অধ্যাপক আকতার চৌধুরী

( করোনা ডায়েরী-৯ম পর্ব )

বিশ্বে করোনায় আজ পর্যন্ত প্রায় ২ লক্ষ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্ত প্রায় ৩০ লক্ষ । বাংলাদেশে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত মৃত্যু ১৫২জন । আক্রান্ত ৫৯১৩ জন। আর কক্সবাজারে ২৭ এপ্রিল একদিনে ৫ করোনা রোগী সনাক্ত করা হয়েছে। ২ এপ্রিল থেকে মোট ২৬ দিনে কক্সবাজার মেডিকেল কলেজের ল্যাবে মোট ৯৪৪ জনের স্যাম্পল টেস্ট করা হয়েছে। তারমধ্যে ২১ জন করোনা ভাইরাস রোগী সনাক্ত হয়েছে। বাকী ৯২৩ জনের রিপোর্ট ‘নেগেটিভ’ ।  সুতরাং বোঝা যাচ্ছে করোনা আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার উর্ধমুখী ।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা যেখানে বলছে করোনা যত বেশী টেষ্ট করা যাবে ততবেশী বাঁচা যাবে। কিন্তু এরই মধ্যে শুরু হয়েছে গণস্বাস্থ্যের আবিস্কার করোনা র‌্যাপিড টেষ্ট কিট নিয়ে গণস্বাস্থ্য ও ঔষধ প্রশাসনের একে অপরকে দোষারোপের খেল। যেন বাংলাদেশের জাতীয় খেলা হাডুডুর মার প্যাচ । তবে যাই হোক , বিষয়টা জাতি দুর্ভাগ্য হিসেবে দেখছে। যেখানে বর্তমান পদ্ধতিতে একটা করোনা টেষ্ট এ সরকারের প্রায় ১৫ হাজার টাকার মত খরচ পড়ছে সেখানে ২৫০-৫০০ টাকায় টেষ্ট করা গেলে এ দুর্যোগে নি:সন্দেহে অনেক বেশী ভাল হত। তবে এখনো সময় আছে । বিষয়টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করুক এমনটিই আকাঙ্খা জাতির।

করোনার ঔষধ এখনো বের হয়নি। কখন বের হয় তারও ঠিক ঠিকানা নেই। কেউ বের করতে পারলেও আগে তাদের প্রয়োজন মিটিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বদৌলতে আমরা ছিটে ফোটা পেলেও পেতে পারি। তবে আমরা এখনো সৌভাগ্যবান। অনেকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফর্মুলা মেনে ঘরবন্দী থেকে , সামাজিক দুরত্ব বজায় রেখে , হাত ধুয়ে বেঁচে আছি। আর কিছু ভাগ্য চক্রে। এমতাবস্থায় যিনি এই হাত ধোয়া পদ্ধতি বের করে এতগুলো প্রাণকে বাঁচিয়ে রেখেছেন তাকে নিয়ে চিন্তা করার বা জানারও চেষ্টা খুব একটা নেই। অথচ যিনি পৃথিবীকে স্যানিটাইজার ব্যবহার বা সাবান দিয়ে বার বার হাত  ধোয়ার কথা বলেছিলেন ডাক্তাররা তাঁকে পাগলা গারদে পাঠিয়েছিলেন ।

এমনকি পাগলা গারদের রক্ষীদের পেটানোর ফলে তাঁর হাতে-শরীরে ক্ষত থেকে পচন ধরে। সেখান থেকে তাঁর হাতে গ্যানগ্রিন হয়। রক্তে বিষক্রিয়ার ফলে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৩ আগস্ট, ১৮৬৫ সালে মারা যান এই চিকিৎসক। তিনি হাঙ্গেরিয়ান চিকিৎসক ইগনাজ স্যামেলওয়াইজ । তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতেই হয় , যার যুগান্তকারী আবিস্কার এতদিন মানবজাতিকে সুরক্ষা দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।

আরেক মহামারি ডায়রিয়া নিয়েও একসময় করোনার মত সংকটে পড়েছিল বিশ্ব। বাংলাদেশ যখন ডায়রিয়ার ঔষধ হিসেবে ‘এক চিমটি লবণ, এক মুঠ গুড় ও আধা সের পানি’ এর স্যালাইন পদ্ধতি আবিস্কার করল তখনও পাগলের প্রলাপ বলেছিল আবিস্কারকদের । কিন্তু এই পদ্ধতিই শেষ পর্যন্ত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা মেনে নিয়ে মানবজাতিকে ডায়রিয়া থেকে বাচিয়ে রেখেছে। সবখানে খাওয়ার স্যালাইনের প্যাকেট পাওয়া যায়। ওআরএস নিয়ে গবেষণা, আবিষ্কার সব হয়েছে বাংলাদেশে। মূল গবেষণা করেছেন আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআরবি) বিজ্ঞানীরা। আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, ওআরএস বিশ্বব্যাপী পাঁচ কোটি শিশুর জীবন রক্ষা করেছে। আমরা এটা নিয়ে অবশ্যই গর্ব করতে পারি।

