আকতার চৌধুরী


এক সময় কক্সবাজারের প্রাণকেন্দ্র ছিল লালদিঘীর পাড়। অবশ্য কিছুটা প্রাণ এখনও আছে প্রশাসনিক কারণে। শহরের পরিধি বেড়েছে। ব্যস্ততা বেড়েছে। বেড়েছে যানজট। তাই বাইপাস রোডে স্থানান্তর বাস টার্মিনাল। কিন্তু সেদিনের লালদিঘী পাড়ের আওয়াজগুলো এখনো কানে বাজে। পাবলিক হল ও লালদিঘীর পাড়ের জনসভার মাইকের আওয়াজ আর গাড়ীওয়ালাদের হাকডাক নেই বললে চলে। আইন আদালত , হোটেল, রাজনীতি, ব্যবসা বাণিজ্যি ছাড়াও দূর পাল্লার যাত্রার জন্য লালদিঘীর পাড়ের যথেষ্ট গুরুত্ব ছিল।

ছোটবেলা থেকে ভাবনায় খোঁজে ফিরতাম – লালদিঘীর পানি লাল নয়, তবু নাম তার লালদিঘী। এর কোন যথাযথ উত্তর খোঁজে না পেলেও চট্টগ্রামের লালদিঘীর নামকরণে প্রভাবিত হয়ে হয়তো এটার নামও লালদিঘী রাখা হয়েছে এমনটাই ধরে নেয়া যায় । অনেক বছর ধরে কালুর দোকানে এসে কালুর দোকান কোনটা বের করার চেষ্টা করেছি। গোলদিঘী গোল কেন সেটাও চিন্তা করেছি।

লালদিঘী নামটি মনের মধ্যে সীল মোহরকৃত ছিল। রাজনীতি , মিটিং মিছিল , সংস্কৃতির তীর্থস্থান এটা । এছাড়াও এখান থেকেই যেতে হত দূরপাল্লার বাসে। কাঠের বডির বাস (মুড়ির টিন) , সুপিরিয়র কোচ, লাল বোর্ড, সাদা বোর্ড ,ক্লোজ ডোর, বিআরটিসি বাসের স্ট্যান্ডও এটা। আর বিআরটিসি কাউন্টারের সাথে লাগানো প্রবীণ সাংবাদিক বদিউল আলম নানার পত্রিকা এজেন্ট অফিস ‘সংবাদ বিতান’। দক্ষিণ পাড়ে সনজিতের নিউজ কর্ণার , তার পশ্চিম পাশে হাশেম ভাইয়ের খবর বিতান। বিকেলের আড্ডা বা অবসর কাটানোর জায়গা। পত্রিকা , ম্যাগাজিন কিনতে হলেও প্রতিদিনের একবার লালদীঘির পাড়ে যেতে হত। জ্ঞান চর্চার জন্য পাবলিক লাইব্রেরী ছিল একমাত্র অবলম্বন।

লাল দিঘীর পাড়ে গেলেই আওয়াজ শোনা যেত – শ…অ…র…ত…. শ…অ…র….ত…. মানে শহরে । আর শহর বলতেই বোঝাত চট্টগ্রামকে। রিকসা থেকে নামলেই ব্যাগ নিয়ে টানাটানি বাস হেল্পারদের । মামা আপনার জন্য ফ্রন্ট সিট খালি আছে। গাড়িতে উঠে জানালা দিয়ে পিয়াজু , বরই আচার , পানি কেনা এটা কমন কালচার। বিপদ ছিল মহিলা যাত্রীদের জন্য। গাড়ির ঝাঁকুনিতে বমি করা এগুলো সাধারণ ব্যাপার ।

লালদিঘীর পাড়ে বাস কাউন্টার ছিল অনেকগুলো । কিছু বাস কাউন্টারের নাম মনে আছে । যেমন – সোনারগাঁ ,এস আলম , সৌদিয়া , বোরাক , রিলাক্সসহ আরো কিছু কাউন্টার ছিল। এর কিছু এখনো আছে , আবার নতুনও হয়েছে। সোনারগা , বোরাক , রিলাক্স সম্ভবত আর নেই।

