আন্তর্জাতিক ডেস্ক:
স্কটিশ লেখক ও চিকিৎসক স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের ঊনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের প্রথম ভাগের কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের পদাঙ্ক অনুসরণ করে করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সফল হয়েছে চীন। রোববার করোনার এই লড়াইয়ে চীনের সফলতার গল্প তুলে ধরেছে হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট।

চীনে যখন এই ভাইরাসের বিস্তার প্রচণ্ড রকমে ছড়িয়ে পড়ে, তখন দেশটির মহামারি বিশেষজ্ঞ গং জিয়াওহুনান আধুনিক যুগের শার্লক হোমসের মতো অত্যন্ত বিচক্ষণতার সঙ্গে ভাইরাস শিকারি বনে যান। এক মাসের বেশি সময় ধরে ৩২ বছর বয়সী এই ভাইরাস শিকারি সাংহাই শহরের শত শত করোনা রোগীকে শনাক্ত এবং খুঁজে বের করেন।

একজনকে খুঁজে বের করার পর তিনি আর কার কার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে এসেছেন, তারা কাদের সঙ্গে মিশেছেন, তাদের স্বজনরা কাদের সঙ্গে মিশেছেন সেসব শনাক্ত করেন এবং আলাদা করে ফেলেন। চীনের পূর্বাঞ্চলের মেট্রোপলিটন নগরী সাংহাইয়ে করোনার বিস্তার রোধে আধুনিক যুগের শার্লক হোমস গং জিয়াওহুনানের অবদান বেশি।

গং বলেন, কোনো ব্যক্তি করোনা পজিটিভ অথবা সন্দেহভাজন হলেই আমরা তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছি। তাদের কাছে জানতে চেয়েছি- তারা কি করেছে, কোথায় গিয়েছে, গত ১৪ দিন কাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে। এসবের মাধ্যমে একটি সামগ্রিক চিত্র আমরা পেতাম। আমাদের এই কাজটা ছিল একেবারে পুলিশি তদন্তের মতো। আমরা অত্যন্ত ধৈর্য এবং যত্নের সঙ্গে এসব কাজ করেছি।

করোনা মহামারির আগে গং সাংহাই সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশনের মহামারি জরিপকারী কর্মকর্তার দায়িত্বে ছিলেন। অভ্যন্তরীণ সংক্রমণ শনাক্ত এবং নজরদারির কাজ করতেন তিনি। জানুয়ারিতে প্রথম একজন করোনা আক্রান্ত ৫০ বছর বয়সী নারীর তদন্তের দায়িত্ব পান তিনি। এই নারী হুবেই প্রদেশের উহান থেকে সাংহাইয়ে এসেছিলেন। উহানেই গত বছরের ডিসেম্বর করোনার প্রথম রোগী শনাক্ত হন।

শরীর খারাপ হওয়ার পর ওই নারীকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এই নারী তখনও করোনা পজিটিভ হননি। সন্দেহভাজন করোনা রোগী হিসাবে ধরে নিয়ে গং হাসপাতালের শয্যায় তাকে বিভিন্ন বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। পরে জানা যায়, এই নারী করোনাভাইরাস সংক্রমিত।

গং বলেন, ওই সময় আমরা নভেল করোনাভাইরাস সম্পর্কে খুব সামান্য জানতাম। তবে গত ৩১ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো সিডিসির সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সম্ভাব্য একটি মহামারির ব্যাপারে প্রস্তুতি নিতে বলা হয়। যে কারণে আমাদের জানা দরকার ছিল, ওই নারী কিভাবে সাংহাইয়ে এলেন, কাদের সংস্পর্শে এসেছেন।

চীনা এই বিশেষজ্ঞ বলেন, মহামারিবিষয়ক জরিপের প্রথম লক্ষ্যই হলো সন্দেহভাজন রোগী শনাক্ত করা। এই রোগীদের শনাক্ত করতে পারলেই সংক্রমণ রোধ করা সম্ভব। এছাড়া যারা ইতোমধ্যে সংক্রমিত হয়েছেন, তাদের শনাক্ত করতে হবে, আইসোলেট করে চিকিৎসা দিতে হবে; যাতে বিস্তার ঠেকানো যায়।

সাংহাই সিডিসির পরিসংখ্যান বলছে, সাংহাইয়ের ৩৩০ জন রোগীর এক তৃতীয়াংশই অন্য রোগীদের ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসার পরই করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। এই আক্রান্তদের মধ্যে করোনা পজিটিভ ৮০ জনের ব্যাপারে নিখুঁত তদন্ত করেছেন গং। তাদের প্রত্যেকজনের তদন্তে গং ব্যয় করেছেন দুই থেকে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। এছাড়া কিছু কিছু তদন্তে সময় লেগেছে তারও বেশি।

