আবদুর রহমান খান
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ লেবাননের রাজধানী বৈরুতে গত ০৪ আগষ্টের ভয়াবহ বিষ্ফোরনে বিপুল সংখ্যক প্রানহানি , আহত আর ব্যাপক ধ্বংসকান্ডে আৎকে উঠেছে বিশ্ববাসী। কেন এমন বিধ্বংসী বিষ্ফোরণ? এটা কী কেবলই দুর্ঘটনা? কারা এজন্য দায়ী ? এ সব প্রশ্নের জবাব জনাতে চায় লেবানবাসীসহ শান্তিকামী বিশ্ববাসী।
ভূমধ্য সাগরের পূর্বতীরে সিরিয়া আর ইসরাইলের সীমানা ছুঁয়ে অবস্থান করছে পশ্চিম এশিয়ার দেশ লেবানন। দেশটিতে ৬০ ভাগের বেশী মুসলমান আর ৩০ ভাগের বেশী খৃষ্টান পাশাপাশি বসবাস করে আসছে কয়েকশ’ বছর ধরে। ইতিহাসের হিসেব বলছে, সাত হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতার দেশ লেবানন। এখানে উদ্ভব হয়েছে প্রাচীন ফোয়েনিসিয়ান জাতি যারা ছিল সমুদ্রযাত্রা আর নৌবানিজ্যের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ । খৃষ্টপূর্ব ৬৪ সালে রোমান সাম্রাজ্যের দখলে চলে যায় লেবানন। তারপর খৃষ্টধর্মের বিকাশ। লেবানেই সৃষ্টি হয়েছে খৃষ্টানদের মেননাইট সম্প্রদায় । ১২৮৯ খৃষ্টাবে মুসলিম মামলুক সুলতানাতের অংশ হয়ে যায় লেবানন। মুসলিম শাসনের ধারাবাহিকতায় ষোড়শ শতকে দেশটি আটোমান সাম্যাজ্যের অধীস্ত হয় এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বে পর্যন্ত চারশ’ বছর ধরে মুসলিম শাসনাধীনে পরিচালিত হয়। সে সময় শিয়া ও সুন্নীরা মিলে মুসলমানরাই হয়ে যায় দেশটির সংখ্যাগরিষ্ট নাগরিক।
প্রথম মহাযুদ্ধে অটোমান সাম্রাজ্যের পরাজয়ের পর লেবানন ফরাসীদের অধীনে চলে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ১৯৪৫ সালে দেশটির উপিবেশিক শাসনের অবসান হয়। স্বাধীনতা লাভের পর একটি অলিখিত প্রথায় দেশটি পরিচালিত হতে খাকে। সে প্রথা আনুযায়ী দেশের প্রেসেডেন্ট হবেন একজন মেনোনাইট খৃষ্টান, পার্লামেন্টের স্পিকার হবেন একজন শিয়া মুসলমান , প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন সুন্নি মুসলমান এবং ডেপুটি স্পিকার হবেন একজন রোমান অর্থডক্স খৃষ্টান। এভাবেই চলছে দেশটির শাসন ব্যবস্থা
এরই মধ্যে ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আরব দেশগুলির ঘোষিত যুদ্ধে আরবলীগের সদস্য লেবানও যোগ দেয়। সে সময় অন্তত একলক্ষ প্যালেস্টাইনী জীবন বাঁচাতে লেবাননে এসে আশ্রয় নেয় । তারা আর কখোনা ফিরে যায় নি। ১৯৭৭ -৭৮ সালে পিএলও যোদ্ধারা লেবানকে ঘাটি বানিয়ে ইসরায়েলের ওপর আক্রমন পরিচালনার পর কার্যত: লেবানও যুদ্ধ ক্ষেত্রে পরিনত হয়। সংঘাতময় রাজনীতির ধারাবাহিকতায় প্যালেষ্টাইন লিবারেশন ফোর্স, বামপন্থী দ্রুজ বাহিনী ও মুসলিম গেরিলা গ্রুপের বিরুদ্ধে সংগঠিতহয় খৃষ্টানদের সশস্ত্র বাহিনী। সেই থেকেই শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধে জ্বলছে লেবানন।
