শাহেদ মিজান, সিবিএন:

প্রথম দিকে বহুদিন কক্সবাজার জেলা করোনামুক্ত থাকলেও সেই দিন আর নেই। এখন ১৩ জন করোনা রোগীর জেলা কক্সবাজার! এর মধ্যে খোদ মহেশখালীরই আটজন আক্রান্ত হয়েছেন এই ভাইরাসে। এতে একজন নারীও রয়েছেন। তবে বরাবরের মতো এরা সবাই বহিঃগমকারী। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ এবং কুমিল্লা থেকে ফিরেছেন তারা। কথিত আছে, জেলার অন্যান্য উপজেলার চেয়ে মহেশখালী মানুষই করোনা ভাইরাস বেশি গুরুত্ব দেয়নি। এমনকি তারা এই মরণঘাতি ভাইরাসকে ‘কেয়ার’ই করেনি। এই অবহেলার কারণেই মহেশখালীতে সর্বোচ্চ সংখ্যক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। স্থানীয় সচেতন লোকজন এই দাবি করেছেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের তথ্য মতে, মহেশখালীতে আটজন করোনা আক্রান্ত হয়েছেন। তার মধ্যে প্রথম ধাপের ১৭ এপ্রিল একদিনেই তিনজনের করোনা পজেটিভ রিপোর্ট আসে। তাদের দুইজন শাপলাপুরের এবং অন্যজন বড়মহেশখালীর বাসিন্দা এক গৃহবধূ। তারা ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ ফেরত ছিলেন।

শুক্রবার (২৪ এপ্রিল) দ্বিতীয় দফায় একদিনেই পাঁচজনের করোনা সনাক্ত হয়েছে। তারা হলেন, হোয়ানকের ইউনিয়নের ডেইল্যাঘোনা এলাকার কালামিয়ার পুত্র হেলাল উদ্দীন। কালারমারছড়া ইউনিয়নের নয়াপাড়ার পান ব্যবসায়ী মোঃ রিয়াদ (৩৫), ইউনুছখালীর মো: আব্দুল্লাহ (৩৫), বড়ুয়াপাড়ার অঞ্জলী বালা (৩৫) ও চাইল্যাতলীর হোসাইন সাব্বির (৩০)। এদের তিন ঢাকা  ফেরত পান ব্যবসায়ী,একজন চট্টগ্রাম ফেরত চাকরিজীবি ও মহিলাটি সাতকানিয়া থেকে পালিয়ে এসেছে বলে জানা গেছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পান ও লবণ রপ্তানি এবং বাইরের কর্মরত চাকরীজীবির সূত্রে জেলার অন্যান্য উপজেলার চেয়ে মহেশখালী বেশি করোনা ঝুঁকিপূর্ণ। কেননা মহেশখালীর একটি বিপুল সংখ্যক মানুষ গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরির সূত্রে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থান করতেন। একই ভাবে পান ও লবণ রপ্তানির জন্য প্রায় হাজারোধিক লোক নারায়ণগঞ্জ, ঢাকা, চট্টগ্রাম, ফেনি, টাঙ্গাইলসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে।

ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ সর্বোচ্চ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এবং এই দুই জেলা থেকেই অধিকাংশ জেলাতেই করোনা ছড়িয়েছে। কক্সবাজার জেলার আক্রান্ত প্রায় সবাই এই দুই জেলা ফেরত। তবে শুরুর দিকে কক্সবাজারে করোনা ছড়ায়নি। তবুও সতর্ক থাকতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিলো। কিন্তু প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞার মুখেও লকডাউন না মেনে নানা অবৈধ পথে মহেশখালীতে ঢুকে পড়েছে বাইরের চাকরিজীবিরা। একই সাথে ব্যবসা দোহাই দিয়ে পান ও লবণ নিয়ে নিয়মিত ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ যাতায়াত ছিলো। পানবাজারগুলো ছিলো স্বাভাবিক সময়ের মতো।

