রফিক মাহমুদ

১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল। ভয়াল একটি রাত। প্রকৃতি ধব্বংস লিলা, লাশের পর লাশ! স্বজন হারানো বেদনা। চারে দিকে অন্দকার। মায়ের সামনে প্রিয় সন্তান ও স্বামীকে চোঁখের সামনে ভেসে যেতে দেখা। যেন এক তিক্ত অভিজ্ঞতার গল্প ছাড়া আর কিছু নেই। শুধু আছে সমবেদনা। যা ছিল এক দুঃস্বপ্ন।

১৯৯১ সালের এদিন ‘ম্যারি এন’ নামক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় লণ্ডভণ্ড করে দেয় দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার পূরো উপকূল। লাশের পরে লাশ ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল চারদিকে। বিস্তীর্ণ অঞ্চল ধ্বংস্তূপে পরিণত হয়েছিল। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে সেদিন প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির করুণ এই আঘাতকে।

প্রাকৃতিক দূর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি এদেশের মানুষ এর আগে আর কখনো হয়নি। পরদিন বিশ্ববাসী অবাক হয়ে গিয়েছিল সেই ধ্বংসলিলা দেখে। কেঁপে উঠেছিল বিশ্ব বিবেক। বাংলাদেশে আঘাত হানা ১৯৯১ সালের ঘূর্ণিঝড় নিহতের সংখ্যা বিচারে পৃথিবীর ভয়াবহতম ঘূর্ণিঝড় গুলোর মধ্যে অন্যতম।

১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল রাতে বাংলাদেশে-র দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত চট্টগ্রাম উপকূলে আঘাত হানা এ ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়টিতে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় প্রায় ২৫০ কিমি(১৫৫ মাইল/ঘন্টা)। ঘূর্ণিঝড় এবং তার প্রভাবে সৃষ্ট ৬মিটার(২০ ফুট) উঁচু জলোচ্ছ্বাসে আনুমানিক ১৩৮,০০০জন মানুষ প্রাণ হারায় এবং প্রায় এক কোটি মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েছি।

ঘূর্ণিঝড়ের কারণ ও সমসাময়িক বিষয়ের উপর জ্ঞান চর্চা করতে গেয়ে যা দেখার বা জানার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার আলোকে পাঠক উপযোগী করার চেষ্টা করেছি মাত্র। কারণ উক্ত বিষয়ের উপর আমার জ্ঞান ও দক্ষতা এখনও শুণ্যতায়।

ঘূর্ণিঝড় বা ঘুর্ণিতব্য হল ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রে সৃষ্ট বৃষ্টি, বজ্রপাত ও প্রচন্ড ঘূর্ণিময় বাতাস সম্বলিত আবহাওয়া জনিত একটি নিম্ন-চাপ প্রক্রিয়া (low pressure system) যা নিরক্ষীয় অঞ্চলে উৎপন্ন তাপকে মেরু অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত করে।

সাম্প্রতিক সময়ে বিজ্ঞানীরা অনেকে শক্তিশালী ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বৃদ্ধির জন্য গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা বৈশ্বিক উষ্ণায়নকে দায়ী করছেন। যা জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য অন্যতম কারণ। ক্রান্তীয় অঞ্চলের সমুদ্রের তাপমাত্রা ১৯৭০ সালের পর প্রায় এক ডিগ্রী ফারেনহাইটের উপরে বৃদ্ধি পেয়েছে।

বিজ্ঞানীদের ধারণা, এই এক ডিগ্রী বা তারও উপরে ফারেনহাইট তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে এখন আগের চেয়ে শক্তিশালী এবং বেশী সংখ্যায় ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হচ্ছে।

এই ধরনের ঝড়ে বাতাস প্রবল বেগে ঘুরতে ঘুরতে ছুটে চলে বলে এর নামকরণ হয়েছে ঘুর্ণিঝড়। ঘুর্ণিঝড়ের ঘুর্নন উত্তর গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে এবং দক্ষিণ গোলার্ধে ঘড়ির কাঁটার দিকে। ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানলে যদিও দুর্যোগের সৃষ্টি হয়।

কিন্তু এটি আবহাওয়ার একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া, যা পৃথিবীতে তাপমাত্রার ভারসাম্যতা রক্ষা করে। গড়ে পৃথিবীতে প্রতি বছর প্রায় ৮০ টিরও বেশি ঘূর্ণিঝড় সৃষ্টি হয়। এর অধিকাংশই সমুদ্রে মিলিয়ে যায়। কিন্তু যে অল্প সংখ্যক ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানে ভয়াবহ ক্ষতি সাধন করে তার মধ্য অন্যতম একটি হলো ১৯৯১ সালের ঘুর্ণিঝড় ‘ম্যারি এন,।