তিনি বলেন, এই কাজে অধিকাংশ রোগীই সহযোগিতা করেছেন। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার কারণে অল্পসংখ্যক রোগী তথ্য দিয়ে সহায়তা করতে দ্বিধা করেছিলেন। কিন্তু আমি তাদের বলেছিলাম, এই কাজে সহযোগিতা করতে তারা বাধ্য। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।

গং বলেন, অন্যান্য ভালো অনুসন্ধানের মতো তিনি রোগীদের মুখোমুখি হয়ে নিখুঁত তথ্য নিয়েছেন। অনেক সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেছেন। পরে এসব তথ্যের সত্যতাও যাচাই করে নিশ্চিত হয়েছেন।

তবে এক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জিং কিছু বিষয়ও রয়েছে বলে জানান গং। তিনি বলেন, অনেকেই গত ১৪ দিন ধরে কোথায় গিয়েছেন, কাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন, সেগুলো সঠিকভাবে মনে করতে পারেন না। দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে সাংহাই সিডিসিতে কর্মরত অভিজ্ঞ এই কর্মকর্তা ধৈর্যের সঙ্গে রোগী অথবা সন্দেহভাজনদের পর্যাপ্ত সময় দিয়ে ধীরে ধীরে সব জেনে নিতেন।

সিডিসির এই কর্মকর্তা বলেন, একেবারে যারা বয়স্ক অথবা যারা গুরুতর অসুস্থ আমি তাদের সন্তান, স্বামী অথবা স্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তবে সব সময় যে সঠিক তথ্য পেতেন বিষয়টি তেমন নয়। গং বলেন, এজন্য তিনি এবং তার সহকর্মীরা একজনের তথ্য জানতে কয়েকদিন পর্যন্ত ব্যয় করেছেন।

ফেব্রুয়ারির শুরুর দিকে সাংহাইয়ে দুজন রোগী পাওয়া যায়। যারা উহানে যাননি। তারপরও তারা করোনায় সংক্রমিত। এই দুই রোগীর তদন্তের ভার আসেন গংয়ের ওপর। তিনি তদন্তে নেমে জানতে পারেন, এই দুই ব্যক্তি অপর একজনের সঙ্গে একদিন খাবার খেয়েছিলেন। আর ওই ব্যক্তি এসেছিলেন চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আনহুই প্রদেশ থেকে; যিনি পরবর্তীতে করোনা সংক্রমিত হন।

এমন আরেকটি ঘটনা ঘটে ৭০ বছর বয়সী এক নারীর সঙ্গে; যিনি করোনা আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি একা বসবাস করতেন। কখনও সাংহাইয়ের বাইরে যাননি। টানা ১০ দিনের তদন্ত শেষে গং জানতে পারেন, এই নারী সম্প্রতি সরকারি একটি অফিসে গিয়েছিলেন। সেখানেই করোনা সংক্রমিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে আক্রান্ত হয়েছেন তিনি।

ভাইরাস শিকারি গংয়ের এটা ছিল আরেক সাফল্য। বিখ্যাত কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র শার্লক হোমসের নিখুঁত অভিযানের পথ অবলম্বন করে সাংহাইয়ের বেকার স্ট্রিটের শার্লক হোমস হয়ে ওঠেন দেশটির মহামারি বিশেষজ্ঞ গং জিয়াওহুনান।

৩২ বছর বয়সী এই নারী বলেন, এই চাকরিতে ধৈর্য দরকার। কারণ প্রত্যেকটি তথ্যের নিখুঁত পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হয়। সাংহাইয়ের ফুদান বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব পাবলিক হেলথের অধ্যাপক হু শ্যানলিয়ান বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ রোধ করার জন্য মহামারি জরিপ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটাতে অত্যন্ত শ্রম এবং সময় দিতে হয়। কিন্তু ভাইরাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এসবই প্রথম শর্ত।

রোগীদের পরিবারের সদস্যদের ভালো সংবাদ পাওয়াটাই এই কাজের প্রধান আত্মতৃপ্তি বলে মন্তব্য করেন গং। তিনি বলেন, তাদের অনেকেই আমাকে বলতেন যে, আমাদের এমন কাজে তারা স্বস্তি বোধ করছেন। তাদের এই কথাটুকুই আমাকে আমার মিশনের গতি বাড়িয়ে দিতো। এই কাজে আমি গর্ববোধ করতাম।