সিবিএন ডেস্ক
প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস আতঙ্কে ভোক্তাদের অতিরিক্ত চাহিদার কারণে রাজধানীর বাজারগুলোতে সব ধরনের চালের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে সাত টাকা বেড়ে গেছে খুচরা পর্যায়ে। আবার পাইকারি বাজারে বেড়েছে দুই থেকে তিন টাকা। অথচ সরকারি গুদামে চালের পর্যাপ্ত মজুদ রয়েছে। একইসঙ্গে বাজারগুলোতে চালের সরবরাহও ভালো।

জানা গেছে, ভাইরাস কেন্দ্র করে ভোক্তাদের অতিরিক্ত চাহিদা রয়েছে চালের বাজারে। সেই চাহিদা পুঁজি করে অসাধু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করছেন। আর সব ধরনের চালের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে একই চিত্র এসেছে বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ)।

এ মুহূর্তে আমাদের খাদ্যশস্য মজুদ ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৪৯৫ মেট্রিকটন। গতবছর এ সময়ে ছিল ১৫ লাখ ৪৪ হাজার ৫২৩ মেট্রিকটন। এরমধ্যে গম আছে তিন লাখ ১৯ হাজার মেট্রিকটন। বিগত অর্থবছরে চালের উৎপাদন ছিল তিন কোটি ৭৪ লাখ মেট্রিকটন। এছাড়া বর্তমানে সরকারিভাবে ১৪ দশমিক ২০ লাখ মেট্রিকটন চালের মজুদ রয়েছে।

ভোক্তারা বলছেন, দেশে করোনা ভাইরাস প্রবেশ করেছে। আজ না হয় কাল এটা বড় আকার ধারণ করবে আশঙ্কা। এর সংক্রমণে একজন মারা গেছেন। সামনে যে মানুষ মারা যাবে না, এটা তো কেউ বলতে পারে না। এছাড়া আক্রান্ত সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আজ শিবচর লকডাউন করা হয়েছে। কাল যে কোথায় হবে সেটা জানি না। যদি আন্তজেলা যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়, কোনো যানবাহন না চলে, তাহলে সব পণ্যের দাম আরও বেড়ে যাবে। তখন আমরা সাধারণ মানুষ কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কোথায় পাব।

তারা বলেন, সরকার বলছে মজুদ আছে। সরকার কী উন্নত দেশের মতো আমাদের বাড়িতে গিয়ে পণ্য দিয়ে আসবে। তা তো দেবে না। আর ন্যায্য মূল্যে ট্রাকে করে যা বিক্রি করে, সেখানে লাইনে দাঁড়িয়ে আনতে গেলে জনসমাগমে যেতে হবে। আমাদেরই সংগ্রহ করতে হবে। তখন আমাদের নিরাপত্তা কে দেবে। তাই আগে থেকেই খাদ্যের ও পরিবারের নিরাপত্তার জন্য একটু বেশি কিনে রাখছি। সরকারের উচিত বাজার মনিটরিং করে সরবরাহ ঠিক রাখা। সরবরাহ ঠিক থাকলে দাম সাভাবিক থাকবে।

বাবুবাজারের চাল ব্যবসায়ী সমিতির সেক্রেটারি নিজাম উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, করোনা ভাইরাসের প্রভাবে গত দুই-তিন দিনে পাইকারি বাজারে সব রকমের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়ে গেছে। কারণ মানুষ আতঙ্কিত হয়ে চাল কিনে মজুদ করছে। যার এক বস্তা চাল মাসে লাগে, সে কিনে নিচ্ছে চার বস্তা। গত দুইদিনে আড়তে হরিলুটের মতো চাল বিক্রি হয়েছে। ফলে বাজারে সাময়িক সরবরাহের সংকট তৈরি হয়। সুবাধে ব্যবসায়ীরা একটু দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। তবে ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে স্বাভাবিক হয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

তিনি বলেন, প্রতি বছর এ সময় চালের দাম একটু বেশি থাকে। তাই এটা স্বাভাবিক বিষয়। কারণ এখন কোনো ধানের মৌসুম নয়। আর পুরাতন চাল প্রায় শেষ। নতুন চাল আসতে আসতে আরও ১৫ থেকে ২০ দিন সময় লাগবে। তাই এপ্রিলের আগে আর চালের দাম কমবে না। এখানে পাইকারি ব্যবসায়ীদের কোনো হাত নেই। তবে মিলাররা যদি দাম কম রাখেন, তখন আমরাও কম রাখতে পারি। এজন্য দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারকে মিল মালিকদের ওপর নজরদারি বাড়ানোসহ নিরবচ্ছিন্ন সাপ্লাই চেইনের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে এই দুর্যোগের সময়ে ভোক্তারা খেয়ে বাঁচতে পারেন।

