আল্লামা মাহমুদুল হক

পুরো বিশ্বকে আজ কাবু করে ফেলেছে করোনা। করোনার আঘাতে অধিকাংশ দেশ কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও আশংকার দিকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে এখনো মহামারী আকারে ছড়াতে না পারলেও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। মহান আল্লাহ আমাদের হেফাজত করু।

প্রাণঘাতী নভেল করোনা ভাইরাসের ভয়াল থাবায় স্তব্ধ হয়ে পড়েছে গোটা বিশ্ব। ২০১টি দেশে ছড়িয়ে পড়া করোনার সংক্রমণে মৃতের সংখ্যা এখন ৩৯ হাজার ৫৬৩জন। আক্রান্ত হয়েছে ৮ লাখ ৯ হাজার ২৪৮জন। সুস্থ হয়ে উঠেছেন ১ লাখ ৭২ হাজার ৫১৭জন। ৫ লাখ ৯২ হাজার ২৬৭ জন চিকিৎসাধীন এবং ৩০ হাজার ৪৩৫ জনের অবস্থা আশংকাজনক বলে জানা গেছে ।

বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আতংক ও মাহাবিপর্যয়ের নাম নভেল করোনা ভাইরাস। বিশ্ব মানবতা আজ স্তব্ধ, স্থবিরও নিরোপায়। আমেরিকা, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, চীনসহ পরাশক্তিধর দেশগুলো পর্যন্ত করোনাভাইরাসের মোকাবেলায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ইতালী ও কানাডার মত উন্নত দেশও ভাইরাস নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। কারণ ও বিপযর্য়ের প্রতিকার এখনো মানুষের অজানা। করোনা ভাইরাস নামক ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব পৃথিবীময় আতংক সৃষ্টি করে বসল। এই মহাতংক গ্রাস করলো বিশ্বের প্রতিটি জনপদ।

কী সমতল, কী পাহাড়ী বা মরুভূমী, কি বরফের দেশ বা উষ্ণ অঞ্চল কোন ভুখন্ডই বাকী রাখেনি। প্রতিটি পরাশক্তিধর রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধান, রাজা বাদশাহকে সহজেই বন্দি করে ফেলল। তাদের এত শক্তি? এত বাহাদূরী? একটা সূক্ষ্মপ্রাণী যা খালি চোখে দেখা যায় না, অনুভিক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা যায় । ইতিমধ্যে যুক্তরাজ্যের রানী তার সিংহাসন ছেড়ে অন্য জায়গায় আশ্রয় নিয়েছে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী তার দেশের লোকজনকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।

করোনা ভাইরাস বিশ্বব্যাপী এক আতংকের নাম। এ যেন মৃত্যুর মিছিলে এক দুনিয়া। ধরা যায় না, ছোয়া যায় না। ইয়া নফসী বলতে যা বুঝায় তা মানুষ হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছে। কেয়ামতের দশা হয়েছে সে দিন মানুষ আপন ভাই-বোন, সন্তান-সন্ততি, স্বামী-স্ত্রী আত্মীয় স্বজন সবার কাছ থেকে দূরে পালাবে। তখন শুধুমাত্র নিজের চিন্তায়ই মানুষ পেরেশান হবে। এমন যেন হুবুহু সেই অবস্থা উপলব্ধির সময় হয়েছে।

শুধু আক্রান্ত ব্যক্তিই নয় বরং আক্রান্ত হতে পারে এই ভয়ে অনেকে কোয়ারেন্টাইনে চলে গেছে। জিনিসটা কি ? একটা ছোট জীবানু যা আবার খালি চোখে দেখা যায় না। শুধু অস্তিত্ত্বে টের পাওয়া যায় আর তাতেই সেটা দুনিয়ার শক্তিধর মানুষগুলো আতংকে কাঁপছে। এটাতো কেয়ামতের তুলনায় অত্যন্ত নগন্য যা খোদাদ্রোহীদের জন্যে অপেক্ষা করছে।

