। অধ্যক্ষ পন্ডিত ভদন্ত সত্যপ্রিয় মহাথের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হয়ে বিশ্বের কয়েকটি দেশ সফর করেন। তিনি দীর্ঘদিন যাবৎ রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের মেরুংলোয়া কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের অধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারী লাখো ভক্তের অশ্রুজলে চন্দন কাঠের আগুনে প্রয়াত বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সম্পন্ন হয়।

রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র প্রয়াণের প্রথম বর্ষ স্মরণে অষ্টপরিস্কারসহ সংঘদান সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ০২ অক্টোবর শুক্রবার রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারে পার্বত্য ভিক্ষু সংঘের উপ-সংঘরাজ, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি ধুমরী হেডম্যান পাড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ঊ আছবা মহাথের এর সভাপতিত্বে এ পুণ্যদান সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সভায় প্রধান ধর্মদেশক ছিলেন ভারতীয় সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভার উপসংঘরাজ ধর্মরত মহাথের, আশির্বাদক ছিলেন রামু পানেরছড়া বৌদ্ধ বিহারের অধ্যক্ষ ঊ সুচরিতা মহাথের।

এ ধর্মদান সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন রামু উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. নোবেল কুমার বড়ুয়া, রামু থানার নবাগত অফিসার ইনচার্জ কে.এম আজমিরুজ্জামান, রামু কেন্দ্রীয় কালি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত সুবীর ব্রাহ্মন চৌধুরী বাদল।

কক্সবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি, লেখক প্রজ্ঞানন্দ থের’র সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত সভায় শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার পরিচালনা পরিষদের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি তরুন বড়ুয়া, স্বাগত বক্তব্য রাখেন রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহার পরিচালনা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়ুয়া। ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন রামু কেন্দ্রীয় সীমা মহাবিহারের উপাধ্যক্ষ শীলপ্রিয় থের।

অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের’র সংক্ষিপ্ত জীবনী :

বর্নাঢ্য ক্যরিয়ারের অধিকারী সত্যপ্রিয় মহাথেরের প্রকৃত নাম বিধু ভূষণ বড়ুয়া। এ বৌদ্ধ ধর্মীয় গুরু ২০১৫ সালে সমাজসেবায় একুশে পদক পান। সংসার ত্যাগী সত্যপ্রিয় মহাথের ১৯৩০ সালের ১০ জুন কক্সবাজারের রামু উপজেলার ফতেখাঁরকুল ইউনিয়নের পশ্চিম মেরংলোয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা প্রয়াত হর কুমার বড়ুয়া ও মাতা প্রেমময়ী বড়ুয়া।

রামু সীমা বিহারের অধ্যক্ষ সত্যপ্রিয় মহাথের ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে আরেক বৌদ্ধ মহাপুরূষ বিনয়াচার্য আর্যবংশ মহাথের’র কাছে প্রব্রজ্যা গ্রহণ (গৃহজীবন ত্যাগ) করে সমাজ ও মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত হন। এর ৬ মাস পরই পবিত্র মাঘী পূর্ণিমার দিনে তিনি উপ-সম্পদা (ভিক্ষুত্ব) গ্রহণ করেন।

বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সত্যপ্রিয় মহাথের ১৯৫৫ সালে মায়ানমারের ধর্মদূত পালি কলেজে অগ্রমহাপন্ডিত উ. বিশুদ্ধায়ু মহাথের ও প্রজ্ঞালোক মহাথেরোর কাছে পালি ভাষা ও বিনয় শিক্ষা লাভ করেন। এ মহান পূণ্যপুরুষ পৃথিবীর একাধিক ভাষায় পারদর্শী। বুদ্ধ ধর্মের পবিত্র ধর্মীয় গ্রন্থ পালি ভাষার মূল ত্রিপিটকের বিভিন্ন অধ্যায় থেকে বাংলা ভাষায় অনুবাদ করে বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করেন সত্যপ্রিয় মহাথের।

অধ্যক্ষ পন্ডিত সত্যপ্রিয় মহাথের বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ক অনেক গবেষণাধর্মী গ্রন্থ রচনা করেছেন। তিনিই একমাত্র ব্যক্তি, যিনি ত্রিপিটকের অভিধর্ম পিটকের অন্তর্গত ‘চুল্লবর্গ’ গ্রন্থ পালি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন। গ্রন্থটি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শিক্ষা ও গবেষনায় সহায়ক গ্রন্থ হিসাবে অনন্য ভূমিকা রাখছে। তিনি বৌদ্ধ ধর্মালম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় শীর্ষ গুরু ছিলেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধেও অসাধারণ সাহসী ভূমিকা রাখেন সত্যপ্রিয় মহাথের। যুদ্ধ-চলাকালীন তিনি এলাকার সহস্রাধিক অসহায় ও নির্যাতিত মানুষকে ঐতিহ্যপূর্ণ পুরাতন কাঠের সীমা বিহারে আশ্রয় দেন। এ নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে বাকবিকণ্ডা হয় এ সাহসী বৌদ্ধ ভিক্ষুর।

দেশের সবচেয়ে কলঙ্কময় অধ্যায় ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে কক্সবাজারে রামু, উখিয়া, টেকনাফ ও পটিয়ার লাখেরায় ঘটে যাওয়া সাম্প্রদায়িক হামলার পর গৌতম বুদ্ধের সাম্য-মৈত্রী ও অহিংসার বাণীকে সর্বময় ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে সত্যপ্রিয় মহাথের’র। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনঃস্থাপনসহ বর্হিবিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করতে অন্যন্য ভূমিকা পালন করছেন তিনি।

