যুগান্তর :

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, করোনাভাইরাস আমাদের কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ পরিস্থিতিতে দেশের একটি মানুষও যেন কষ্ট না পায়, খাদ্যের অভাবে না থাকে- সেই চেষ্টা করে যাচ্ছি। অন্যান্য দেশ না পারলেও এই করোনাকালের মধ্যে সরকার বাজেট দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

তিনি বলেন, করোনার কারণে দেশের অনেক কিছু স্থবির হয়ে যায়, যারা দিন এনে দিন খায়, তাদের অনেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েন। তাদের প্রত্যেককে খুঁজে খুঁজে বের করে সাহায্য পৌঁছে দিয়েছি, অর্থ সহায়তা দিয়ে যাচ্ছি।

বুধবার জাতীয় সংসদে শোক প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এ সব কথা বলেন।

স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে এই আলোচনায় আরও অংশ নেন সাবেক কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, জাসদ সভাপতি হাসানুল হক ইনু, বিরোধীদলীয় চিফ হুইপ মশিউর রহমান রাঙ্গা ও সাবেক চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ।

আলোচনায় অংশ নিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসে মরি, গুলি খেয়ে মরি, অসুস্থ হয়ে মরি, মরতে একদিন হবেই। এই মৃত্যু যখন অবধারিত সেটাতে তো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি ভয় পাইনি। কখনও ভয় পাব না। আর আমি যখন বাংলাদেশে ফিরে আসি সেটা ছিল সেই বাংলাদেশ যেখানে আমার বাবা-ভাই-বোন শিশু ভাইটিকে পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের পরিবারের বহুজন সদস্য বুলেটবিদ্ধ, আওয়ামী লীগের অনেক নেতাকর্মী বুলেটবিদ্ধ স্প্লিন্টার নিয়ে অনেকে বেঁচে আছেন।

শেখ হাসিনা তার বক্তব্যে আরও বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে সবারই কাজ করার সুযোগ ছিল না। যারা নিয়মিত চাকরির বেতন পেতেন তার বাইরে কিছু লোক থাকে যারা ছোটখাটো কাজ করে খান, ব্যবসা করে খান। প্রতিটি মানুষের খবর নিয়ে নিয়ে তাদের ঘরে ঘরে খাবার ব্যবস্থা করি। এমনকি রিকশার পেছনে যারা আর্ট করে এমনকি সাংস্কৃতিককর্মী তাদেরকে কিছু সরকারিভাবে, কিছু আমাদের ত্রাণ তহবিল থেকে সাহায্য সহযোগিতা করেছি। আর্টিস্ট বা শিল্পী কিংবা শিল্পীদের সহযোগিতা করে তাদের কথা কেউ ভাবে না- এই ভাবনাটা কিন্তু আমার নিজের না। সত্যিকারের কথা বলতে এটা শেখ রেহানার চিন্তা। সেই কিন্তু খুঁজে খুঁজে তাদের সাহায্য দেয়ার ব্যবস্থা করেছে।

তিনি বলেন, প্রত্যেকটি জেলায় জেলা প্রশাসকের কাছে এ জন্য আলাদাভাবে ত্রাণ দিয়ে রেখেছি যাতে তারা সাহায্য পান। আমাদের দলের নেতাকর্মী যে যেখানে আছে যে যেটুকু পেয়েছে প্রত্যেককেই সাহায্য করেছে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষও সাহায্য করছে।

প্রধানমন্ত্রী করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে মৃত্যুবরণকারী সবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মুক্তিযোদ্ধা থেকে শুরু করে দেশের চরম দুঃসময়ে যারা নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা একে একে মৃত্যুবরণ করছেন, মনে হচ্ছে ইতিহাসের পাতা থেকে একটা একটা করে পাতা ঝড়ে পড়ছে।

তিনি আরও বলেন, চরম এই দুঃসময়ে প্রশাসন থেকে শুরু করে সবাই একতাবদ্ধ হয়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছেন। পুলিশ, র্যা ব, আনসার ও ভিডিপি, সশস্ত্র বাহিনী, বিজিবি, চিকিৎসক, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, গণমাধ্যমকর্মীরা প্রতিনিয়ত এ দুঃসময়ে সাহসের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন, এদের মধ্যে অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। তাদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

করোনাভাইরাসের পাশাপাশি ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবেলা করা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের সময়ে প্রায় ২৪ লাখ লোককে আমরা নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিয়েছিলাম। স্বাস্থ্যবিধি মেনে বিপুলসংখ্যক মানুষকে নিরাপদ শেল্টারে সরিয়ে ফেলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানে অনেক কিছুর ক্ষতি করতে পারলেও আমরা অনেক মানুষের জীবন রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছি।