বাবুবাজারের পাইকারি চাল বিক্রেতা দৌলত ভাণ্ডারের ক্যাশিয়ার আফজাল হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, গত দুই-তিন দিনে সব ধরেনের চালের দাম কেজিতে দুই থেকে তিন টাকা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে স্বর্ণ চালের দাম। মানুষ চাহিদার থেকে অনেক বেশি চাল কিনছে। যার প্রয়োজন ৪০ কেজি, সে নিয়ে যাচ্ছে ১০০ কেজি। মানুষ এখন করোনা ভাইরাস নিয়ে আতঙ্কে আছে। তাই তারা ভবিষ্যতে কী হবে, সেটা চিন্তা করে মজুদ করছে।

দাম কেনো বাড়লো জানতে চাইলে এই চাল বিক্রেতা বলেন, অতিরিক্ত চাহিদার কারণে আড়তে সংকট দেখা দিয়েছে। অপরদিকে, বেশি চাহিদা দেখে মিল মালিকরা বলছেন, তাদের কাছে চাল নেই। তাদের কাছে যদি ৫০০ বস্তা চাল চাওয়া হয়, তাহলে তারা সংকট আছে বলে দিচ্ছেন ২০০ বস্তা। তা-ও আবার সময় মতো সাপ্লাই দিচ্ছেন না। ফলে দাম বেড়ে যাচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে রায় সাহেব বাজারের খুচরা চাল বিক্রেতা মো. মোক্তার হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, মানুষ করোনা ভাইরাসে আতঙ্কিত হয়ে বেশি করে চাল কিনছে। এ সুযোগে মিল মালিক ও পাইকারি অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বেশি নিচ্ছেন। ফলে গত দুই-তিন দিনে চালের দাম পাঁচ থেকে ছয় টাকা বেড়েছে।

সম্প্রতি বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, করোনা ভাইরাসের কারণে নিত্যপণ্য আমদানিতে কোনো ধরনের প্রভাব পড়েনি। বাংলাদেশে বর্তমানে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও খাদ্যশস্যের মজুদ যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ পণ্য বেশি রয়েছে। করোনা ভাইরাসের কারণে আতঙ্কিত হয়ে পণ্য মজুদ করলে স্বাভাবিক বাজার পরিস্থিতি বিঘ্নিত হতে পারে। তাই আতঙ্কিত না হয়ে ক্রেতা হিসেবে স্বাভাবিক ক্রয় করলে কোনো ধরনের সংকট তৈরি হবে না।

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার বলেছেন, ব্যবসায়ীরা যদি করোনাকে পুঁজি করে বাজে কথা ছড়ায়, তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাজারে যথেষ্ট মজুদ রয়েছে। এরপরও যদি ঘাটতি দেখা দেয় প্রয়োজন হলে বাইরে থেকে পণ্য সরবরাহ করা হবে। তবুও আমরা কোনক্রমেই পণ্যের দাম বাড়তে দেব না।

রাজধানীর পাইকারি ও খুচরা বাজার ঘুরে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে জাত ও মানভেদে প্রতি কেজি সরু চাল বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৬০ টাকায়। প্রতি কেজি সাধারণ মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৫ টাকায়। উত্তম মিনিকেট বিক্রি হচ্ছে ৫৬ থেকে ৬২ টাকায়। যা দুইদিন আগে ছিল ৪২ থেকে ৫৫ টাকা। এছাড়া উত্তম নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৬০ থেকে ৬২ টাকা কেজি। আর সাধারণটা ৫৪ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে বিক্রি হতো ৪৮ থেকে ৫২ টাকা করে।

মাঝারি মানের পাইজাম ও লতা ৪২ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যা আগে বিক্রি হতো ৩৮ থেকে ৪২ টাকা করে। ২৮ চাল প্রতি কেজি ৪০ থেকে ৪৪ টাকা। যা আগে ছিল ৩৩ থেকে ৩৬ টাকা। ২৯ চাল প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৪২ থেকে ৪৪ টাকায়। যা আগে ছিল ৩৪ থেকে ৩৭ টাকা। মোটা স্বর্ণা ও ইরি চাল ৩৮ থেকে ৪২ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। অথচ, দুইদিন আগেও তা বিক্রি হয়েছে ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি।

এদিকে, পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি মিনিকেট ৫০ টাকা দরে। কিন্তু দুইদিন আগেও বিক্রি হয়েছে ৪৮ টাকা করে। নাজিরশাইল বিক্রি হচ্ছে ৫৫ টাকা করে। যা আগে ছিল ৫৩ টাকা। বাসমতি প্রতি কেজি চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৮ টাকায়। যা আগে ছিল ৫৬ টাকা। একইভাবে বেড়েছে অন্যান্য জাতের চালের দরও।

বিশ্বব্যাপী মহাবিপর্যয়ে নেমেছে করোনা ভাইরাস। অন্তত ১৬৫টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। লাফিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। আক্রন্তও দ্রুতগতিতে বাড়ছে। একইসঙ্গে বাংলাদেশেও ভাইরাসটিতে আক্রান্ত সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। দেশে কোভিড-১৯ রোগ শনাক্ত হয়েছে এ পর্যন্ত ১৭ জনের। এর মধ্যে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনজন সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। বাকিরা আছেন আইসোলেশনে।