এহ্সান উদ্দিন


শিক্ষা ও সমাজ গুরুত্বপূর্ণ এই অর্গান দুটো অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। একটি আরেকটিকে ব্যতিরেকে প্রস্ফুটিত হয়ে আলো ছড়াতে পারে না। বার্ট্রান্ড রাসেল তাঁর ‘On Education’ গ্রন্থে বারবার বলবার চেষ্টা করেছেন মূলত একটি জাতি বা সমাজের পরিবর্তন সাধিত হয় গুনগত শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে। এবং বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের অন্যতম প্যারামিটারই হলো শিক্ষা। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র থেকে বিস্তৃত হয়ে গোটা পৃথিবীব্যাপী তার প্রভাব পড়ে। শিরোনাম টেকনাফের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে লিখবো বলে ঠিক করলেও এটি যে গোটা দেশের শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করবে না, এমনটি ভাববার কোনো কারণ নেই।
চার লক্ষাধিক মানুষের বসবাস পাহাড় সাগরের মধুর সম্মিলনে গড়ে ওঠা বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণের উপজেলা টেকনাফ। এসডিজি যুগ খ্যাত সময়ে এসেও ৫৬ কিলোমিটার দৈর্ঘের নাফনদী ঘেঁষে বসতি গড়া টেকনাফ উপজেলাকে শিক্ষাদীক্ষা, অর্থনীতি, সমাজনীতি ও রাজনীতিতে অনগ্রসর, অবহেলিত বা পিছিয়ে পড়া অঞ্চল বলে গড়পড়তা কথাবার্তা বলবার পক্ষপাতী আমি নই। আমি সবসময় ইতিবাচকভাবে টেকনাফকে মূল্যায়ন করবার চেষ্টা করি এবং প্রায়শই বলে থাকি এই জনপদ অপার সৌন্দর্যের ও সম্ভাবনার। এই অঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ চাষাভূষা হলেও তাঁরা ব্যবসাবাণিজ্যে অন্য কারো চেয়ে কম যান না। সীমান্ত জনপদ হওয়ায় মাদক, মানবপাচার, চোরাচালানের বদনাম মাথায় নিয়ে যেভাবে দেশব্যাপী তিরষ্কৃত হয়ে তটস্থ থেকেছে এ এলাকার মানুষ। একই কারণে বাড়তি একটা সুবিধাও পেয়ে এসেছে যুগযুগ ধরে। যার দরুন দরিদ্রের কষাঘাতে পিষ্ট হয়ে ধুমড়ে মুচড়ে পড়া লোকের সংখ্যা এ অঞ্চলে নেহাত কম। বলা চলে দেশের পর্যটন শিল্পের জন্য এ জনপদ বিষ্ময়াভিভূত। সাবজেক্টিভ আলোচনার নিরিখে টেকনাফের শিক্ষা বিষয়ক আদ্যোপান্ত নিয়ে আলোকপাত করবার আগে কিছু পরিসংখ্যানভিত্তিক বিষয়ের উপর রেখাপাত করে সামনের দিকে এগুনো সমীচীন হবে। কাগজে কলমে যদি বলি টেকনাফে বর্তমান শিক্ষার হার ২৬ শতাংশের কাছাকা‌ছি। ১টি ডিগ্রি সমমান সরকারি কলেজ, ১টি উচ্চ মাধ্যমিক বেসরকারি কলেজ, ১টি কামিল মাদ্রাসা, মাধ্যমিক, দাখিল, নিম্ন মাধ্যমিক, বালিকা বিদ্যালয়, বালিকা মাদ্রাসা ও ৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ টেকনাফে শখানেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ১৮৯০ সনে প্রতিষ্ঠিত টেকনাফ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মতন ১৩০ বছরের প্রাচীন শিক্ষালয়ও রয়েছে এখানে। এছাড়া মক্তবভিত্তিক আরবি শিক্ষা, বেশ কয়েকটি কিন্ডারগার্টেন এবং কওমি কারিকুলামের কয়েকটি মাদ্রাসাও রয়েছে টেকনাফে। সবমিলিয়ে একটি শতভাগ শিক্ষানির্ভর উপজেলা গঠনের উপাদান থাকা সত্ত্বেও এক চতুর্থাংশ সাক্ষরতার হারের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে টেকনাফের শিক্ষা গতি। দেশে যেখানে সাক্ষরতার হার ৭৪ ভাগ ছাড়িয়েছে, সেখানে টেকনাফের স্থবির অবস্থার কয়েকটি কারণ আইডেন্টিফাই করবার চেষ্টা করবো কিছু তথ্যালোকে। তার আগে আমাদের দেশের শিক্ষানীতি নিয়ে ক’খানা কথা বলে নিই। ১৮৫৪ সালে ঔপনিবেশিক শাসনামলে এদেশে প্রথম ডেচপাচ শিক্ষানীতি চালু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান পিরিয়ডে গঠিত বিভিন্ন শিক্ষা কমিশন, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কুদরত এ খুদা শিক্ষা কমিশন এবং সর্বশেষ ২০০৯ সালের কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশনের সুপারিশকৃত নীতিমালার আলোকে আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থা একটি সিস্টেমের ভেতর দিয়ে চলছে। পদ্ধতিগতভাবে টেকনাফেও এর কোনোরকম ব্যত্যয় ঘটেনি। মুখ্যত শিক্ষার্জন একটি দর্শনগত