হঠাৎ থমকে গেল এক রোগে গোটা বিশ্ব। সবচেয়ে উন্নত বিশ্বকেও হিমশিম খেতে হচ্ছে লাশের মিছিল থামাতে। কেউ কাউকে সাহায্য করতে পারছেনা। সেই সামেরীর মত বলছে আমাকে তোমরা ছুঁয়োনা। তারপর ও কি থেমে থাকছে অশ্লীলতা, নির্লজ্জতা, অত্যাচার, নির্যাতন ? এখনও কি হুশ ফিরে আসছে ? এখনও কি বুঝার সময় হয়নি ? যে উচ্চতর কোন শক্তি এগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করছে।

বিপদ আপদ মহামারী কেন ?
আল্লাহ কোরআনে বলে দিয়েছেন, এই বিপদ আমাদের আমলের কারণে, এটা আমাদের কৃতকর্মের ফল যদিও বা তিনি প্রায় গুনাহ ক্ষমা করে দেন অন্যথায় মহাবিপদ এসে আমাদেরকে আচ্ছন্ন করে নিত। আল্লাহ আরো বলেন- জলে, স্থলে, সমুদ্রে মরুভূমীতে, অন্তরীক্ষে যেই বিপর্যয় দেখা যাচ্ছে তা মানুষের গুনাহের কারণে। আল্লাহ তাদেরকে ফিরে আসার জন্য কিঞ্চিত শাস্তি দিয়ে থাকেন, তাদেরকে সামান্যটুকু শাস্তি আস্মাদন করান। রসুল (স.) বলেছেন ‘ আল্লাহ তায়ালা বলেন, মানুষ যদি আল্লাহর ইবাদত করত তাহলে আমি রাতের বেলায় বৃষ্টি দিতাম, দিনে সূর্যকে উদিত করতাম, বজ্রের আওয়াজ তাদেরকে শুনাতাম না।

রসুল (স.) আরো বলেছেন, যদি কোন সম্প্রদায়ের মাঝে অশ্লিলতা ও বেহায়াপনা প্রসার ঘটে তখন তাদের মাঝে এমন মহামারী ও দূর্ভিক্ষ দেখা দিবে যার নমূনা মানুষ অতীতে কোনদিন দেখেনি ও শুনেনি। আজকে আমরা তা অবলোকন করছি ও শুনছি। গুনাহ বলতে যত রকম আছে সব রকম গুনাহে আমরা নিমজ্জিত।

১। আল্লাহর বিধি বিধান থেকে দূরে সরে গেছি ২। অশ্লিলতায় নিমজ্জিত হয়ে গেছি ৩। অবাধ যৌনাচারে নিমজ্জিত হয়ে গেছি ৪। অবাধ সমকামিতায় লিপ্ত ৫। জেনা ব্যাভিচারে লিপ্ত ৬। চুরি-ডাকাতি, লুটতরাজে লিপ্ত ৭। পুরুষে পুরুষে বিবাহ ৮। মহিলায় মহিলায় বিবাহ ৯। নারী পুরুষ এর অবৈধ অবাধ মেলামেশা ১০। ক্লাবে ক্লাবে উন্মুক্ত যৌনাচার ১১। একে অপরের স্ত্রী ভোগ করা ১২। নৈশ ক্লাবে জেনার মহড়া ১৩। যৌন কাজে স্বাধীনতা প্রদানের জন্যে জেনাকারদের মিছিল। ১৪। প্রকাশ্যে অশ্লীলতা, বেহায়পনা, নোংরামী যা দিন দিন সামজিক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে।

যেমন লাক্স চ্যানেল আই,সুন্দরী প্রতিযোগিতা, মিস বাংলাদেশ, মিস ওর্য়াল্ড প্রতিযোগিতা, অশ্লীল বিজ্ঞাপন, নারীর দেহ সর্বস্ব বড় বড় বিল বোর্ড ও পোষ্টার, অশ্লীল ভিডিও, সিনেমা, গান, উলংগ নর্তকীদের গান নাচের প্রকাশ্য আসর, অশ্লীলতা সম্পন্ন নাটকের প্রসার এরকম বহু কিছু। এর কারণে আল্লাহর তরফ হতে শাস্তি স্বরুপ বহু নিত্য নতুন দূরারোগ্য নাম না জানা অসুখ মহামারী সহ নানা বিপদ বিপর্যয় যে আসবে তা কোরআন ও হাদিস দ্বারা সুনিশ্চিত ভাবে প্রমানিত।

