ইমাম খাইর:
রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংস হামলাকারী দুর্বৃত্তদের ধরে বিচারের মুখোমুখি করতে পারলে রোহিঙ্গারা নিজেদের দেশে ফিরে যাওয়ার আস্থা ফিরে পাবে।
তাছাড়া রোহিঙ্গাদের সমস্যা মিয়ানমারে। তাই মিয়ানমারকেই সমস্যার সমাধান করতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন হতে হবে স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ।
কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের মানবিক সহায়তাদানকারী জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সমন্বয়কারী ইন্টার সেক্টর কো-অর্ডিনেশন গ্রুপ-আইএসসিজি’র দেওয়া সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য জানানো হয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত, কানাডিয়ান হাইকমিশনের মানবিক সহায়তা বিষয়ক প্রধান, বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর ও জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারীদের একটি প্রতিনিধি দল গত দুই দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন।
বৃহস্পতিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) বিকেলে কক্সবাজারে দুই দিনের সফর শেষে তাদের বরাতে এসব কথা জানিয়েছে আইএসসিজি।
বাংলাদেশে নিযুক্ত জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী মিয়া সেপ্পো বলেন, ‘কোভিড-১৯ এর কারণে কয়েক মাসের প্রয়োজনীয় নিষেধাজ্ঞার পর রোহিঙ্গা শরণার্থী ও তাদের আশ্রয়দাতা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতি সমর্থন এবং বাংলাদেশের প্রতি একাত্মতা পুনর্ব্যক্ত করতে আমরা আমাদের অংশীদারদের সঙ্গে এখানে উপস্থিত হয়েছি। আমরা যথাযথ কর্তৃপক্ষের গৃহীত সময়োপযোগী পদক্ষেপের কারণে কোভিড-১৯-এর সংক্রমণ প্রশমিত হতে দেখছি; এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহযোগিতায় এক্ষেত্রে একটি কার্যকর এবং জীবন রক্ষাকারী সাড়াদান প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।’
যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত আর্ল রবার্ট মিলার বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ আমাদের অন্যান্য আন্তর্জাতিক অংশীদারদের জন্য বাংলাদেশের অগ্রাধিকার গুরুত্বপূর্ণ, এমনকি কোভিড-১৯ মহামারির পরিস্থিতিতেও। ২০১৭ সাল থেকে কক্সবাজার জেলায় নির্দিষ্ট খাতে মানবিক সহায়তার পাশাপাশি বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের সহায়তা দিয়েছে। এই সফরে থাকা দেশগুলো মোট তহবিলের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ তহবিলের যোগান দিয়েছে। একইসঙ্গে আমরা এই সংকট সমাধানে এবং শরণার্থীদের নিরাপদে, স্বেচ্ছায় এবং মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের কাজ চালিয়ে যাব।’
প্রতিনিধিদলের সঙ্গে আলোচনার সময় শরণার্থীরা জানান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি কিভাবে তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব ফেলেছে এবং তারা তাদের ভবিষ্যৎকে কিভাবে দেখতে পাচ্ছেন।
কানাডিয়ান হাইকমিশনের মানবিক সহায়তাবিষয়ক প্রধান ফেড্রা মুন মরিস বলেন, ‘শরণার্থীরা কোভিড-১৯ থেকে নিজেদের সম্প্রদায়কে রক্ষা করতে, নিজেরাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। তারা সাড়াদানের মূল চালিকা শক্তির ভূমিকায় রয়েছেন এবং আমাদের উচিত তাদের অবদানকে যথাযথভাবে স্বীকৃতি দেওয়া।’
পরিদর্শনকালে, প্রতিনিধি দল শ্বসনতন্ত্রের তীব্র সংক্রমণজনিত আইসোলেশন ও চিকিৎসাকেন্দ্র পরিদর্শন করেন। ১৪টি চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রায় এক হাজার শয্যা রয়েছে যা বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা উভয় জনগোষ্ঠীর কোভিড-১৯ রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে প্রস্তুত রয়েছে, সেইসঙ্গে রয়েছে কোভিড-১৯ পরীক্ষাকেন্দ্র।
প্রতিনিধিদলের কেউ কেউ অস্থায়ী শিক্ষাকেন্দ্র পরিদর্শন করেন, যেগুলো কোভিড-১৯-এর কারণে সাময়িকভাবে বন্ধ রাখা হয়েছে। একটি প্রতিবেদনে এসেছে, শরণার্থীদের মধ্যে হতাশা, শিশুদের প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিবাহ এবং শিশু শ্রমের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রতিনিধিদলটি আরো বেশি নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে শিক্ষাকেন্দ্রগুলো পর্যায়ক্রমে পুনরায় চালু করার ব্যপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারের ক্যাম্প ও পার্শ্ববর্তী এলাকার সার্বিক নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত রাখার যে প্রচেষ্টা তা পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করেন। ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন বলেন, ‘রোহিঙ্গা শিবির ও শরণার্থীদের আশ্রয় প্রদানকারী স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। আমরা আশা করছি যে, প্রয়োজনে আরো কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে সব মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সার্বিকভাবে চলমান রাখার জন্য শরণার্থী শিবিরে প্রবেশাধিকার বজায় থাকবে এবং ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর সঙ্গে আলোচনা চলমান থাকবে।’

প্রতিনিধিদলটি ভাসানচর প্রকল্প সম্পর্কে সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত রেনজে তিরিঙ্ক বলেন, “সাম্প্রতিক সময়ে ভাসানচরে ‘গো অ্যান্ড সি’ একটি ভালো উদ্যোগ ছিল। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবিত প্রযুক্তিগত এবং সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়নের বাস্তবায়ন জরুরি এবং ইতোমধ্যে সেখানে স্থানান্তরিত ৩০৬ জন শরণার্থীর পরিস্থিতি মূল্যায়নের জন্য একটি পৃথক মানবিক ও সুরক্ষা বিষয়ক মূল্যায়ন গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রতিনিধি দলের সদস্যরা স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করেন যে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সাড়াদান এবং ক্ষতিগ্রস্ত বাংলাদেশি জনগোষ্ঠীকে সমর্থনের ব্যাপারে তাদের অঙ্গীকার অব্যহত থাকবে।
বিশ্ব ব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর মার্সি টেম্বন বলেন, ‘আমরা এই সংকটের শুরু থেকে বাংলাদেশের পাশে রয়েছি এবং কক্সবাজারের জন্য উন্নয়ন সহায়তা বৃদ্ধি অব্যহত থাকবে। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ কোটি মার্কিন ডলারের সহযোগিতা প্রদান করা হয়েছে। এই সংকটকে কোনোভাবেই ভুলে থাকা বা ভুলে যাওয়ার সুযোগ নেই।’
শেষে প্রতিনিধিদলটি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশের স্থানীয় জনগোষ্ঠী যে উদারতার নিদর্শন রেখেছেন তার প্রশংসা করে এবং স্বেচ্ছায়, নিরাপদ ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের বিষয়ে জোর সংহতি প্রকাশ করেন।