ও চেতনাবোধের বিষয়। যেখানটাই পাবলিক এ্যাওয়ার্নেসের গুরুত্ব সবথেকে বেশি। এছাড়া টেকনাফে আলোকিত মানুষের সংখ্যাও কোনো অংশে কম নয়। দেশবিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, বিচারপতি, ব্যারিস্টার, সরকারি আমলা, ডাক্তার, ব্যাংকার, আছে আরো বহুগুণে বহুভাবে প্রতিষ্ঠিত মানুষজন। কী এমন নেই যা টেকনাফে খামতি রয়েছে। সবকিছু থাকার পরও একটি মৌলিক প্রশ্ন হলো তাঁরা টেকনাফের প্রজন্মকে কতোটুকু প্রভাবিত করতে পেরেছেন। এবং যাঁদের পথ দেখানোর কথা সে মানুষগুলো টেকনাফকে কতোটা ওন করছেন, সেটিও একটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। বলা বাহুল্য টেকনাফে শিক্ষাক্ষেত্র কতোটুকু সচল থেকেছে কিংবা অগ্রগতি হয়েছে একটু হিসেব কষলে তার যুতসই প্রমাণ মেলে। ২০ বছর আগে টেকনাফে সাক্ষরতার হার ছিলো ৭ শতাংশ ছুঁইছুঁই। নারীশিক্ষার ক্ষেত্রেও এ অঞ্চলে একধরণের ট্যাবু কাজ করতো। সেটা ধীরেধীরে ডেভেলপ হয়েছে। অর্থাৎ অনেকটা নেই বললে চলে। অনেস্টলি বললে এই ক’বছরে টেকনাফে শিক্ষার অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো, যদিও ৪-৫ বছরে এ ধারাবাহিকতায় কিছুটা ভাটা পড়েছে। কমেছে ঝড়ে পড়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার অধীনে উল্লেখযোগ্যভাবে নিশ্চিত হয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়টিও। ভুল হবে না যদি বলি টেকনাফের সবকিছু পজিটিভলি এগুচ্ছে এবং এ এগুনোর পথটি আরো মসৃণ ও তরান্বিত করবার জন্য কিছু সমন্বিত উদ্যোগের বিষয়ে আলোচনার ডিমান্ড রাখে। জাস্ট এইটুকুই। পরামর্শ যদি দিতেই হই বলবো কিছু ইফেক্টিভ সার্বজনীন পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেমন জরুরি, তেমনই কিছু মৌলিক পরিবর্তনে সর্বস্তরের কমিউনিটিকে ইনভলভ্ করাও অত্যাবশ্যকীয়। মাদকের মাত্রাতিরিক্ত সয়লাব, বাল্যবিবাহ, শিশুশ্রম এই সমস্যাগুলো টেকনাফে প্রকট। এছাড়া জনসংখ্যার একটা অংশ সম্পূর্ণ অক্ষরজ্ঞানহীন। কর্মজীবী যুবক, মধ্যবয়সি নারি পুরুষ বস্তুত এর অংশ। উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন এ অঞ্চলে তেমন একটা নেই। কথার কথা গ্রাম মহল্লায় সচেতন কিছু মানুষ চাইলে বয়স্ক স্কুল কিংবা নৈশ বিদ্যালয় নাম দিয়ে বিরাট এই জনগোষ্ঠীকে অক্ষরজ্ঞানসম্পন্ন করে গড়ে তুলতে। ভিন্ন ভিন্ন নামে এই ব্যবস্থা শহরাঞ্চলে প্রচলন আছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা হলো সৃজনশীল মেধা বিকাশে এই অঞ্চলের ছেলেমেয়েরা ব্যাপক অনাগ্রহী। বই পড়ার প্রতি রুচি একেবারে নেই। গুণীর প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান ও কদর করার রেওয়াজ টেকনাফে ভীষণভাবে অনুপস্থিত। এই বিষয়টিকেও হেলা করা মোটেও সমীচীন হবে না। মোদ্দাকথা মানবিক টেকনাফ বিনির্মাণে প্রতিটি ওয়ার্ড, ইউনিয়ন ও উপজেলায় জনপ্রতিনিধি নির্বাচনে শিক্ষিত ও শিক্ষার প্রতি যথেষ্ট অনুরাগী কিনা খতিয়ে দেখবার সময় এসেছে। ইউনিয়নভিত্তিক একটি করে সমৃদ্ধ লাইব্রেরি স্থাপন করে মেধা বিকাশের জায়গাটাতে ইমপ্রোভ করার বেশ সুযোগ রয়েছে। আমি আজ পর্যন্ত টেকনাফকে একটি স্বাস্থ্যকর জনপদ বলতে একটুও কুণ্ঠাবোধ করবো না। আগামী পাঁচ দশ বছরের মধ্যে এই ধারা অব্যাহত থাকবে কিনা তা নিয়ে ঢের সংশয় সন্দেহ আছে। যদি সচেতনতার ব্যাপক ফলন না হয়, টেকনাফ পেছনের দিকে ঠেকে একটি অন্তঃসারশূন্য প্রজন্ম তৈরি হবে মোটামোটিভাবে আশংকা করা যায়। রোহিঙ্গা ইনফ্লাক্স ও মাদক এই দুটো প্রবলেমকে সামনের কাতারে রেখে উল্লিখিত প্রবলেমগুলো সলভ্ করবার জন্য শর্ট টার্ম কিংবা মিড টার্ম বেসিসে কিছু পদক্ষেপ হাতে নিলে পরে আমরা সবাই মিলে ক্ষীণ আশার আলো দেখতে পারি। আশার ভেলায় বসে সুখের কেতন উড়িয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি সুখি, সমৃদ্ধ, মার্জিত ও রুচিশীল টেকনাফের। এবং এই টেকনাফ হবে ম্যুরালি হাই ডেভেলপড্ এবং অনুকরণীয়।


লেখক :  এহ্সান উদ্দিন ,প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, কক্সবাজার সিটি কলেজ।