আর তারা মনে করে যে এভাবে আল্লাহর জমীনে বিচরণ করার নাম হচ্ছে স্বাধীনতা। প্রকৃতপক্ষে এটা কোন স্বাধীনতা নয় বরং তা হচ্ছে পশুত্ব ও আল্লাহর গাদ্দারী। বরং পশুর স্বাধীনতারও একটি সীমাবদ্ধতা আছে তারা কিন্তু তার বাইরে চলেনা। উপরের কাজগুলো কোন স্বাধীনতার আওতায় পড়ে না, পড়ে পশুত্বের আওতায়। স্বাধীনতা মানে তুমি যা চাও তা করার নাম নয় বরং স্বাধীনতা হল যা যৌক্তিক কাজ তা করা। অবাধ স্বাধীনতা বলতে কোন কিছু নেই, প্রত্যেক জিনিসের একটি সীমা পরীসীমা আছে যার বাইরে যাওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। যার বাইরে যেতে চাইলে বিপদ অত্যাসন্ন।

এই বিশাল বিশ্ব একটি সুনীপুন নীতির উপরে প্রতিষ্ঠিত তা থেকে সামান্য এদিক ওদিক বিচ্যুতির কোন সুযোগ নেই, এই পৃথিবীর চাঁদ, সূরুজ, গ্রহ, নক্ষত্র থেকে আরম্ভ কর আসমান জমিন সবকিছুআপন কক্ষপথে সন্তরণ করছে। এর বাইরে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। আকাশের নক্ষত্ররাজীর কক্ষপথ আছে, উড়োজাহাজের কক্ষপথ আছে সমুদ্রের বুক ছিরে প্রবাহমান ষ্টিমারের কক্ষপথ আছে কিন্তু তাদের কেউ আপন কক্ষপথ থেকে বিচ্যুত হয় না। যদি বিচ্যুৎ হয় তাহলে ভয়াবহ দূর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হবে। এসব কিছুর যদি সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা থাকে তাহলে সৃষ্টির সেরা মানুষের কেন সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা থাকবে না ? অবশ্যই থাকবে। মানুষের মধ্যে যারা এই সীমাবদ্ধ স্বাধীনতার গন্ডী পেরিয়ে যেতে চায় তখনই তাদের উপর বিপর্যয় নেমে আসবে। এই সীমাবদ্ধ গন্ডী যখন লুত সম্প্রদায় অতিক্রম করেছিল তখন আল্লাহ তাদেরকে বিভিন্ন নামে আখ্যায়িত করলেন।