ইতোমধ্যে বুদ্ধ বিদ্ধস্ত প্রতিবেশী দেশ সিরিয়া আর প্যালেষ্টাইন থেকে হাজার হাজার নারী-শিশু সহ বাস্তচূত পরিবারগুলি এসে ঠাঁই নিয়েছে লেবাননে। তাদের আশ্রয়ের জন্য তাবু, খাবার , অষুধ চিকিৎসা সেবায় এগিয়ে এসেছে ইসলামি সাহায্য সংস্খা সহ ভিনদেশী এনজিওরা।
পাশাপাশী চলছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ষড়যন্ত্র আর ভিনদেশী লুটেরাদের নানামুখি অপতৎপরতা ।
সংকটের দেশ লেবানন
বাইরে সবকিছু ঠিক ঠিক চলছে দাবী করা হলেও ভেতরে ভেতরে দেশের ঘটনাবলীল ওপর প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছিল সরকার। আভ্যন্তরীন সংঘাত আর রক্তপাতের ঘটনার খবর প্রকাশ পাচ্ছিল অহরহই । লেবাননে দোর্দন্ড প্রতাপে অবস্থান করছে সশস্ত্র হিজবুল্লা গেরিলা গ্রুপ। ইরানের সহায়তা নিয়ে প্যালেষ্টাইনের মুক্তির জন্য তারা সুযোগ পেলেই ইসরাইলের ওপর হামলা চালাচ্ছে। মর্টার, মিসাইল এমনকী ড্রোন হামলা চালাবার মতো সক্ষমতা তারা দেখিয়েছে ইতোমধ্যেই। লেবানের রাজনীতিতেও রয়েছে তাদের ব্যাপক প্রভাব। ২০০৫ সালে লেবানের প্রধানমন্ত্রী হারারীকে হত্যার জন্য দায়ি করা হয় হিজবুল্লাহকে। হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে পরিচালিত ইসরাইলের গোলা এসে বিষ্ফোরিত হচ্ছে লেবাননের মাটিতে। দেশটিতে যারা সরকার চালাচ্ছেন তাদের জবাবদিহিতার বালাই নেই।
গত মঙ্গলবারের বিষ্ফোরনের আগেই কার্যত: ভেঙ্গে পড়ছিল লেবানন। অর্থনৈতিক বিপর্যয়, ব্যাপক মুদ্রাষ্ফীতি আর বেকারত্ব নিয়ে লেবানন যখন চরম দুর্দশায় নিমজ্জিত তখন কোভিড মহামারীতে ব্যাপকভাবে আক্রান্ত হয়ে সম্পূর্ণ পর্যুদস্ত দেশটি। । এমরকম অবস্থায় এমন ভয়াবহ বিষ্ফোরণের পর সরকারের বিরুদ্ধেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছে লেবাননবাসী।
বিক্ষুব্ধ বৈরুতবাসী বৃহস্পতিবার ক্ষমতাসীন সরকারের পদত্যাগের দাবীতে রাস্তায় বিক্ষোভ করেছে। সরকারী অফিস লক্ষ্য করে পাথর নিক্ষেপ করেছে। অগ্নি সংযোগ করেছে এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে।
বিষ্ফোরনের দু’দিন পর সহমর্মিতা জানাতে বৈরুতে এলেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমমানুয়েল ম্যাকরণ। ফ্রান্স থেকে তিনটে উড়োজাহাজ বোঝাই করে অষুধপত্র, অস্থায়ী ক্লিনিক বানাবার সরজ্ঞামাদি এবং উদ্ধারকর্মীও এসেছে তার সাথে। এ সময় বৈরুতের বিক্ষুব্ধ মানুষ ফ্রান্সের প্রেসিন্টের কাছে কাছে দাবি জানায়, কোন সাহায্য যেন সরকারের হাতে না দেওয়া হয়।
এ অবস্থায় বৃহস্পতিবার ৪৪,০০০ হাজার লেবানী নাগরিক গনস্বাক্ষর করে উপনিবেশিক শাসক ফ্রান্সের ফিরে আসার আহবান জানিয়েছেন। তারা দাবী করেছেন, অন্তত: দশ বছরের জন্য দেশটিকে ফরাসী শাসনের অধীনে নেওয়া হোক।
কেন, কীভাবে বিষ্ফোরণ