করোনার দুঃসময়ে কষ্টে থাকা মানুষকে পর্যাপ্ত সহযোগিতা পৌঁছে দেয়ার কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ছাড়াও অনেক বিত্তশালী সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। অনেকে নিজেদের আত্মীয়ের লাশ ভয়ে ফেলে চলে গেছেন, পুলিশ ছাড়াও আমার ছাত্রলীগের ছেলেরা সেই লাশ দাফন করছেন। ভীত হয়ে আত্মীয়ের লাশ ফেলে যাওয়া- এটা একটা অমানবিক কাজ। আমার নির্দেশে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ছাড়াও কৃষক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, যুবলীগের ছেলেরা কৃষকের পাশে দাঁড়িয়ে ধান কেটে দিয়েছে, ধান মাথায় নিয়ে কৃষকের বাড়ি পৌঁছে দিয়েছে।

তিনি আরও বলেন, আল্লাহ মানুষকে কিছু কাজ দেয়, সেই কাজটুকু করতে হবে। সেই কাজ যতক্ষণ শেষ না হবে, ততক্ষণ আমি কাজ করে যাব। যখন সময় শেষ হয়ে যাবে আমিও চলে যাব। এ নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। সংসদে বাজেট এই দুর্যোগের সময় অনেক দেশ দিতে পারছে না। আমি বলেছি, না একদিকে করোনা মোকাবেলা করব, অন্যদিকে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাপনটা যাতে চলে, তারা যেন কষ্ট না পায়, সে জন্য যা করণীয় সেটা আমি করে যাব। আমি তো এখানে অনন্তকাল বেঁচে থাকার জন্য আসিনি। আমি তো জীবনটা বাংলার মানুষের জন্য বিলিয়ে দিতেই এসেছি। কাজেই এটা ভয় পাওয়ার কিছু নেই। চলুন সবাই মিলে আল্লাহর কাছে দোয়া করি এই করোনাভাইরাসের হাত থেকে মানব জাতি যেন রক্ষা পায়।

প্রয়াত সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লার মৃত্যু প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৮১ সালে বাংলাদেশে ফিরে আসার পর যাদেরকে সব সময় পাশে পেয়েছি প্রয়াত সংসদ সদস্য হাবিবুর রহমান মোল্লা তাদের একজন। অত্যন্ত সাহসী ও ত্যাগী নেতা ছিলেন। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে প্রথম কাতারে থেকে তিনি নেতৃত্ব দিয়েছেন। একে একে অনেককেই আমরা হারিয়ে ফেলছি, কিন্তু বর্তমান এমন একটা পরিস্থিতি তাতে মৃত্যুর পর অনেক পরিচিতদের দেখতে পর্যন্ত যেতে পারছি না। অপর সাবেক সংসদ সদস্য মকবুল হোসেন অসুস্থ থেকেও এলাকার মানুষের ঘরে ঘরে গিয়ে সহায়তা। আমি নিষেধ করার পরও তিনি শুনেননি, উল্টো বলেছেন মানুষের কাছে না গেলে তার ভালো লাগে না।

প্রয়াত বীর মুক্তিযোদ্ধা মমতাজ বেগম প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যখন অনার্সে পড়ি, তখন মাস্টার্সের ছাত্রী ছিলেন মমতাজ বেগম। একসঙ্গে অনেক আন্দোলন-সংগ্রাম, মিছিল করেছি। এক-এগারোর সময় আমি বিরোধী দলের নেতা হলেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। আমার বিরুদ্ধে বিএনপি ছাড়াও এক-এগারোর সময় অনেক মিথ্যা মামলা দেয়া হয়। আমাকে যখন আদালতে আনা-নেয়া করা হয়, তখন মমতাজ বেগমকে দেখেছি সেখানে দাঁড়িয়ে থাকতে, সব সময় উনি আমার পাশে ছিলেন।

প্রয়াত সংসদ সদস্য কামরুন নাহার পুতুল প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর যারা প্রতিবাদ করেছেন তাদেরকে অনেককেই জিয়াউর রহমান হত্যা করেছে। সাবেক এমপি পুতুলের স্বামী বীর মুক্তিযোদ্ধা মোস্তাফিজুর রহমান পটলকে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করায় তাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।

নিজের প্রিয় শিক্ষক এমিরেটার্স অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রী বা যাই-ই হই না কেন, আনিসুজ্জামান স্যারকে আমি সব সময় নিজের শিক্ষক হিসেবেই সম্মান করতাম। তার বয়স হয়েছিল। তার চিকিৎসার সব ধরনের ব্যবস্থাও করেছিলাম। এই দুঃসময়ে অনেক বিশিষ্টজনকে আমরা হারিয়েছি। কাকে ছেড়ে কার কথা বলব। প্রকৌশল জামিলুর রেজা চৌধুরী পদ্মা সেতু নির্মাণে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন, সব সময় খোঁজ-খবর রাখতেন। তার অবদান সবাই শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

আলোচনার শেষ পর্যায়ে সংসদ সদস্য মোহাম্মদ নাসিম ও সাহারা খাতুনের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন প্রধানমন্ত্রী।