অধ্যাপক আকতার চৌধুরী
২য় পর্ব
বৈশ্বিক মহামারী করোনা (কোভিড-১৯)। চীনের হুবেই প্রদেশের ওহান শহরে সর্বপ্রথম ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে ব্যাধিটি শনাক্ত হয় ।বাংলাদেশে করোনাভাইরাসটির প্রথম ঘটনা ধরা পড়ে ৮ মাচ ২০২০ সালে । বহুরুপী করোনা । যার একই অঙ্গে অনেক রুপ। করোনা এই পযন্ত প্রায় ২শ এর কাছাকাছি রুপ পাল্টেছে। কোন মতেই বশে আনতে পারছে না বিজ্ঞানীরা । সোজা কথা ঔষধই আবিস্কার করতে পারেনি । করোনা মানে আতংক , মৃত্যুর ভয় ।বেঈমান দুটো হাত ঠেলে দিচ্ছে করোনার দিকে। এখন বিশ্বের প্রায় ১৭৭ টি দেশকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে । আমরা প্রতিদিনই দেখছি মৃত ও আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। ব্যাধিটি চীনে শনাক্ত হলেও ২০২০ সালের প্রারম্ভে বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে এবং বৈশ্বিক মহামারীর রূপ ধারণ করে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পও এর নাম দিয়েছে চীনা ভাইরাস। যদিওবা চীন তীব্র আপত্তি করেছে। কেউ কেউ চীনের বিরুদ্ধে মামলার প্রস্তুতিও নিচ্ছে। কেউ বলছেন জীবাণু অস্ত্র। এক করোনা বিশ্বের রাজনৈতিক , সামাজিক , অর্থনৈতিক , ধর্মীয় , সাংস্কৃতিক ও পারিবারিক জীবন বিশাল একটা পরিবর্তন এনে দিয়েছেন।
৩০ মার্চ ২০২০ পর্যন্ত জরীপে জানা যায় , বিশ্বে করোনা(কোভিড-১৯) আক্রান্ত – ৭২১৮১৭ জন , আক্রান্ত দেশ ১৭৭টি , মৃত্যু হয়েছে ৩৩৯৬৮ জনের। বাংলাদেশে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করা হয়েছে সর্বমোট ১,১৮৫ জনের; এখন পর্যন্ত পরীক্ষায় আক্রান্ত পাওয়া গেছে মোট ৪৯ জন; এদের মধ্যে সুস্থ হয়ে বাড়ী চলে গেছেন ১৯ জন এবং বর্তমানে চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৮ জন। দেশে মোট মৃত্যু ৫ জনের এবং গত ৫ দিনে নতুন করে কোন ব্যক্তির মৃত্যু ঘটেনি। বিশ্বে চীনকে পেছনে ফেলে মৃত্যুর হারে ইতালী , স্পেন , ইরান , ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র এক অপরের প্রতিযোগিতায় নেমেছে।অবাধ্য করোনার ধ্বংস লীলা চরমে।
পর্যটন রাজধানী ও রোহিঙ্গা শরনাথী কবলিত কক্সবাজারে – করোনা কোয়ারান্টাইনে আছে ৫৫৩, মুক্ত হয়েছে ১৯৮, মৃত্যু- নাই । এই হিসেব টি দিয়ে রাখলাম ভবিষ্যতের পাঠকদের জন্য ।
বাংলাদেশে প্রায় ১৫দিন করোনা ভাইরাস নিয়ে প্রস্তুতি শুরু হলেও কক্সবাজার মূলত করোনা খাতায় নাম উঠায় গত ২৪ মার্চ ২০২০ ।কক্সবাজার নিউজসহ অনলাইনে সংবাদ এলো -‘কক্সবাজারে করোনা রোগী শনাক্ত’। এ সংবাদে হঠাৎ যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। কক্সবাজার শহরের রাস্তা ঘাটে একটা ভীতিকর পরিস্থিতির উদ্ভব হল । যে যেখানে অবস্থান করছিল , সেখানেই মনে হচ্ছিল , এই বুঝি করোনা আমাকে ধরে ফেলল। আর বাঁচা গেলনা । অনেকে রাস্তাঘাট ছেড়ে ঘরমুখো । আরেকদল লোক করোনা রোগী যেন এক দশনীয় বস্তু তা দেখার জন্য খোঁজে বের হয়ে পড়ল।
কক্সবাজারের প্রথম মহিলা করোনা রোগী।(ইতিমধ্যে ওনার নাম ঠিকানা সবাই জেনে গেলেও আমি সংগত কারণে নাম উহ্য রাখলাম)। মূলত পবিত্র ওমরাহ হজ্ব করতে গিয়েছিলেন। তখন সৌদি আরবেও করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হয়। যারা দেশের বাইরে থেকে আসছিলেন তাদের জন্য বিমান বন্দরে প্রাথমিক জ্বর টেষ্ট ও হোম কোয়ারেন্টাইন বাধ্যতামূলক ছিল। কিন্তু এয়ারপোর্টের সেই বাধা অতিক্রম করে দেশে তিনি কোন বাধা ছাড়া দেশে প্রবেশ করলেন। ২৪ মার্চ করোনা পজেটিভ ধরা পড়ার পর রোগী ও পরিবার তখন আসামীর কাঠ গড়ায়। মানুষের নেগেটিভ ধারণা। সাধারণ একজন রোগী যে সহানুভূতি পায় ওনি পেলেন না। প্রশাসন তৎপর না হলে আরো বড় অপ্রীতিকর অবস্থার সৃষ্টি হত। ভাগ্যিস করোনা রোগী । সামাজিক দুরত্বের চেয়ে দুরে থাকতে হবে। কাছে যাওয়ার সুযোগ নেই । অদৃশ্য করোনার মত অদৃশ্য দেয়াল তৈরী হয়ে গেল।
