মো: কায়ছার আলী


ভারতের সাবেক মহামান্য রাষ্ট্রপতি এ দেশের ঠাকুর জামাই, প্রকৃত বন্ধু বা স্বজন প্রণব মুখার্জীর একটি উদ্ধৃতি “সংসদ হলো ভারতীয় গণতন্ত্রের গঙ্গোত্রী”। তিনটি ডি থাকতে হবে। ডিবেট(বিতর্ক), ডিসেন্ট (বিরোধীতা), ও ডিসকাশন (আলোচনা)। বর্তমানে চতুর্থ ডি প্রবেশ করেছে। ডিজরাপশন (বাধাগ্রস্থ করা)। শোকের আগস্ট মাসের শেষদিনে তিনি চিরতরে না ফেরার দেশে চলে গেলেন। তাঁর অবিনশ্বর আত্মার প্রতি শুদ্ধা জানিয়ে প্রথম ডি মানে ডিবেট (বিতর্ক) নিয়ে লিখব বলে ভাবছি। বিতর্ক একটি শিল্প তবে বাকশিল্প। মানব সভ্যতার ইতিহাস শিল্পের ইতিহাস। আবহমান কাল থেকেই মানুষ সেই শিল্প তথা বিতর্কে লিপ্ত হয়ে আসছে। সুন্দর ভাবে কথা বলা একটা আর্ট (কৌশল) এই আর্ট আয়ত্বে থাকলে সহজে মানুষকে আপন করা যায়। যুক্তির মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলা করা যায়। তলোয়ারের আঘাতে হয় দেহে রক্তক্ষরণ আর কথার আঘাতে হয় হ্রদয়ে রক্তক্ষরণ। আমরা রক্তক্ষরণ চাই না, চাই যুক্তিসংগত উপায়ে সঠিক সিদ্ধান্তে উপনীত হতে। বিতর্ক চর্চার সূচনা লগ্ন সঠিক করে বলা না গেলেও ধরে নেওয়া যেতে পারে আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে প্রাচীন গ্রীসে সোফিস্ট নামক একপ্রকার পেশাদার তার্কিক গড়ে উঠেছিল। পরবর্তীতে তা অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যুক্তির মাধ্যমে স্বাধীন ও নিজস্ব মত প্রকাশের জন্য মানব ইতিহাসে শাসক কতৃক প্রহসনের বিচারে মুক্তচিন্তার দার্শনিক সক্রেটিসকেই প্রথম জীবন দিতে হয়েছিল। আবার আড়াই হাজার বছর পর সেই গ্রীসের মহামান্য আদালতে কিছুদিন আগে তাঁকে নির্দোষ বলে আবারো রায় দেন। সময়ের ব্যবধানের কারণে দুই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন রায়। পক্ষ এবং বিপক্ষ সবসময়ই থাকে। দুই পক্ষ থাকে বলে বিতর্ক জমে উঠে বা প্রাণ পায়। উভয় পক্ষ পরস্পরের বিরুদ্ধে যুক্তি তুলে ধরে তা আবার খন্ডিতকরণের মাধ্যমে ক্রমান্বয়ে সত্যের দিকে ধাবিত বা অগ্রসর হয়। সহজভাবে বিতর্ক বলতে বোঝা যায় যুক্তিযুক্ত পন্থায় একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের উপর পূর্ব নির্ধারিত নিয়মে পারস্পরিক বিতর্কে লিপ্ত হয়ে কোন সুনির্দিষ্ট মত প্রতিষ্ঠাকে বোঝায়। ভিন্ন ভিন্ন চিন্তা চেতনার অধিকারী মানুষ। নিজ নিজ মতের পক্ষে উত্তর খুঁজতে ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকে চিন্তা করে এবং মতামত প্রদান করে। তবে বিতর্কে বিজয়ী হলেই মতামতের মীমাংসা হয়ে যায় না। বিতর্ক তৃতীয় পক্ষ অর্থাৎ দর্শককে সত্য সন্ধানে সহায়তা করে। নেতৃত্বের বিকাশে বিতর্ক প্রতিযোগীতার অনন্য অসাধারণ ভূমিকা রয়েছে। বক্তৃতা করতে পারা নেতৃত্বের একট সহজাত গুণ। বিশ্ববরেণ্য কিছু মানুষ তাঁদের বক্তব্যের মাধ্যমেই পৃথিবীকে কাঁপিয়ে দিয়ে অমরত্ব লাভ করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, আব্রাহাম লিংকন, নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, নেপোলিয়ন, হিটলার, বারাক ওবামা, ডা: জাকির নায়েক প্রমুখ। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের এক ভাষণে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে যুদ্ধের ঝাঁপিয়ে পড়ে জয় ছিনিয়ে এনেছেন। সেই ভাষণ এখন “মেমোরি অব দ্য ওয়ার্ল্ড”। সুবক্তা হতে হলে অবশ্যই আত্মবিশ্বাসী, সময় সচেতন, বডি ল্যাংগুয়েজ, প্রত্যুৎপন্নমতি, তথ্যবহুল, ভাষাগত, উচ্চারণগত দক্ষতা, হাস্যরসাত্মক উপস্থাপনা, সাবলীল এবং পরিষ্কার কণ্ঠস্বর থাকতে হবে। সম্প্রতি ফেসবুকে কিছু কিছু বিতার্কিকের বক্তব্য ভাইরাল হচ্ছে। যা দেখে আজকের প্রজন্ম অনেক কিছু সহজে জানতে পারছে। এখন তাদের আর কষ্ট করে লাইব্রেরীতে যেতে হয় না। গুগলে সার্চ দিলে