বাংলাদেশ তথা উত্তর ভারত মহাসাগর এলাকায় ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করা হয় না। তার পরিবর্তে, আরব সাগর এলাকায় উৎপন্ন ঝড়গুলোকে A এবং বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন ঝড়গুলোকে B অক্ষর দিয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।

১৯৯১ সালের ২৯ শে এপ্রিল যে ঘূর্ণিঝড় বাংলাদেশে আঘাত হেনেছিল তার পরিচয় TC-02B হিসেবে। তার মানে এটি ছিল ১৯৯১ সালে বঙ্গোপসাগরে উৎপন্ন দ্বিতীয় ঘূর্ণিঝড়। ১৯৯১ সালের ২৯শে এপ্রিল ভয়ংকর এই ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লক্ষ চল্লিশ হাজার লোক প্রাণ হারিয়েছিল এবং চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

‘ম্যারি এন’ নামে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছিল বাংলাদেশের নোয়াখালী, চট্টগ্রামসহ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় এলাকায় আর এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে গিয়েছিল পূরো উপকূল।

স্মরণকালের ভয়াবহ এ প্রলয়ঙ্কারী ঘূর্ণিঝড়ের বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ২৫০ কিলোমিটার। যা ২০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে মুহুর্তের মধ্যেই তলিয়ে যায় বিস্তীর্ণ এলাকা। সেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে সরকারি হিসাব মতে মৃতের সংখ্যা ১ লাখ ৩৮ হাজার ২৪২ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে এর সংখ্যা আরো বেশি বলে ধারনা করেছেন অনেকে।

এইছাড়াও মারা যায় ২০ লাখেরও বেশি গবাদিপশু। গৃহহারা হয় হাজার হাজার পরিবার। ক্ষতি হয়েছিল ৫ হাজার কোটি টাকারও বেশি সম্পদ।

উপকূলবাসী আজও ভুলতে পারেনি সেই রাতের দুঃসহ স্মৃতি। যা শতাব্দীর প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং দেশের উপকূলীয় অঞ্চল মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়। ধ্বংস স্তূপে পরিণত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার সম্পদ।

প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের কারণে ধ্বংসযজ্ঞের ২৯ বছর পার হতে চলেছে। এখনো স্বজন হারাদের আর্তনাদ থামেনি উপকূল জুড়েই। ঘর-বাড়ি হারা অনেক মানুষ এখনো মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিতে পারেনি। ঘর-বাড়ী ও বসত-ভিটা হারানো মানুষ গুলোকে এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় অনেকেই।

এই ঘুর্ণিঝড়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে মারা গিয়েছিল প্রায় ১২ হাজারের বেশি মানুষ। বতর্মানে এই এলাকায় কিছুটা সংস্কার হলেও অরক্ষিত রয়েছে বাঁশখালীসহ উপকূল এলাকা জুড়েই। নেই কোন উপকূল সুরক্ষাবাধ।

বাঁশখালী উপজেলার বড়ঘোনা, সরল, ছনুয়া, বাহারছড়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা, ইলিশা, প্রেমাশিয়া এলাকার মানুষ এখনো প্রতি বছর ২৯ এপ্রিল এলে স্মৃতি চিহ্ন বুকে জড়িয়ে নির্ঘুম রাত কাটান। যা স্বজন হারানো বেদনা বলা ছাড়া আর কিছু নেই তাদের। তবে অনেকেই রাত শেষে নতুন সূর্য উদয়ের অপেক্ষায় থাকে। এরই মধ্যে নিজেরাই সাজিয়ে নিয়েছে উপকূলে বেঁচে থাকাটা এক ধরনের সংগ্রাম। যা প্রকৃতির লড়াই করে বাঁচার সংগ্রাম বলা যেতে পারে।

১৯৯১ সালে ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ায় প্রাণহানি হয়েছিলো প্রায় ৮ হাজার লোকের। তাছাড়াও কক্সবাজার জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার সদর, চকরিয়া,পেকুয়া,উখিয়া ও টেকনাফসহ উপকূল এলার স্বজন হারানো মানুষ গুলো এখনো ভয়াল ২৯ এপ্রিলকে স্বরণ করে দু:খসহ বেদনার মধ্যে দিয়ে। যা স্বজন হারানোর বেদনা, শুকিয়ে যাওয়া ক্ষত চিহ্ন আর ২৯ এপ্রিল যেন কখনও দেখতে না হয় সে স্বপ্ন নিয়েই ঘুরে দাঁড়ানোর সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে বেঁচে থাকা উপকূলের মানুষ গুলো।

লেখক: সাংবাদিক, উন্নয়ন ও মানবিক কর্মী
rafiqcoxs@gmail.com