আব্দুল্লাহ আল নোমান


 

ইতোমধ্যে পৃথিবীর প্রায় সকল অঞ্চলে তার সুগভীর প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে প্রায় ৩ লক্ষ  মানুষের জীবনাবসান ঘটিয়েছে করোনা ভাইরাস। নানা প্রান্তে ঠিক কত সংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যয়ের সম্মুখীন , সঠিক সংবাদ আমাদের কাছে নেই। এই করোনা যদি শুধু মানুষের জীবন কেড়ে নিয়েই ক্ষান্ত হত, তাহলে হয়ত এতটা পেরেশানিতে পড়তাম না। ঘাতক ভাইরাসটি মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মানবিক বিপর্যয় ঘটিয়েছে; অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চুরমার করে দিয়েছে। কোনো কোনো গবেষক আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যে পরিমাণ মানুষ মৃত্যুবরণ করবে, করোনা শেষ হলে তার চেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষ খাদ্যের অভাবে মারা পড়বে।

সুতরাং করোনা যে আমাদের সবদিক দিয়েই একটা বিপর্যয়ের সম্মুখীন করেছে তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে আমি সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত, বুদ্ধিবৃত্তিক ক্ষেত্রে আমাদের পিছিয়ে পড়া দেখে। আমরা দেখেছি, পুরো পৃথিবীতেই এখন শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ হয়ে রয়েছে। এখন আমাদের সবদিক দিয়েই বিশ্বের একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে নিজেদের বিবেচনা করতে হচ্ছে। আমরা শুধু নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। করোনা সকল সীমানা নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সবাইকে একই কাতারে শামিল করে ছেড়েছে। শিক্ষা নিয়ে ভাবতে গেলে রীতিমত শঙ্কিত হই। এমনিতেই জাতি হিসেবে আমরা বড্ড আরামপ্রিয়। সামান্য একটু সুযোগ পেলেই নিজেদের গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিয়ে নিশ্চিন্তে বসে থাকি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বছরের দীর্ঘ সময় ধরে বন্ধ থাকে। ছুটির তালিকাও বিশ্বের অপরাপর দেশের চেয়ে দীর্ঘ বলেই মনে হয়। ফলে শিক্ষার ক্ষেত্রে সামনের দিকে অতি সামান্যই এগিয়ে চলছি।

একজন শিক্ষার্থীকে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে তার প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রভাব বিস্তার করার সঙ্গে সঙ্গে এ সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা এবং শিক্ষার জন্য সুন্দর পরিবেশ থেকে পুরোপুরি বঞ্চিত। সবচেয়ে বড় কথা, সময়টা তারা মোটেও নিজেদের মানস গঠনের কাজে ব্যয় করছে না। তারা গেমস খেলা এবং অহেতুক কাজকর্ম করে সময় নষ্ট করে চলছে । ধারণা ছিল, তারা হয়ত সঠিক পথে ফিরে আসবে। কিন্তু সেটা হয়নি। ছেলেগুলোর গেমস খেলা যেন দিন দিন আরো বেড়েই চলছে! সময়ের ব্যাপারে একেবারে বেখেয়াল হয়ে পড়া এসব কিশোরের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশঙ্কায় আছি।

আসলে আমরা তাদের পুরোপুরি দোষ দিতেও পারছি না। একটি সমাজে শিশুদের সুন্দরভাবে বেড়ে ওঠার জন্য যেমন পরিবেশ সৃষ্টি করা প্রয়োজন, সেটা আমরা মোটেও করতে পারিনি। আগে প্রায় প্রতিটি গ্রামে ক্লাবঘর থাকত। সেখানে ক্লাবের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি পাঠাগারও থাকত। অবসর সময়ে সবাই সেখানে গিয়ে কেউ খেলাধুলা করত, কেউ নিজের পছন্দানুযায়ী বই পড়ত। আমরা দেখেছি, দেশের প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের একটা বড় অংশ গাঁয়ের এসব পাঠাগার থেকে পড়াশোনা করে মনের চাহিদা মিটিয়েছেন। একটা সময় সমাজে পারিবারিক পাঠাগার গঠন করারও একটা ঝোঁক দেখা যেত। শিশুরা বাড়িতে থেকেই বই পড়ার মাধ্যমে নিত্যনতুন জ্ঞান আহরণ করতে পারত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সুস্থ সংস্কৃতি এবং বিনোদনের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে নিঃশেষ হয়ে গেছে। প্রযুক্তিভিত্তিক জ্ঞান এবং বিনোদন আমাদের লাভের চেয়ে বরং ক্ষতিই বেশি করছে। শিশুরাও না বুঝে এসবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে যাচ্ছে।

মোবাইল ফোনে এসএমএস প্রদানের মাধ্যমে এসএসসির ফলাফল দেওয়াকে বর্তমান সময়ের জন্য অত্যন্ত উপযোগী সিদ্ধান্ত বলে মনে করি। কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে, কয়েক লাখ শিক্ষার্থী তাদের এইচএসসি পরীক্ষা নিয়ে ঘোর অনিশ্চয়তায় দিন অতিবাহিত করছে। কবে তাদের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবে কিংবা আদৌ এই বছর পরীক্ষা নেওয়া হবে কিনা সেসব নিয়ে উৎকণ্ঠায় রয়েছে। উৎকণ্ঠা এবং অনিশ্চয়তার ফলে তাদের পড়াশোনা যে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমরা মনে প্রাণে চাই, দ্রুতই করোনা পৃথিবী ছেড়ে চলে যাক।

