মোঃ কামাল হোসেন


আট বছরের শিশু তাসনিম, কথা বলতে পারেনা এখনো, নাম ধরে ডাকলে তাকিয়ে থাকে অন্যদিকে, পরিবারের অন্যদের মত হাসি কান্না উপভোগ করতে পারে না। তার জন্য পরিবারের অন্যদের আনন্দ, সুখ বিলীন প্রায়। এখন সে মায়ের হাত ধরে ‘অরুণোদয়ে’ আসে প্রতিদিন। গত কয়েকমাস ধরে বিশেষ এ স্কুলটিতে আসায় সে কিছুটা অনুভূতি প্রবণ হয়েছে। এখন দু’একটা কথা বলতে পারে, কিছু কিছু বিষয়ে রেসপন্সও করে মাঝে মধ্যে, নাম ধরে ডাকলে কদাচিৎ তাকায়, কিছুটা বেড়েছে আই কন্টাক্ট। এমনি করে চার বছরের আসমা, উজাইফা কিংবা বার তের বছরের সুদীপ্ত দে, সুদীপ্ত পাল আজ নিয়মিত এ বিশেষ শিশুদের স্কুলে আসে। তাদের বাবা-মার আশা তার সন্তান অন্য স্বাভাবিক সন্তানদের মত হাসবে-কাঁদবে, কথা বলবে, আব্দার জানাবে প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে। স্বপ্ন দেখছে পরিবারে নতুন সূর্যোদয়ের। দেশের শতকরা একভাগ অটিস্টিক শিশুর পরিবারের নতুন সূর্যোদয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা, দেবদূত কিংবা অন্য যেকোন বিশেষণে অভিহিত করিনা কেন তিনি আর কেউ নয়, তিনি সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। শিশুদের স্নায়বিক জটিলতা ও অটিজম বিষয়ে কাজ করছেন সেই ২০০৮ সাল থেকে। দেশের গন্ডি পেরিয়ে আর্ন্তজাতিক পরিমন্ডলে অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে পেয়েছেন বিশেষ পরিচিতি।

শৈশব ও কৈশোরে বেড়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছিলাম গ্রামীণ জনপদে। দেখেছি এ ধরণের শিশুদের গ্রামে পাগল বলে হাসি তামাসা করা হতো। বলা হত পরিবারের কারও পাপের ফসল এটি, আল্লাহর অভিশাপ আরও কত কি। বাবা মা বাধ্য হয়ে সন্তানকে ঘরের বাইরে বের করতো না, লুকিয়ে রাখতো। এমনকি কেউ কেউ ঘরের ভিতরে শেকল দিয়েও বেঁধে রাখতো। বেদনার নীল জগতে বসবাসকারী এ সব শিশুদের সমাজের এবং পরিবারের বোঝা ভাবা হতো। আর আজ তাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কর্মকান্ডের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার ব্রতে নিরলস সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সুযোগ্য কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। যুক্তরাষ্ট্রের বারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির উপর মাস্টার্স করে নিজেকে উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশ তথা বিশ্বের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের কল্যাণে। তাঁর প্রচেষ্টায় ২০১১ সালের জুলাই মাসে ঢাকায় অটিজম নিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম আর্ন্তজাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দক্ষিণ এশিয়ায় অটিজম নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে এ সম্মেলনের মাধ্যমেই। সার্কভুক্ত দেশসমূহের অটিস্টিক শিশুদের স্বাস্থ্য, সামাজিক ও শিক্ষা সহায়তার প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তুলতে এ নেটওয়ার্ক বিশেষ ভূমিকা রাখছে। ২০১৩ সালের জুন থেকে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশেষজ্ঞ পরামর্শক প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত হন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। এ সংস্থা ২০১৪ সালে তাঁকে ‘হু এ্যাক্সিলেন্স’ এ্যাওয়ার্ডে ভূষিত করেন। অটিজম আন্দোলন ও শিশু স্বাস্থ্যে বিশেষ অবদান রাখার জন্য আমেরিকার বারি ইউনিভার্সিটি অ্যালামনাই এ্যাওয়ার্ড পান তিনি। WHO এর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অটিজম বিষয়ক শুভেচ্ছাদূত হিসেবে নিযুক্ত হয়েছেন। সম্প্রতি জাতিসংঘের অটিজম মোকাবিলা; এসডিজির আলোকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কৌশল’ শীর্ষক এক হাই-লেভেল ইভেন্টে মূল প্রবন্ধও উপস্থাপন করেন বাংলাদেশের অটিজম বিষয়ক কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। বাংলাদেশ গত ১১ বছর ধরে অটিজম নিয়ে বহুমুখী ও বহুপাক্ষিক মডেল বাস্তবায়ন করছে। লক্ষ্যও অর্জিত হয়েছে অনেকাংশে। প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ১৯৯৯ সালে গঠিত হয়েছে জাতীয় প্রতিবন্ধী উন্নয়ন ফাউন্ডেশন। এ ফাউন্ডেশনের অধীনে দেশের ৬৪ টি জেলায় ৮ টি বিভাগ এবং ঢাকায় ১০৩ টি প্রতিবন্ধী সেবা ও সাহায্য কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। যার মাধ্যমে এনডিডি সেবা, ফিজিওথেরাপী, স্পীচ থেরাপি, অকুপেশনাল থেরাপি কাউন্সেলিং প্রভৃতি সেবা সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দেয়া হচ্ছে। প্রান্তিক জনপদে এ জাতীয় সেবা এক সময় ছিল স্বপ্নের মত। ২০০১ সালে প্রথম আইন প্রণয়ন করা হয়েছে তাদের অধিকার সুরক্ষার জন্য। আন্ত:মন্ত্রণালয় টাস্কফোর্স গঠন করা হয় প্রতিবন্ধীদের জীবনমান উন্নয়নে। ২০১৩ সালে প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন, ২০১৯ সালে যুগোপযোগী করা হয়। প্রতি জেলায় ন্যুনতম একটি করে বিশেষ বিদ্যালয় স্থাপনের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে অনেক জেলায় তা করা হয়েছে। একই বছরে অটিস্টিকসহ অন্যান্য মানসিক প্রতিবন্ধীর প্রাতিষ্ঠানিক পরিচর্যা নিশ্চিতকরণে বাংলাদেশ জাতীয় নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার সংরক্ষণ ট্রাস্ট আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