হাতের মুঠোয় তারা সবকিছু পায়। ১৯৯৩-৯৪ সালে তৎকালীন সরকার প্রধান এর উপস্থিতিতে বিটিভি আয়োজিত ঢাকার মেয়ে (এখন আমেরিকা) রেবেকা শাফির ২৬ বছর আগের আবেগ ঘন বিতর্কের ভিডিও ভাইরাল হয়েছে। সেই বক্তব্য রীতিমত হৈ চৈ ফেলে দিয়েছে। প্রশংসায় ভাসা সেই বিতর্কের উচ্চারণে কন্ঠস্বরে যেন যাদু লুকিয়ে আছে। ‘ছেড়ে দিয়েই আমি জিতে যেতে চাই’। তিনি জিতেছেন তাঁর বাস্তব জীবনে। ২০১৩ সালে ১২ তম বিটিভিতে স্কুল বিতর্ক প্রতিযোগিতায় (ব্র্যাক আয়োজিত) রানার্স আপ কৃতিত্ব অর্জন করে আগ্রান উচ্চ বিদ্যালয়, বড়াইগ্রাম, নাটোর। সেই গ্রামের স্কুলের বিতার্কিক শিউলি শিলা জয়ী মাননীয় অর্থমন্ত্রীর উপস্থিতিতে বেসরকারী শিক্ষক সমাজের বেতন যে দিনমজুরের চেয়ে কম তা গাণিতিক আকারে কাঁদতে কাঁদতে নিজের শিক্ষক বাবার ঈদে তার জন্য ভাল জামা না কিনে দেওয়ার ব্যর্থতার কথা অকাতরে তুলে ধরে রীতিমত সবাইকে চমকে দেন। তৃতীয় পক্ষ হিসাবে শুধু নয়, ব্যক্তিগত ভাবে আমি সেই ক্ষুদে মেয়েটির বক্তব্যে একমত। অনেক বিতর্কের মাঝে আমি দুটো উল্লেখ করলাম। এদেশে বিতর্ক প্রতিযোগিতার সুচনা খুব বেশি দিনের নয়। ১৯৭৬ সালে বিটিভি প্রথমবারের মত “তর্ক-যুক্তি-তর্ক” নামে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের জন্য এর আয়োজন করে। ১৯৯১ সালে বিটিভি প্রথমবারের মত “যুক্তিতর্ক” শিরোনামে সংসদীয় ধারায় তা চালু করে। সেই ধারাবাহিকতার ¯্রােত আজ সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর ক্ষমতায়ন ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের পাশাপাশি বিশ্বের বৃহত্তম এন,জি,ও ব্র্যাক শিক্ষার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে তাদের পেইস প্রোগ্রামের মাধ্যমে অজপাড়া গাঁয়ের কিছু বেসরকারী মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের বিষয় ভিক্তিক শিক্ষকের প্রশিক্ষণ, কমিটির সকলের সাথে ত্রিশ জন শিক্ষার্থীর মেন্টরিং প্রশিক্ষন অত্যন্ত চমৎকার। প্রশিক্ষন গ্রহণ কারী শিক্ষার্থীরা তাদের জয়গান গেয়ে থাকে। তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত তারা বিতর্ক প্রতিযোগিতা নিকট সোনালী অতীতে করেছে। উপজেলা এবং জেলা পর্যায়ে সেই বিতর্ক প্রতিযোগিতার একজন ছোট্ট বিচারক হিসাবে আমি বিপদে পড়ে যেতাম। বিচার করা খুব জটিল এবং কঠিন কাজ। ধাঁধাঁগ্রস্থ হতাম কোন বক্তাকে বা দলকে কম বা বেশি নম্বর দিলাম কি না? সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলীর মধ্যে মেন্টরিং এবং ডিবেট কমপিটিশন এর গুরুত্ব অন্যান্য কোন অংশের চেয়ে কম নয়। আজ তরুণ সমাজের মধ্যে বিতর্ক প্রতিযোগিতা ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। বিএসবি ফাউন্ডেশন ও ক্যামব্রিয়ান শিক্ষা পরিবারের অর্থায়নে এটিএন বাংলা “ক্যামব্রিয়ান ক্যাম্পাস পার্লামেন্ট” বিতার্কিক মহলে যথেষ্ঠ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। আমাদের দেশের অন্যান্য মিডিয়াগুলো এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ ভূমিকা পালন করছে। যুক্তিবিদ্যার জনক অ্যারিস্টটল অবরোহ পদ্ধতিতে আর ফ্রান্সিস বেকন আরোহ পদ্ধতিতে যুক্তিপ্রদান করতেন। অ্যাবডেবার প্রোটাগোরাস (বিতর্কের জনক) আর প্লেটোর সাথে বর্তমান কালের বিতর্কের সবচেয়ে কাছাকাছি মিল লক্ষ্য করা যায়। তাঁদের দীপ্তিময় আলোর আভায় উদ্ভাসিত হউক আমাদের নতুন প্রজন্ম। অল্প সময়ে সীমার মাঝে অসীম বক্তব্যের ঝড় তুলে নিজস্ব সৌরভ ছড়িয়ে এবং সম্মোহনী শক্তি অর্জন করে সারাবিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টিকারী প্রভাবশালী সুবক্তা হিসাবে গড়ে উঠুক নতুন প্রজন্ম সুষ্ঠু বিতর্ক চর্চার মাধ্যমে।


লেখকঃ শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট