মো. ওমর ফারুক জয়

আজ সৌদি আরব সহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি দেশে মহামারী করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে পালিত হচ্ছে মুসলিম ধর্মের সর্বোচ্চ ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর। সাম্প্রতিক সময়ে চীনের উহান শহর থেকে সৃষ্ট করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। বিশ্বের প্রায় ৯৭ শতাংশ দেশ আজ লকডাউনে। সেসকল দেশের অভ্যন্তরীণ যোগাযোগেও বেশ কড়াকড়ি। কোনো কোনো দেশে কারফিউও জারি করা হয়েছে নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে। বৈদেশিক যোগাযোগও বন্ধ। করোনার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গমন করা প্রবাসীদের জীবন ও জীবিকায়। করোনা পরিস্থিতিতে প্রবাসী শ্রমিকরা লকডাউনের কারণে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। এতে করে প্রবাসীদের ওপর নির্ভর করে ঠিকে থাকা তাদের নিজ পরিবার পরিজনদের জন্যও ঠিকমতো টাকা পয়সা পাঠাতে পারছেন না তারা। নিজেরাও প্রবাসে দিনানিপাত করতে হিমশিম খাচ্ছেন রীতিমতো।

ঈদে আনন্দ কিংবা উল্লাস থাকলেও এবার সেই অনাবিল আনন্দের আবহ নেই। খুশির জোয়ারও নেই। সবকিছু থমকে গেছে। দেশে বিদেশে অনেকে মারা গেছেন। অনেকেই হাসপাতালে রোগ যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। স্বজন হারানোর বেদনা সর্বত্র। এই বৈশ্বিক মহামারী পৃথিবী থেকে খনিকের জন্য যেন সব আনন্দ তুলে নিয়ে গেছে। যে যুবকটি তার সদ্য বিবাহিত স্ত্রীকে দেশে রেখে এসেছেন, তার কি খুব কষ্ট হবে না! যাদের বৃদ্ধ মা-বাবা, ভাই-বোন রয়েছে দেশে, কোনো এক নির্জন মুহূর্তে সে-কি চোখের পানি ফেলবে না! এই করোনার কারণে সৃষ্ট অভাব আমাদের আবার স্মরণ করিয়ে দিল ‘সাধ্যের মধ্যেই আছে সকল সত্য।’ সবাইকে সঙ্গে নিয়ে নিরাপদে থাকি ও বাঁচি। এবার ঈদে এটাই পণ। আর সেটাই হবে এই করোনা আক্রান্ত পৃথিবীতে ভার্চুয়াল ঈদের আনন্দ। জীবিকার তাগিদে কারো ছেলে, কারো ভাই, কারো বাবা, কারো স্বামী অন্যের সুখের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দিয়ে বিদেশ গমন করে।

সারাবিশ্বে যতজন প্রবাসী বাংলাদেশী বসবাস করে তাদের সিংহভাগই মধ্যপ্রাচ্যে বসবাস করে। সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কাতার, কুয়েত, ওমান, ভারত, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, যুক্তরাজ্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, দক্ষিণ আমেরিকার দেশ ব্রাজিল, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ বেশ কয়েকটি দেশ মিলিয়ে পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিদেশের মাটিতে ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক রয়েছেন। প্রবাসীদের পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা অর্থাৎ রেমিটেন্স বাংলাদেশের আয়ের প্রধান উৎস।

বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন দেশে গমন করা প্রবাসীদের মধ্যে ৯০ শতাংশই শ্রমিক। তাদের মধ্যে বাকি ১০ শতাংশ দোকানের মালিক বা বিভিন্ন ব্যবসায়ের সাথে জড়িত। প্রবাসী শ্রমিকরা দৈনিক, পাক্ষিক কিংবা মাসিক বেতনে অন্যের অধীনে চাকুরি করেন। তাদের যে মাসিক আয় তার এক-তৃতীয়াংশই নিজের রুম ভাড়া, খাওয়া, মোবাইল বিল ও অন্যান্য খরচে চলে যায়। বাকি দুই-তৃতীয়াংশ পরিবারের কাছে পাঠান। তাতে ঘর খরচ, ছেলে- মেয়ের স্কুলের খরচ, ভাই-বোনের বিবাহ, মা-বাবার চিকিৎসা খরচ ও সহধর্মিনীর হাত খরচ সহ যাবতীয় ব্যয় মেটানো হই। সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার কারণে বিভিন্ন সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। কিন্তু অনেকের ভাগ্যে ঠিকমতো বেতন জোটে না। পরিচিত অনেকের সাথে কথা বলে জানতে পারি, কোনো কোনো সময় ৪ থেকে ৫ মাস পর্যন্ত বেতন বাকি থাকে। তখন ধার-কর্জ করে প্রিয়জনের সুখের জন্য টাকা পাঠিয়ে থাকে। কিন্তু সে দুঃখ কাউকে বুঝতে দেয় না। পরিবার-পরিজনের সাথে কথা বললো নিজেদের টানা পোড়নের কথা শেয়ার করেন না। কিন্তু এই করোনা লুকায়িত হাসিমুখে কথা বলা, কষ্টে দিনানিপাত করে দেশে টাকা পাঠানোর গল্প যেনো বাস্তবে উপলব্ধি করবার সুযোগ হয়েছে।

এটি আনন্দের খবর হলেও বেদনার খবর হলো, তাঁদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ দক্ষ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গবেষণা বিভাগের সাম্প্রতিক একটি প্রতিবেদন পড়ে তাই জেনেছি। আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করলে দেখা যায়- প্রবাসী শ্রমিকদের ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রবণতাও বেশি। রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক অগ্রণী ও বেসরকারি প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক প্রবাসী শ্রমিকদের বিদেশে যেতে ঋণ দিয়ে থাকে। ব্যাংকঋণের ক্ষেত্রে কিছু কড়াকড়ি থাকায় এবং অন্যান্য ব্যাংক ঋণ না দেওয়ায় প্রবাসী শ্রমিকদের একটি বড় অংশ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) এবং স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ ঋণ নিয়ে বিদেশে যেতে বাধ্য হন।

করোনা ভাইরাসের এই ক্রান্তিকালে সবচেয়ে বেশি কষ্টে দিন পার করছেন এই রেমিটেন্স যুদ্ধা প্রবাসীরা। দিন রাত পরিশ্রম করে রেমিটেন্স পাঠিয়ে দেশীয় অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখা প্রবাসীরা একদিনে প্রবাসে ব্যক্তিগত খরচ, অন্যদিকে কারও কারও ঋণের অর্থ পরিশোধ চিন্তা আর পরিবারে কিভাবে টাকা পাঠানো যায় সেই চিন্তা। খুবই দূর্বিষহ ও কঠিন বাস্তবতার সম্মুখীন এই প্রবাসীরা। আজ বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারী এই ভাইরাস থেকে সাধারণ মানুষকে নিরাপদে রাখতে বন্ধ রাখা হয়েছে দেশ-বিদেশের ছোট-বড় সকল শিল্প কারখানা। এদিকে চলমান পরিস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়েছে প্রবাসী শ্রমিকদের। তাদের জীবিকার ওপর নির্ভর করে তাদের পরিবারের সকল খরচ। ঘরবন্দী সারাবিশ্ব, প্রবাসীরাও এর বাইরে নয়। প্রবাসীদের এই ক্রান্তিকালে বিদেশে প্রবাসীদের সহায়তা করতে গত ৫ এপ্রিল দূতাবাসগুলোকে সাড়ে চার কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়। এছাড়াও প্রবাসীদের সামগ্রিক সুরক্ষার জন্য সব ধরনের সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে নির্দেশ প্রদান করা হয়।

প্রবাসীদের আবাসনের সমস্যা হলে সংশ্লিষ্ঠ মিশনগুলোকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিদেশফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য অর্থ ঋণ সহায়তা দেওয়ার সিদ্ধান্ত, অর্থ-ঋণ সহায়তা, প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষতার মান উন্নয়ন করে পুনরায় বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, বিদেশফেরত কর্মীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকার ও উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছে আর্থিক সহযোগিতার জন্য অনুরোধ করা, ইতোমধ্যে যারা ছুটিতে দেশে এসেছেন এবং যাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে, তারা যাতে পুনরায় যেতে পারে সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সাথে আলোচনা ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়ার কথা ওই সভায় উত্থাপিত হই। আমরাও চাই সবকিছু ঠিকঠাক মতো থেকে প্রবাসীরা যেনো নিরাপদে থাকে।

প্রবাসীদের নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি আমাদের সকলের উচিত- যে যেভাবে পারি, প্রবাসীদের পরিবারের পাশে দাঁড়াতে হবে। প্রবাসীদেরও নিয়মিত খোঁজ খবর রাখতে হবে। সরকারকেও আরও আন্তরিক হয়ে প্রবাসীদের পরিবারকে সাধ্যমতো সহযোগিতা করতে হবে। প্রবাসী ও তাদের পরিবারকে কোনোভাবে হেলা করলে চলবে না। এরাই দেশের সম্পদ। প্রবাসীদের বাঁচিয়ে রাখতে হবে আমাদের। প্রয়োজনবোধে এই করোনা ক্রান্তিকালে প্রবাসী পরিবারকে বিশেষ প্রণোদনা সহ সহজ শর্তে ঋণের সুযোগ দিতে হবে। পেটের দায়ে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে যেসকল প্রবাসী বিদেশের মাটিতে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন তাদের পরিবারকে স্রষ্টা যেনো শোক সয়বার শক্তি দেয় প্রার্থনা। আসুন সকলে মিলে সচেতন হই, নিরাপদে থেকে এই ক্রান্তিকালে প্রবাসীদের পাশে দাঁড়ায়। অনেক প্রবাসীর পরিবারে ঋণের বুঝা, সকলের সহযোগিতা তাদের ঠিক এই সময়ে দরকার। মনে রাখতে হবে- প্রবাসী বাঁচলেই বাঁচবে দেশ, নিরাপদ থাকুক সকল প্রবাসীর পরিবেশ-প্রতিবেশ।

লেখক- মো. ওমর ফারুক জয়
গণমাধ্যমকর্মী ও প্রতিষ্ঠাতা উই ক্যান।