একই দিন আবার সংবাদ শিরোনাম , “তিন বাড়িতে উঠেছিলেন করোনা আক্রান্ত ওই নারী, সংস্পর্শে এসেছে অনেকে”। চট্টগ্রাম, খুটাখালী ও কক্সবাজার শহরের তিন বাড়িতেই উঠেছিলো কক্সবাজারের প্রথম করোনা আক্রান্ত রোগী । তিনি সৌদিআরব থেকে ওমরা হজ্ব শেষে ১৩ মার্চ প্রথম উঠেন তাঁর ছোট ছেলের চট্টগ্রামস্থ বাসায়। সেখান থেকে আসেন খুটাখালীর নিজস্ব বাড়িতে। অসুস্থ হয়ে পড়লে খুটাখালী থেকে তাকে নিয়ে আসা তাঁর বড় পুত্র এক কলেজের অধ্যক্ষ কক্সবাজারের দক্ষিণ টেকপাড়াস্থ পল্লবী লেইনের বাসায়।
ফলে ওই তিন বাড়িসহ এলাকার রাস্তাঘাট লকডাউনের আওতায় চলে আসে। ওদিকে মহিলার গ্রামের বাড়িতে আরেক ভীতিকর অবস্থা ।সেখানেও এলাকার লোকজন এক প্রকার প্রতিবেশী হিসেবে নিজেকে পোড়া কপাল ভাবতে শুরু করল। আর যারা হজ্ব থেকে আসার পর দেখা সাক্ষাত করেছেন তারাও মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ল। না জানি করোনা তাদের দেহে ঢুকল কিনা। করোনা রোগীর সংস্পর্শে এলে যে কেউ আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে ।
এদিকে দেখা গেল আরেক কান্ড । কক্সবাজারে যে সব রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি লক ডাইনের আওতায় তা যেন পাবলিকের দর্শনীয় স্থানে পরিণত হল। প্রশাসন ও পুলিশ এদের বুঝাতে গলদঘর্ম।
কিছু মানুষের ক্ষোভটা গিয়ে পড়ল রোগীর অধ্যক্ষ পুত্রের উপর । কেন তিনি ওমরাহ হজ্বের কথা গোপন করেছেন। সমাজের একজন সচেতন ব্যক্তি হয়ে এ কথাটা গোপন করা উচিত হয়নি ইত্যাদি মন্তব্যে মানুষ তখন সামাজিক মাধ্যমে মারমুখো। আবার অধ্যক্ষের সাথে এসময়ে যারা মেলামেলা করেছেন তাদেরও দু:শ্চিন্তা । তিনি কোথায় কোথায় গেলেন। কোন শিক্ষা বোর্ডে গেলেন । কাদের সাথে মিটিংয় করলেন । এদের উপর আবার হোম কোয়ারেন্টাইন আরোপ।আবার তাদের পরিবারের উপর এক মানসিক চাপ।
এ ঘটনার পর বৈঠকে থাকা চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের তিন কর্মকর্তাসহ ১৬ জনকে করোনাভাইরাসের ঝুঁকিতে বলা হল। বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় আতঙ্কে ভুগেছেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও। বৈঠকে উপস্থিত সবাইকে হোম কোয়ারেনটাইনে থাকার পরামর্শ দিয়েছিলেন চট্টগ্রাম শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ।
জানা গেল এই রোগী এক ভিআইপি আত্মীয়ের রেফারেন্সে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে ভর্তি হন। স্বাভাবিক কারণে ডাক্তাররা হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সৌজন্য সাক্ষাতের জন্যও অনেকে গেলেন। এবার তাদের উপর হোম কোয়ারেন্টাইনের খড়গ। দেখা গেল এক করোনা রোগীতে ৯ ডাক্তারসহ ১৪জন হাসপাতালের নার্স ও সাফাই কর্মী কমে গেল। এমন অবস্থায় সাধারণ রোগীদের চিকিৎসার জন্য একদিকে ডাক্তারের সংকট অন্যদিকে করোনা আক্রান্ত রোগীর ভয়ে অন্য রোগী যাওয়া কমে গেল। এমনকি অন্য ডাক্তাররা তাদের সেফটি না থাকায় চিকিৎসা করতে ভয়ে কাতর। চাকুরী বাঁচানোর তাগিদে অনেকে ধরি মাছ না ছুই পানির মত ডিউটি করল। কেউ কেউ সেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে চলে যাওয়ার জন্য আবেদন করল। ফলে বাধ্যতামূলক হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকা ২ ডাক্তারকে অফিস করতে হল। আবার তাদের বিরুদ্ধে হোম কোয়ারেন্টাইন ভাঙ্গার অভিযোগ উঠল অনলাইন সংবাদ পত্রে।
