রেজাউল করিম চৌধুরীঃ
২০১৭ সালের আগস্টে রোহিঙ্গাদের আগমনের প্রায় শুরু থেকেই আমরা কক্সবাজার সিএসও এনজিও ফোরামের (সিসিএনএফ) মাধ্যমে স্থানীয় সুশীল সমাজ, সমাজভিত্তিক ও বেসরকারি সংস্থাসমূহ রোহিঙ্গা ত্রাণ কর্মসূচিতে স্থানীয়করণের দাবিতে ঢাকায় এবং কক্সবাজারে বেশ কিছু সেমিনার এবং সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি। স্থানীয়করণের মানে কোনওভাবেই স্থানীয় সমাজে বা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের একত্রীকরণ নয়, বরং রোহিঙ্গা ত্রাণ কর্মসূচি ব্যবস্থাপনায় স্থানীয়দের অংশগ্রহণ তথা নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করাই হলো স্থানীয়করণের মূল কথা।

গ্র্যান্ড বার্গেইন (জিবি) নামক একটি চুক্তির ফলাফল এই ‘স্থানীয়করণ’, জাতিসংঘ আয়োজিত ওয়ার্ল্ড হিউম্যানিটারিয়ান সামিটের দুই বছর পর, ২০১৬ সালের মে মাসে জাতিসংঘের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সকল অঙ্গসংস্থা, অনেক উন্নত দেশ এবং আন্তর্জাতিক এনজিও (আইএনজিও) এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। জেনেভাতে একটি কমিটি রয়েছে যারা এই জিবি বাস্তবায়নের জন্য নিয়মিত সভা, গবেষণা এবং পর্যালোচনা করে থাকে। বর্তমানে জিবিতে ৯টি ধারার আওতায় ৫১টি সূচক রয়েছে, এগুলি সব পরিমাপযোগ্য। প্রধান তিনটি ধারা হলো উন্নয়ন সহায়তায় স্বচ্ছতা, অর্থায়ন, উন্নয়ন/মানবিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে স্থানীয় এবং জাতীয় অংশীজনদেরকে সহযোগিতা এবং অংশগ্রহণ বিপ্লব। এই জিবি চুক্তিতে স্থানীয়করণ ছাড়াও বিভিন্ন কার্যক্রমের সমন্বয়, খরচ কমিয়ে আনা, প্রতিবেদনের সমন্বয়, উন্নয়ন এবং মানবিক কর্মসূচিগুলো সংহতকরণের দিকনির্দেশনাও রয়েছে।

এই ধরণের চুক্তি মানার ক্ষেত্রে আইনগত বাধ্যবাধকতা না থাকলেও, নৈতিক দায়িত্ব অবশ্যই আছে। ২০০৭ সালে ‘অংশীদারিত্বের মূলনীতি’নামের এমন আরও একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলো। তাতে সাম্যতা, স্বচ্ছতা, ফলাফল ভিত্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, দায়বদ্ধতা এবং পরিপূরকতার বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিলো। বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক রেড ক্রস / রেড ক্রিসেন্সসহ জাতিসংঘের প্রায় সমস্ত সংস্থা, বড় বড় আইএনজিওরা এতে স্বাক্ষর করেছে। আইএনজিওরা ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে চার্টার ফর চেঞ্জ (সি4সি) চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এক্ষেত্রে আরও একটু এগিয়েছে।

এই COVID 19 পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ আন্ত-সংস্থা স্থায়ী কমিটির (আইএএসসি) অধীনে মানবিক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কিত সর্বোচ্চ কমিটি ‘কভিড ১৯-এর সময় স্থানীয়করণ সম্পর্কিত অন্তর্বর্তী নির্দেশনাবলী’ নামে আরেকটি নির্দেশনাবলী জারি করেছে, এতে তারা স্থানীয় ও জাতীয় এনজিও এবং স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নেতৃত্বে নিয়ে আসার উপর গুরুত্বারোপ করেছে। তারা এর উপর সর্বোচ্চ জোর দিচ্ছে কারণ বিদেশিদের ক্ষেত্রে মাঠ পর্যায়ে চলাচলে নিষেধাজ্ঞা আছে এবং বৈদেশিক সাহায্যের পরিমাণ ধীরে ধীরে কমে আসছে।

স্থানীয়করণ বলতে মানবিক ও উন্নয়ন কার্যক্রমে স্থানীয় সরকার এবং স্থানীয় সংস্থা (এনজিও এবং সমাজভিত্তিক প্রতিষ্ঠান)এর নেতৃত্ব বোঝায়। এটি প্রয়োজন কারণ, এটি সম্ভব হলে বাইরের কোন অর্থ সহায়তা না থাকলেও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো টেকসইভাবে প্রয়োজনে সংকটে সাড়া দিতে পারবে, কারণ স্থানীয় সংস্থাগুলোর ব্যয় কম, সাহায্যের অর্থ স্থানীয় অর্থনীতিতেই রয়ে যাবে বিভিন্নভাবে, এতে করে স্থানীয় অর্থনীতি পুনরুদ্ধার হয় এবং পুনর্নির্মাণ সম্ভব হয়। স্থানীয়দের নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে স্থানীয় সংস্কৃতি বজায় রাখা এবং জোরদার করা হবে, সর্বোপরি স্থানীয় সমাজ মানবাধিকার এবং শরণার্থী অধিকার রক্ষায় এগিয়ে আসবে।

আমরা স্থানীয় এবং জাতীয় সংস্থাগুলোকে আলাদা করে দেখছি। কক্সবাজারের একটি স্বতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট আছে, তাই কক্সবাজোর মতো একটি সাংস্কৃতিক অঞ্চল থেকে উদ্ভূত সংস্থাগুলোকেই আমরা স্থানীয় সংস্থা হিসেবে সংজ্ঞায়িত করছি (এনজিও বা সিবিও হোক), যার উদ্ভব হয়েছে কক্সবাজারে বা এর নেতৃত্বটি এসেছে কক্সবাজার থেকে। জাতীয় সংগঠন বলতে কক্সবাজার অঞ্চল বাদে দেশের অন্য কোনও জেলায় যায় উদ্ভব তাকেই বোঝানো হচ্ছে । এটা খুব স্বাভাবিক যে, স্থানীয় সংগঠন এবং স্থানীয় সাংগঠনিক নেতা সর্বদা তার নিজের অঞ্চলের প্রতি বিশেষ নজর দিবেন, স্থানীয় সমাজেও তার প্রবেশাধিকার থাকবে বেশি, তাছাড়া নিজের অঞ্চলের মানুষের প্রতি তার একটি বিশেষ জবাবদিহিতাওথাকবে।

রেজাউল করিম চৌধুরী
নির্বাহী পরিচালক, কোস্ট ট্রাস্ট
৪ জুলাই ২০২০ ইং