স্থানীয় সচেনতন লোকজন জানান, সরকারি নির্দেশনা মতে মহেশখালীতে প্রশাসন করোনা প্রকোপ ঠেকাতে কম চেষ্টা করেনি। তবে সাধারণ লোকজন প্রশাসনের চেষ্টাকে গুরুত্ব দেয়নি। মূলত করোনা রোগী সনাক্তের আগ পর্যন্ত তারা এই মরণঘাতি ভাইরাসটিকে ‘কেয়ার’ই করেনি। ফলে প্রশাসনকে ‘ফাঁকি’ দিয়ে অবাধ গণজমায়েত হয়েছে উপজেলার সর্বত্র। অন্যদিকে বাইর থেকে যারা এসেছে তারা কেউ কোয়ারাইন্টাইন মানেনি। একইভাবে পান ও লবণ নিয়ে যারা যাতায়াত করেছে তারাও অবাধে সর্বত্র বিচরণ করেছে। করোনা আক্রান্ত সবাই স্বাভাবিকভাবে বাইরে চলাফেরা করেছে। এমনকি নমুনা সংগ্রহ করার পরও তারা সেভাবে ঘুরেছে। ডেইল্যাঘোনার আক্রান্ত হেলাল উদ্দীন রিপোর্ট প্রকাশের দিন (শুক্রবার) সন্ধ্যার সময়ও বাজারে ছিলো জানিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। তাদের সংস্পর্শে আসা বহুজন এখন সংক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছেন।

হোয়ানক হরিয়ারছড়ার বাসিন্দা কমিউনিটি পুলিশের উপজেলা দায়িত্বশীল, রাজনীতিবিদ নূর মোহাম্মদ বলেন, করোনা যে একটা ভয়ংকর ভাইরাস এবং তার সংক্রমণ যে কত সহজ তা মহেশখালীর অধিকাংশ মানুষ সেটা বিশ্বাসই করেনি। অনেককে এমনো বলতে শোনা গেছে ‘করোনার কথা বিশ্বাস করলে ঈমানও থাকবে না’। কতটা অবহেলা চিন্তা করেন। মানুষের এই উদাসনতাই আজ ঘাড়ের উপর এসে পড়েছে ভয়ংকর করোনা ভাইরাস।

মহেশখালীকে করোনা সুরক্ষার জন্য নানা উপদেশ সম্বলিত কথা নিয়মিত ফেসবুকে প্রচার করে জনগণ ও প্রশাসনকে বারবার তাগাদায় রেখেছেন মহেশখালী প্রেসক্লাবের সভাপতি সিনিয়র সাংবাদিক মাহবুব রোকন  ও সাবেক সভাপতি হারুনর রশিদসহ আরো কয়েকজন গণমাধ্যমকর্মী।

মাহবুব রোকন বলেন, অন্যান্য উপজেলার চেয়ে মহেশখালী জনবহুল। পান ও লবণ রপ্তানিতে জড়িত লোকজন এবং বহিঃগমনকারী চাকরিজীবিদের কারণে মহেশখালী ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছিলো। এই নিয়ে প্রতিমুহূর্ত লিখে সবাইকে সতর্ক করেছি। কিন্তু ‘কেউ কথা রাখেনি’। সেই উদাসীনতা এবং ‘ডোন্টকেয়ার’র কারণে আজ মহেশখালী বিপর্যস্ত!

মহেশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ জামিরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেছেন, শুরু থেকেই প্রশাসন করোনা নিয়ে এক বিন্দুও অবহেলা করেনি। জনসাধারণকে ঘরে রাখতে রাতদিন অবিশ্রান্ত কাজ করেছে। কিন্তু প্রশাসনের প্রচেষ্টাকে লোকজন অগ্রাহ্য করেছে।

উপজেলার সচেতন লোকজন বলছেন, ইতোমধ্যে বহু লোক আক্রান্তদের সংস্পর্শে এসেছেন। করোনা ভাইরাস যেহেতু প্রাথমিক ধাপে লক্ষণহীন থাকে তাই এখন বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সামনের কয়েকদিন অতীব আশঙ্কার। তাই আক্রান্তদের সংস্পর্শে আসারা নিজ নিজ উদ্যোগে কোয়ারাইন্টাইনে না থাকলে বিপদ আরো বৃহৎ হবে। একই সাথে সাধারণ মানুষকে শতভাগ সচেতন হয়ে সব সময় বাড়িতেই অবস্থান করতে হবে।