যে ৯জন চিকিৎসক ছিলেন তাদের মধ্যে এক চিকিৎসকের স্ত্রী কক্সবাজারের পাশ্ববর্তী এক উপজেলার ইউএনও । ডাক্তার স্বামীর কারণে তিনি পড়ে গেলেন বিপদে । তাঁকেও হোম কোয়ারেন্টাইনে পাঠানো হল। এই মহামারী করোনার সময়ে একটা উপজেলার ইউএনও হোম কোয়ারেন্টাইনে যাওয়া মানে পুরো উপজেলার নাগরিকদের অসহায় করে দেয়া।
একই রোগীর কারণে লকডাউন করা হল চট্টগ্রামে দুই আত্মীয়ের ফ্লাটের ভবন সমূহ । এখানেও করোনার ভয়ে, চরম ভোগান্তি ও মানসিক যন্ত্রণায় ভবনের অধিবাসীদের দিন কাটছে।
একটা প্রশ্ন বারবার ঘুরে ফিরে আসছে । সন্তান কিংবা পরিবার না হয় বিদেশ থেকে আসার ব্যাপারটা গোপন করেছেন, এয়ারপোর্টে তিনি এড়ালেন কিভাবে? ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস রোগী ধরা পড়ে। এই মহিলা এসেছেন ১৩ মার্চ । তখন এয়ারপোর্টে কড়াকড়িও ছিল। যদি দেশে প্রবেশের সময় হোম কোয়ারেন্টাইন সীলটা পড়ত তাহলে এতদুর গড়াত না ।বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশনের স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর বিদেশ ফেরত যাদের টেম্পারেচার (শরীরের তাপমাত্রা) স্বাভাবিক থাকবে, তাদেরকে এই সীল দেয়া হয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের পক্ষ থেকে। তারা অবশ্যই নিজ বাসা/বাড়িতে কোয়ারান্টাইনে থাকবেন সীলে উল্লেখিত নির্ধারিত তারিখ পর্যন্ত। উৎসে সাবধান হওয়া যেত।
নি:সন্দেহে এই রোগীর পরিবার কক্সবাজারের একটি সম্ভ্রান্ত পরিবার।সবাই শিক্ষিত। মানুষের প্রতি কমিটমেন্ট আছে। আমরা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি তিনি যেন এই বৈশ্বিক ব্যাধি করোনা থেকে মুক্তি পান এবং পরিবারের সম্মান ফিরে পান।
আজ যে কারণে এত বিব্রতকর পরিস্থিতির শিকার তার অন্য একটি কারণও আছে। করোনা রোগী হিসেবে ওনার পরিচয়টা গোপন করা উচিত ছিল। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন সে কাজটি না করে মিডিয়াকে রোগীর পরিচয়সহ প্রকাশ করে দেয়। যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নীতি বিরোধী । একই কাজটি করেছেন আমাদের মিডিয়াগুলো। প্রথমে সতীর্থ একটি অনলাইন মিডিয়ায় নামসহ প্রকাশ করায় চরম ভাইরাল হয়ে যায়। আমরাও নামসহ প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। তবে এটাও ছিল চরম ভুল। যা আমাদের উপর দায় দায়িত্ব বর্তায় ।
এর থেকে আমরা যাতে শিক্ষা নিয়ে সামনে ভুল না করি। আর কোন করোনা রোগীকে নিয়ে যাতে কোন পরিবার সামাজিক হেরাসমেন্টের শিকার না হয়। কক্সবাজারবাসী যেন আর কোন করোনা রোগীকে নিয়ে করুণ অবস্থায় না পড়ে।এখান থেকে ভবিষ্যতের করোনা রোগীর পরিবার ,পরিজন, প্রশাসন , মিডিয়া ও জেলাবাসী শিক্ষা নিতে পারি।
♦» করোনা ডায়েরী-১ম পর্ব : ঘাতক করোনার অভদ্র শিষ্টাচার!
♦» করোনা ডায়েরী- ২য় পর্ব: এক করোনা রোগীতে কক্সবাজারের করুণ অবস্থা
♦» করোনা ডায়েরী- ৩য় পর্ব : এ কেমন করোনার করুণ রঙ্গ !
লেখক: সম্পাদক , কক্সবাজার নিউজ ডটকম (সিবিএন) ও সহকারী অধ্যাপক , কক্সবাজার সিটি কলেজ।
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।