আমরা পূর্বের মত সুন্দর ও সুখী জীবন যাপন করতে সক্ষম হই। সাধারণত বছরের শেষ মাসগুলোয় দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি পরীক্ষা হয়ে থাকে। এই পরীক্ষার মাধ্যমে দেশের সেরা মেধাবী মানুষগুলোকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ করে দেওয়া হয়। যেহেতু এইচএসসি রেজাল্ট প্রদান করার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়, সেহেতু এবারের ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়া নিয়েও ঘোর অনিশ্চয়তা সৃষ্টি হয়েছে। কবে এবং কীভাবে এইচএসসি পরীক্ষা হবে তারই যখন ঠিক-ঠিকানা নেই।।

তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা হবে কীভাবে? আবার যদি করোনার কারণে ভর্তি পরীক্ষা না হয় তাহলে কোন পদ্ধতিতে নতুন শিক্ষাবর্ষে শিক্ষার্থী নেওয়া হবে সে বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব হয়নি। মোটকথা হলো, পুরো উচ্চশিক্ষা একটা ঘন অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার দিকে এগোচ্ছে। এখন ভাগ্যের ওপর নির্ভর করা ছাড়া উপায় নেই।

আমরা যারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছি তারাও খুব একটা স্বস্তিতে নেই। সাধারণত বাংলাদেশে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে গ্রামের মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানরা। এদের একটা বিরাট অংশ টিউশনি এবং পার্ট-টাইম কাজের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে নিজের পড়াশোনার খরচ চালানোর পাশাপাশি কেউ কেউ পরিবারের খরচও মিটিয়ে থাকে। অনেক বন্ধু ও ছোট ভাই-বোনদের সংবাদ জানি যারা তাদের নিজের এবং পরিবারের বোঝা কাঁধের ওপর বহন করে চলেছে।

এই সোনার সন্তানরা কোনো কারণে ভেঙে পড়লে বা ক্ষতিগ্রস্ত হলে জাতি হতাশার সমুদ্রে হাবুডুবু খাবে। করোনা ভাইরাসের কারণে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ছুটি হওয়া এবং হল ও মেসগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে প্রায় সকলকেই বাড়িতে ফিরতে হয়েছে। ফলে তাদের উপার্জন পুরোপুরি বন্ধ হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় নিজেরা যেমন অসহায় হয়ে পড়েছে তেমনি যাদের পরিবারে বিকল্প কোনো আয়ের উৎস নেই তারাও সংসার চালাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে।

একমাত্র জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া দেশের আর কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শতভাগ আবাসন ব্যবস্থা নেই। ফলে হাজার হাজার শিক্ষার্থী মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আমি নিজেও চট্টগ্রাম শহরের একটা মেসে থেকে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছি। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কলেজগুলোতেও কয়েক লাখ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। এদের বেশিরভাগই ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে পড়াশোনা করে।

এমন অবস্থায় মড়ার ওপর খাড়ার ঘা-র মত শিক্ষার্থীরা একটি নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। বেশিরভাগ মেস মালিকই ভাড়া প্রদান করার জন্য তাগাদা দিয়ে যাচ্ছে। একটা বিষয় খেয়াল করে দেখুন, যে সমস্ত শিক্ষার্থী নিজে টাকা উপার্জন করে পড়াশোনা করে এবং পরিবারের খরচ চালায় এই সময়ে তারা কীভাবে মেসের ভাড়া পরিশোধ করতে সক্ষম হবে? এমন মহামারির সময়ে মালিক পক্ষের কাছ থেকেও শিক্ষার্থী একটু সহমর্মিতা আশা করতে পারে।
সব মিলিয়ে বর্তমান বিশ্ব একটি ভয়াবহ এবং নাজুক অবস্থার মধ্য দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। প্রতিনিয়ত মৃত্যু এবং মানুষের আর্তনাদ আমাদের মনকে ভারাক্রান্ত করে তুলছে।

এমন পরিস্থিতিতে সরকার শিক্ষা কার্যক্রমকে চালু রাখার জন্য অনলাইনে ক্লাস নেওয়ার কথা বলেছে। পাশাপাশি টেলিভিশনের মাধ্যমেও ক্লাস নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবক্ষেত্রে এসব উদ্যোগ খুব একটা ফলপ্রসূ হবে বলে মনে হয় না। সেক্ষেত্রে আমাদের আরও বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণ করার কথা চিন্তা করতে হবে। দিনদিন করোনাভাইরাস বাংলাদেশে শক্তভাবে শেকড় গেড়ে বসছে।
নিজেদের অসচেতনতার দরুন সংকট আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে একটা বিষয় মাথায় রাখা দরকার, কখনো ভেঙে পড়লে চলবে না। নিজেদের প্রয়োজনেই শক্ত হতে হবে। সেই সঙ্গে নিজ-সমাজ-রাষ্ট্রের মঙ্গলের জন্য যা যা করা দরকার তার সবই করতে হবে।


লেখক:  সাংগঠনিক সম্পাদক,বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা।।
ই-মেইল: aanoman29@gmail.com মোবাইল নং:- 01815161931.