একনজরে :
(১)নাম: সত্যপ্রিয় মহাথেরো (২) পিতার নাম: মৃত হরকুমার বড়ুয়া (৩) জন্ম তারিখ: ১০ জুন ১৯৩০ (৪) প্রব্রজ্জার তারিখঃ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫০ সাল (৫) উপসম্পদার তারিখ : নভেম্বর ১৯৫০ (৬) উপধ্যায়ের নাম : বিনয়াচার্য আর্যবংশ মহাথের (৭) আচারিয়ার নাম অগ্গমহাপন্ডিত প্রজ্ঞালোক মহাথেরো (৮) শিক্ষাগত যোগ্যতা: ত্রিপিটক বিশারদ, ইয়াঙ্গুন, মিয়ানমার।
(৯) সাহিত্যে ক্রিয়াকলাপ :
(ক) লেখক: বিনয়াচার্য আর্যবংশ (জীবনচর্চা) (খ) অভিধর্ম সংঘ স্বরূপ দীপানী (অভিধর্মের একটি ম্যানুয়াল (গ) ধাতুকথা (ঘ) চুল্লবগ্গ (ঙ) বিভঙ্গ (চ) অঙ্গুত্তর নিকায (ছ) ধম্মসঙ্গিনী (জ) ভিক্ষুনী স্কন্ধ ইত্যাদি (ঝ) নিবন্ধ প্রকাশিত : এছাড়া বিভিন্ন সাময়িকী, জার্নাল এবং স্মৃতিচিহ্নগুলিতে ধর্মীয় ও সাহিত্যিক গুরুত্বের অনেক নিবন্ধ রয়েছে।
(১০) ধর্মীয় ও সামাজিক ক্রিয়াকলাপ:
(ক) প্রাক্তন সভাপতি, বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা। (খ) আঞ্চলিক সংঘনায়ক, কক্সবাজার জেলা। (গ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতিঃ আর্যবংশ ভিক্ষু সংস্থা, কক্সবাজার। (ঘ) সদস্য : বাংলাদেশ সরকার ত্রিপিটক ট্রান্সলেট বোর্ড। (ঙ) প্রতিষ্ঠাতা : ত্রিপিটক গ্রন্থগার, রামু সীমা বিহার, কক্সবাজার (চ) বিহার অধ্যক্ষঃ রামু সীমা মহাবিহার, রামু। (ছ) প্রধান উপদেষ্টা: বৌদ্ধ উইজডম অ্যাসোসিয়েশন, রামু, কক্সবাজার। (জ) আজীবন সদস্য: আন্তর্জাতিক বৌদ্ধ
মেডিটেশন সেন্টার, বুদ্ধগয়া, বিহার, ভারত।
(ঝ) আজীবন সদস্য: বেঙ্গল বৌদ্ধ সমিতি,
কলকাতা, ভারত। (ঞ) আজীবন সদস্য: বাংলাদেশ বুড্ডিষ্ট ফেডারেশন, ঢাকা। (ট) প্রতিষ্ঠাতা: বিমুক্তি বিদর্শন ভাবনা কেন্দ্র, রামু, কক্সবাজার।
(১১) মিয়ানমারে অধ্যয়ন:
১৯৫৪ সালে শ্রদ্ধেয় সত্যপ্রিয় মহাথের বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ অধ্যয়নের জন্য মিয়ানমারে গিয়েছিলেন। তিনি ইয়াঙ্গুনের বিশ্ব শান্তি স্থান (গোভায়েরা)-এর জাম্বুদ্বীপ বিহারে অবস্থান করেছিলেন। তারপরে তাকে ধর্মদূত পালি কলেজে ভর্তি করা হয়। আগ্গামহাপণ্ডিত উ বিষুধ মহাথেরোর অধীনে তিনি বার্মিজ এবং পালি ভাষা অধ্যয়ন করেন। তিনি মহাপন্ডিত পাগলোকা মহাথেরোর অধীনে বিনয় শিক্ষা অধ্যয়ন করেন। তিনি অধ্যক্ষ উ শাসনবিভংশের অধীনে ১০ বছর ইয়াঙ্গুনে অবস্থান করেন। (১২)বাংলাদেশ সংঘরাজ ভিক্ষু মহাসভা কর্তৃক ‘পন্ডিত’ উপাধি লাভ।
১৩. অন্যান্যদের মধ্যে তিনি মিয়ানমারের ইয়াঙ্গুনে ধ্যান কেন্দ্রে বিদর্শন ভাবনাও অনুশীলন করেছিলেন-তাই তিনি বিদর্শন আচার্য। (১৪)মায়ানমার সরকার কর্তৃক
“অগ্গমহাসদ্ধর্মজ্যোতিকাধ্বজ” উপাধি।
(১৫) ভ্রমণকৃত দেশ: ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, সুইজারল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, কম্বোডিয়া ইত্যাদি (১৬) উপ-সংঘরাজঃ ২৩ অক্টোবর ২০১৫ (১৭) বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক “একুশে পদক” লাভ, ফেব্রুয়ারী ২০১৫
(১৮)শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করুন: ৩ অক্টোবর বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত ১২ টা ৪৫ মিনিট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিকেল
বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতাল (বিএসএমএমইউ) ঢাকা।