অটিস্টিকদের অধিকার রক্ষা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও অন্যান্য আর্থ সামাজিক কর্মকান্ডে বাংলাদেশের ১৪ টি মন্ত্রণালয় সমন্বিতভাবে কাজ করা এবং নীতি নির্ধারণে অটিজমকে গুরুত্ব দেয়া; পিছনে প্রত্যক্ষ প্রেরণায় রয়েছেন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। এসব মন্ত্রণালয়ের সামাজিক সেবা কেন্দ্র, কমিউনিটি হেল্থ ক্লিনিক, স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অটিস্টিক ও তাদের পরিবারকে সেবা দিচ্ছে। শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে। নীতি নির্ধারক, সংসদ সদস্য, সরকারি কর্মকর্তা সবাই এ কর্মযজ্ঞে এক কাতারে শরীক করেছেন তিনি। প্রতিষ্ঠা করেছেন সূচনা ফাউন্ডেশনের মত সম্পূর্ণ সেবাধর্মী অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের। যুক্ত করেছেন ডা: প্রাণ গোপাল দত্ত, ডা: গোলাম রব্বানী, ডা: আফম রহুল হকের মত বরেণ্য চিকিৎসকদের। সূচনা ফাউন্ডেশনের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, মানসিক স্বাস্থ্য ও নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পথচলায় সহায়তা করা, যেন তারা আর্থিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে সমাজের উন্নয়ন থেকে বিছিন্ন না হয়ে পড়ে শুধু তাদের ডিজঅর্ডার বা সমাজ কর্তৃক কোন বৈষম্যের কারণে। সূচনা ফাউন্ডেশন এমন একটি সমাজের কথা চিন্তা করে যেখানে যে কোন ধরনের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের জন্য সহায়তা এবং উপযুক্ত পরিবেশে যেন তারা একটি কার্যকর ও অর্থবহ জীবনযাপন করে। সিভিল সার্ভিসের নবীন কর্মকর্তাদের এনডিডি ও মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারনা দেয়ার জন্য বিপিএটিসি ও সূচনা ফাউন্ডেশনের মধ্যে ২০১৭ সালে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। যাতে করে বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করার সময় কর্মকর্তারা এ জ্ঞান বাস্তবে কাজে লাগাতে পারে। অটিজম বিষয়ক সেবা প্রদানে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় এগিয়ে এসেছে বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠান। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক সহায়তায় বর্তমানে ৫৮ টি বেসরকারি প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। সরকার এ বছরের পহেলা জানুয়ারি হতে একমাস সময় ধরে যেসব প্রতিষ্ঠান বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের শিক্ষা ও চিকিৎসা সেবা দিচ্ছে তাদের এমপিওভুক্তির আবেদন গ্রহণ করেছে। অধিক সংখ্যক যোগ্য প্রতিষ্ঠান সরকারি অনুদান প্রাপ্তির ফলে এ সেবা আরও সম্প্রসারিত ও টেকসই হবে।

ছবি : অটিস্টিক শিশুদের সাথে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন

ইতোমধ্যে সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘সেন্টার ফর নিউরো ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড অটিজম ইন চিলড্রেন সেন্টার’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি’ বিভাগ এবং অটিস্টিকদের জন্য ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট’ চালু করেছে। ঢাকা সেনানিবাসসহ কয়েকটি সেনানিবাসে ‘প্রয়াস’ বিদ্যালয় স্থাপন করেছে। ঢাকার বাইরে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বিশেষ শিশুদের জন্য অরুণোদয়ের মত কিছু কিছু মানসম্মত প্রতিষ্ঠান তৈরী হয়েছে। যা আমাদেরকে আরও আশান্বিত করছে।

অটিজম আক্রান্তদের নিয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর একটি বক্তব্য আমাদের সবসময় অনুপ্রাণিত করে। তিনি বলেছেন, “এদের মধ্যে সুপ্ত প্রতিভা আছে। সেটাই বিকাশিত করে দেয়ার সুযোগ করে দিতে হবে। যেন মেধা বিকাশের মাধ্যমে তারাও সমাজকে কিছু উপহার দিতে পারে।” অটিজমে আক্রান্ত প্রখ্যাত বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন, চালর্স ডারউইন, আইজ্যাক নিউটনের নাম উল্লেখ করে তিনি বলেন, “অটিস্টিক শিশুরা যেন অবহেলায় হারিয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি দিতে হবে। তারাও মানুষ। তারাও আমাদের সমাজের অংশ। তাদের জন্যও আমাদের কাজ করতে হবে। একটা দেশকে উন্নত করতে হলে তা সবাইকে নিয়ে করতে হবে। কাউকে অবহেলা করে না।” জাতীয় উৎসবসমূহে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা কার্ডে এখন বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুদের আঁকা ছবি শোভা পাচ্ছে। প্রতিবন্ধীদের অধিকার সুরক্ষায় আর্ন্তজাতিক আইন গ্রহণের ক্ষেত্রে অগ্রনী দেশের তালিকায় রয়েছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ এর প্রটোকলেও স্বাক্ষর করেছে। যা সম্ভব হয়েছে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দূরদর্শী মানবিক নেতৃত্বে এবং তাঁর কন্যা সায়মা ওয়াজেদ হোসেন এর অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান, অগ্রণী ভূমিকার কারণে।

২রা এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস পালিত হয় প্রতি বছর। আর্ন্তজাতিকভাবে স্বীকৃত স্বাস্থ্য সংক্রান্ত সাতটি দিবসের মধ্যে এটি অন্যতম। সারা বিশ্বের অটিজম সংক্রান্ত সংস্থাগুলো একত্রিত হয়ে মানসিক বিকাশগ্রস্ত ব্যাধিতে আক্রান্তদের সম্পর্কে গবেষণা, রোগ নির্ণয়, চিকিৎসা প্রদান এবং তাদের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতার মত বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশও এক্ষেত্রে অভূতপূর্ব অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০১২ সাল থেকে সায়মা ওয়াজেদ হোসেন প্রতিবছর জাতিসংঘের অটিজম সচেতনতা দিবসে আর্ন্তজাতিক অটিজম বিশেষজ্ঞ হিসেবে আমন্ত্রিত হচ্ছেন; যা আমাদের গৌরব ও অহংকারের বিষয়। দেশের শতকরা দশভাগ নানা ধরেণের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের আশা ভরসার আশ্রয়ের সমার্থক হয়েছেন তিনি। বিশ্বব্যাপী অটিজম ও অন্যান্য নিউরো ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষা, তাদের জীবনমানের দীর্ঘমেয়াদী টেকসই ও ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সৃষ্টিশীল, সূলভ ও টেকসই পরিকল্পনা প্রণয়নে তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন আজও। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন একটি পতাকা, স্বাধীন সর্বভৌম বাংলাদেশ। তাঁরই সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে অদম্য অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের অর্থনীতি; পেয়েছি উন্নয়নশীল বাংলাদেশ, স্বপ্ন দেখছি উন্নত বাংলাদেশের। আর সে লক্ষ্যেই অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকে সার্কভুক্ত দেশ সমূহকে ছাড়িয়েছি আমরা। জাতির পিতার দৌহিত্রের যোগ্যতার লীড়াারশীপে দেশের পিছিয়ে পড়া প্রায় ১৬ লক্ষ বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন মানুষের নতুন স্বপ্ন দেখানো এবং তাদের উন্নয়নের মূল ধারায় সম্পৃক্ত করার কঠিন কাজটি করেছেন দৃঢ়তার সাথে আমাদের প্রিয় সায়মা ওয়াজেদ হোসেন। “আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া, বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া” রবীন্দ্রনাথের এ ভাবনার সারথী, মানুষের মাঝে বেঁচে থাকবেন লক্ষ বছর স্ব মহিমায় নিজ কর্মগুনে।

লেখক : জেলা প্রশাসক , কক্সবাজার ।