কতগুলো মিনিবাস ছিল। সম্ভবত এগুলোর নাম ছিল বিলাসী সার্ভিস লাল বোর্ড । পথে যাত্রি উঠানামা করতো না। অনেক সময় যাত্রাবিরতিও দিত না। কারো প্রশ্রাবের বেগ পেলে ডেঞ্জারাস অবস্থা। মাত্র আড়াই ঘন্টায় কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম পৌঁছাতো। রাস্তাও ছিল সরু আঁকাবাঁকা। তবু কিভাবে এত তাড়াতাড়ি চট্টগ্রাম পৌঁছাত অবাক লাগে! এসব গাড়িতে উঠলে মানুষ দোয়া কলমা পড়ে নিত। যেন দুনিয়াতে ফেরত আসার সম্ভাবনা কম। তবু দ্রুত পৌঁছার আশায় মানুষ এসব গাড়িতে যেত।

সত্য মিথ্যা জানিনা। শুনেছি একবার এক বার্মাইয়াকে সৌদি আরব পাঠানোর জন্য এক দালাল লালদিঘীর পাড়ে এসে সৌদিয়া বাসের টিকেট কেটে তুলে দিয়েছিল। তবে সৌদি আরব পৌঁছাতে পেরেছিল কিনা জানিনা। হা হা হা।

কিন্তু আরো একটি কারণে লালদিঘী এলাকার গুরুত্ব ছিল। এটা ছিল স্টুডিও পাড়া। দূর দুরান্ত থেকে ছবি তোলার জন্য এখানে চলে আসত। বাবা-মা, ভাই-বোন, আত্মীয়-স্বজন সেজেগোজে সকাল থেকে চলে আসত ছবি তোলার জন্য। আমিও একবার গ্রামের বাড়ি থেকে ছবি তোলার জন্য দাদা দাদীর সাথে এসেছিলাম।

এখনো মনে পড়ে, মাথার সিথি ঠিক রাখার জন্য মাথা ভতি তেল মেখে এসেছিলাম। পরে তা কান বেয়ে ঘাড়ের মধ্যে ঢুকে যাচ্ছিল। সার্টের অবস্থাও খারাপ। আর রুমাল দিয়ে মুছে নিচ্ছিলাম। তারপরও চুলে হাত দিতামনা চুলের ভাঁজ ভেঙ্গে যাবে বলে। এরপর স্টুডিতে ঢুকে ক্যামেরাম্যানের ঠিক করে দেয়া মাথা ঘাড়ের পজিশন চাহিদা মোতাবেক কাঠের মত দাঁড়িয়ে থাকতাম। একটু এদিক-ওদিক হলেই ক্যামেরাম্যানের বিরক্তি। ওইদিন নড়াচড়া করে অনেক বকা শুনেছিলাম।

একটু বড় হওয়ার পর অনেক স্বাধীনতা ভোগ করতে লাগলাম। ক্যামেরাম্যান আগের মত পজিশন দেখিয়ে দিতে পারেনা। নিজেই দেখিয়ে দিই।

১৯৮৪ সালে তিন বন্ধু ঢাকা যাব। স্মৃতিটা তোলে না রাখলে কী হয়! বাসে টিকেট কাটা। গাড়ীতে ওঠার আগে ঢুকে গেলাম স্টুডিও ছায়াছবি অথবা ছবিঘর। নামটা ঠিক মনে পড়ছে না। তিনজনের ৩টা ব্যাগও ছবি থেকে বাদ দিতে দিই নাই। লম্বা টুল এনে ব্যাগগুলো সামনে রাখলাম। ছবি কেমন উঠেছিল দেখার সুযোগ ছিলনা। পরে ঢাকা থেকে ঘুরে এসে সংগ্রহ করেছিলাম।

ছবিতে ডান থেকে আমি কাল চশমা , মাঝে ইকবাল আনোয়ার খান বাবু ( আবুল খায়ের গ্রুপে চাকুরী করে), বামে বন্ধু টিপু (রামু বাড়ি)। তখনো রঙিন ছবির বহুল প্রচলন হয় নাই।

এখন প্রতিদিন প্রতি মূহুর্তে কারণে অকারণে আমরা রঙিন ছবি তুলি। কিন্তু আবেগ সুখানুভূতি আগের মত তাড়িত করেনা। অনেক আগের ছবিটা সাদাকালো হতে পারে , সুখানুভূতিটা রঙিন। লালদীঘির পানি লাল না হতে পারে , কিন্তু স্মৃতিটা রঙিন।

এই লালদীঘি অনেক ইতিহাসের জন্ম দিয়েছে , স্মৃতির জন্ম দিয়েছে , কিন্তু কেউ তোলে ধরছেনা।


লেখক : সম্পাদক , কক্সবাজার নিউজ (সিবিএন)