তোমরা কাট মূর্খ সম্প্রদায় বরং তোমরা সীমালঙ্ঘনকারী জাতি/বরং তোমরা অতি বাড়াবাড়ীকারী সম্প্রদায়/ বরং তোমরা নষ্ট ফাসেক জাতি ইত্যাদি বিদ্রুপাত্তক ভাষা ব্যবহার করলেন। আল্লাহর শুকর আল্লাহ আমাদেরকে এমন দ্বীনের অনুসারী হওয়ার তৌফিক দান করলেন যেই দ্বীন হল আমাদের রক্ষাকবচ।
সম্মানীত ভাইয়েরা আল্লাহর শাস্তি দু’ধরণের হয়ে থাকে। ১। শরয়ী শাস্তি যা প্রশাসন বাস্তবায়ন করে ২) খোদায়ী শাস্তি যা সরাসরী আসমান কিংবা জমিন থেকে এসে থাকে। এই করোনা ভাইরাস হল আসমানী শাস্তি। মানুষ যখন নিত্য নতুন পাপ কাজ উদ্ভাবন করে তখন আল্লাহ নিত্য নতুন শাস্তি দিয়ে থাকেন যাতে তারা অবধমিত হয় এবং আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। আল্লাহ ঘোষণা দিয়েছেন আল্লাহ বিন্দুমাত্র কাউকে জুলুম করেন না কিন্তু মানুষই নিজের প্রতি জুলুম করে। মানুষের প্রতিটি কাজের যদি আল্লাহ শাস্তি দিতেন তাহলে তিনি কোন বিচরনশীল জন্তুকে পৃথিবীতে ছেড়ে দিতেন না কিন্তু তিনি সকলকে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবকাশ দিয়ে থাকেন।
অনেকে প্রশ্ন করে এ মহামারী গজব না পরীক্ষা। আল্লাহ মানবজাতির উপর যে বিপদ মুসিবত দিয়ে থাকেন তা দু কারণে করে থাকেন। ১। পরীক্ষা যা প্রকৃতপক্ষে রহমত স্বরুপ। মাঝে মধ্যে আল্লাহ খন্ড প্রলয়ের মাধ্যমে রোগবালা, ক্ষুধা, জান-মালের ক্ষতি দিয়ে মানুষকে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন অবশ্যই আমি ভয়, ক্ষুধা, ধন সম্পদ ও জীবনের ক্ষতির মাধ্যমে এবং ফল-ফলাদি বিনষ্টের মাধ্যমে তোমাদের পরীক্ষা করি (সূরা আল বাকারা – ১৫৫)।
২। গযব সমাজে যখন পাপাচার ব্যাপক আকার ধারণ করে, প্রপীড়িত মানুষ দু’হাত তুলে মুনাজাত করে তখন আল্লাহ তাদের উপর গযব পাঠান। মজলুমের ফরিয়াদ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শুনেন । হাদিসের মধ্যে এসেছে মজলুম যখন আহাজারী করে দোয়া করে তখন তার দোয়া আসমান ভেদ করে উপরে আল্লাহর দরবারে উন্নীত হতে থাকে তা আল্লাহর আরশে যেয়ে ধাক্কা দেয়, আল্লাহ তখন প্রতিউত্তরে বলে থাকেন প্রয়োজনে একটু বিলম্ব হলেও তোমাকে আমি সাহায্য করবই। যার ফলশ্রুতিতে মহামারী আকার ধারণ করে , প্রাকৃতিক দুর্যোগ আকারে পৃথিবীতে নেমে আসে।

কোনটি শাস্তি কোনটি পরীক্ষা তা বুঝার উপায় হল – অতিরিক্ত নাফরমানীর কারণে যদি কেউ আক্রান্ত হয়, দুর্নীতি, পাপকর্ম অন্য যে কোন অপরাধ যেমন ঘুষ খেতে যেয়ে ধরা পড়ল, অতিরিক্ত মদ পান করার কারণে মারা গেল তাহলে বুঝতে হবে এটা গজব আর দ্বীনের জন্যে যদি কেউ গ্রেফতার হয়ে জেল-জুলুম, নির্যাতন নিপীড়ন বা ক্রসফায়ারের শিকার হন তাহলে এই বিপদ-আপদ হল পরীক্ষা। এককথায় ইমানদার মানুষের জীবনে যা ঘটে সবই পরীক্ষা । রসুল (স.) বলেছেন মুমিনের ব্যাপারটি আশ্চর্যজনক তার সাথে যা ঘটে সবই তার জন্যে কল্যাণকর। যখন আনন্দদায়ক কিছু ঘটে তখন সে আল্লাহর শুকরিয়া করে যা তার জন্য ভাল। আর যখন কোন বিপদে আপতিত হয় তখন সে ধৈর্যধারণ করে। অন্য হাদিসে এসেছে ইমানদার ব্যক্তির পায়ে যদি কাটার খোঁচা লাগে তাতেও তার গোনাহ মাফ হয়। রসুল (স.) বলেছেন যে ব্যক্তি রাস্তায় নিহত হয় সে শহীদ, যে ব্যক্তি ধ্বংসস্তুপে চাপা পড়ে মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি মহামারীতে মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি পেটের পীড়ায় মারা যায় সে শহীদ, যে ব্যক্তি ডুবে মারা যায় সে শহীদ।

পরিশেষে বলতে চাই ভাইরাস গজব হোক বা পরীক্ষা হোক আমরা গুনাহে আকণ্ঠ নিমজ্জিত। সুতরাং কোরআন সুন্নাহকে মজবুতভাবে ধারণ করি। আল্লাহ আমাদেরকে দ্বীনের উপর অটল থাকার তৌফিক দান করুন এবং এই মহামারির ছোবল থেকে রক্ষা করুন। আমিন।