গত শবে বরাতের সময় দেখলাম দেশের একজন সিনিয়র সিটিজেন মুক্তিযোদ্ধা বহু আলোচিত সমালোচিত ব্যক্তিত্ব ফেনীর সাবেক এমপি জয়নাল হাজারীর একটি ভিডিও বেশ ভাইরাল হয় সামাজিক সাইটে। তিনি ফেসবুক লাইভে এসে ডাক্তারদের উদ্দেশ্যে কয়েকটি প্রশ্ন ছুড়ে দেন, এর একটি হচ্ছে – যদি সেনিটাইজার বা ডিটারজেন্ট বা সাবান দিয়ে ধুলে করোনার জীবাণু চলে যায় তাহলে করোনা আক্রান্ত ফুসফুস অপারেশন করে বের করে নিয়ে এসে সাবান পানি বা ডেটল স্যাভলন দিয়ে ধুয়ে আবার সেলাই করে দিলেইত করোনা আক্রান্ত মানুষ  বেচে যায়?
আরেকটি প্রশ্ন ছিল ,- জানালা দরজা খোলা রাখলে কী করোনা ভাইরাস ঘরে ঢুকে যাবে কিনা? এ সবের উত্তর ডাক্তারদের কাছে চেয়েছেন।
তাঁর এমন সহজ সরল কথা মানুষ বেশ উপভোগ করেছে বৈকি ।  ভিডিওটি ভাইরাল হয়েছে । নেটিজেনদের কাছে যথেষ্ট ট্রলের শিকারও হয়েছেন। অনেকের মতে , একজন সাধারণ লোকের ক্ষেত্রে এমন সব অবান্তর প্রশ্ন  মানায় । করোনা ফূসফুসে প্রবেশ করার সাথে সাথে বিভিন্ন শিরা উপশিরা শ্বাসনালী অকেজো করে দেয়। কেটে বের করে এনে ডেটল দিয়ে ধোয়ার সে সুযোগ নিশ্চয় বহুরুপী করোনা দেয় না।

অনেকটা একই সুরে বক্তব্য রেখেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পও। তাঁর  এমন সব আজগুবি বক্তব্য এটাই প্রথম নয় ,বিশ্ব এসব শুনে অভ্যস্ত। ট্রাম্পের মতে, ঘরো‌য়াভাবে ব্যবহৃত জীবাণুনাশক ( স্যাভলন , ডেটল) ইনজেকশনের মাধ্যমে শরীরে ঢুকিয়েও করোনাভাইরাস দূর করা যেতে পারে। এই উপায়গুলো নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখা যেতে পারে। এমন পরামর্শে আঁতকে উঠেছেন বিজ্ঞানীরা। প্রতিক্রিয়ায় বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, ট্রাম্পের পরামর্শ মানলে মানুষের প্রাণহানি ঘটবে।

সংবাদ বেরিয়েছে , ট্রাম্পের এমন বক্তব্যের পর করোনা কোভিড-১৯ থেকে বাঁচতে আমেরিকার শতাধিক মানুষ জীবাণুনাশক স্যাভলন , ডেটল খেতে চেয়েছেন। যার কারণে জীবাণুনাশক উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বিজ্ঞাপন দিয়ে এর মারাত্মক প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে জনগনকে সতর্ক করেছেন। না খেতে নিষেধ করেছেন।

এদিকে ভারতে করোনার প্রকোপ দিন দিন বেড়ে চলেছে। এমন পরিস্থিতিতে সহজ উপায়ে বাড়িতে বসেই করোনা পরীক্ষা পদ্ধতি বলে দিয়েছেন বাবা রামদেব । নাকের ছিদ্রে দু’ফোঁটা সরিষার তেল দিলেই কাজ শেষ। মরবে করোনাভাইরাস। এমন সব অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব চারিদিকে ভর করছে। কারণ একটাই করোনার কোন ঔষধ আবিস্কার না হওয়া । করোনা ভীতি থেকে মানুষ যে যা বলছে বিশ্বাস করছে। তবে নাকে সরিয়ার তেল দিয়ে আরামে ঘুমানোর প্রবাদ আমরা সবাই জানি। তাই আপাতত ঘরবন্দী অবস্থায় সব দুশ্চিন্তা ঝেড়ে ফেলতে নাকে দু’ফোটা তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়তে পারলে মন্দ হতনা !