লেবাননের প্রেসিডেন্ট মিশেল আওউন বলেছেন প্রায় ২৭০০ টন এমোনিয়াম নাইট্রেট বৈরুত সমুদ্রবন্দরের গুদামে সাত বছর ধরে অনিরাপদভাবে পরিত্যাক্ত অবস্থায় মজুদ ছিল। সেখান থেকেই বিষ্ফোরণ ঘটেছে। এ মর্মান্তিক ঘটনায় এ যাত ১৫৭ জন নিহত ও পাঁচ হাজারের বেশী মানুষ আহত হয়েছেন। শ’খানেক মানুষ ধ্বংসস্তুপের মাঝে নিখোঁজ রয়েছেন। বিশাল এলাকা জুড়ে বাড়ি-ঘর ও ভবন ধ্বস হবার কারনে হাজার হাজার মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। এ ঘটনায় পোর্টের বেশ কিছু স্থাপনা এবং নিকটবর্তী শষ্য ভান্ডার (সাইলো) ধ্বংস হয়ে গেছে । দেশের ৮৫ ভাগ খাদ্য শষ্যের মজুদ ছিল এ ভান্ডারে। বিষ্ফোরণের পর লেবাননে দু’সপ্তাহের জন্য জরুরী অবস্থা জারী করা হয়েছে।
রাসায়নিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমোনিয়াম নাইট্রেট যেমন সার তৈরির কাজ লাগে তেমনি বোমা বানানোর কাজেও লাগে। তারা মনে করেন, কোন একটা সামরিক অভিযানকে আড়াল করতে এ বিষ্ফোরনের বিষয়টিকে নিছক দুর্ঘটনা বলে প্রচার করা হতে পারে।
তবে, জাহাজ ব্যবসার ফাইল ঘেটে জানা গেছে, রোসাস নামক এই রাশিয়ান কার্গো জাহাজ ২০১৩ সালে ২৭৫০ টন এমোনিয়াম নাইট্রেট বোঝাই করে জর্জিয়া থেকে মোজাম্বিকের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করে। পথে জাহাজটি তেল সংগ্রহ করার জন্য বৈরুত বন্দরে হাজির হয়। এরপর বন্দর কর্তৃপক্ষ বিষ্ফোরক রাসায়নিক বেঝাই জাহাজটিকে আর বন্দর ছাড়ার অনুমতি দেয় নি। তবে এ রাসায়নিক পদার্থের চালানটি জাহাজ থেকে খালাস করে বন্দরের গুদামে অনিরাপদভাবে ফেলে রাখে বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিশেষজ্ঞগ মনে করছেন, এতো বিপুলর পরিমান রিষ্ফোরকদ্রব্য এভাবে লোকালয়ের পাশে এতিদিন ধরে অনিরাপদ অবস্থায় ফেলে রেখে এমন একটি ভয়ানক বিষ্ফোন ঘটতে দিয়ে বন্দর কর্তৃপক্ষ বড় রকমের অপরাধ করেছে।
এদিকে, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন বৈরুতে বিষ্ফোরনের ঘটনার স্বাধীন তদন্ত দাবী করেছেন। একই সাথে লেবাননবাসীকে এমন বিপদের সময় সহায়তা করার জন্য বিশ্বের সরকার সমূহকেও আহান জানিয়েছেন।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ জ রুরী খাবার, অষুধপত্র, চিকিৎসক, আশ্রয়ের জন্য তাবু এবং উদ্ধার কাজের সাজসরঞ্জাম সহ ঊদ্ধারকর্মী পাঠিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অষ্ট্রেলিয়া সহ কয়েকটি দেশ অর্থ সাহায্য দেবার ঘেষনা দিয়েছে ।
ইতোমধ্যে ২২ সদস্যে একটি ফরাসী তদন্ত টীম বৈরুতে এসে কাজ শুরু করেছে।
এছাড়া লেবানন সরকারের গঠিত তদন্ত টিমকে চারদিন সময় দেওয়া হয়েছে দায়ী দুষ্কৃতিকারীদের চিহ্নিত করতে। এ বিষ্ফোরনের ঘটনায় বাইরের কোন হস্তক্ষেপ আছে কীনা সেদিকটিও খতিয়ে দেখছে তদন্তটীম।
তবে মার্কিন প্রসিডেন্ট ডেআনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন এটি ছিল একটি পরিকল্পিত হামলা। তবে কারর এ হামলার জন্য দায়ী তা তিনি খোলাসা করে বলেননি।
(আগষ্ট ০৮, ২০২০)