সিবিএন ডেস্ক
আইন, নীতিমালা, আন্তর্জাতিক সনদে অধিকারের প্রশ্নে নারীকে বঞ্চিত করা হলে লৈঙ্গিক সমতা কোনোভাবেই সম্ভব নয় বলে মনে করছেন নারী অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশের নারীর অধিকার সংরক্ষণে বেশ কিছু আইন হয়েছে। কিন্তু, বাস্তবায়নের জায়গা দুর্বল হওয়ায় এখনও অধিকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এমনটা বলার সুযোগ কম। উত্তরাধিকার আইন, অভিভাবকত্বে মায়ের অধিকার, সিডও সনদের সংরক্ষিত দুইটি ধারা নিয়ে সুস্পষ্ট অবস্থান ব্যক্ত করতে না পারলে সহসা এই পরিবর্তন আসার কোনও সম্ভাবনাও দেখছেন না তারা।

এরই মধ্যে আজ রবিবার (৮ মার্চ) ‘প্রজন্ম হোক সমতার, সকল নারীর অধিকার’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে পালন হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। আর এ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখেই প্রশ্ন দাঁড়ায়,আইনে বঞ্চনার জায়গা রেখে কীভাবে সেই সমতায় প্রজন্ম পৌঁছাবে?

২০১১ সালে প্রণীত জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিতে সমানাধিকারের বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলা হয়, উপার্জন, উত্তরাধিকার, ঋণ, ভূমি ও বাজার ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে অর্জিত সম্পদের ক্ষেত্রে নারীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে। যদিও এর কোনোটিই বাস্তবায়নের বাস্তবতা তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন না নারীনেত্রীরা।

নারী স্বাধীনতায় ব্যাখ্যায় নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার কথা বলা হয়ে থাকে। ‘ভায়োলেন্স অ্যাগেইনস্ট উইমেন’ (ভিএডব্লিউ) সার্ভে ২০১১ নামের সমন্বিত এ জরিপেই নারীর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়েছে, ৮৫ শতাংশ নারীর উপার্জনের স্বাধীনতা নেই, ২৪ শতাংশেরই নিজের আয়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ নেই। মাত্র ১৫ শতাংশ নারী নিজের ইচ্ছায় উপার্জনের স্বাধীনতা পান। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রথমবারের মতো নারী নির্যাতন নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে জরিপ চালিয়েছে। এই জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৮৭ শতাংশ নারী নির্যাতনের শিকার হন।

এদিকে নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলোপ সনদের (সিডও) গুরুত্বপূর্ণ ২ ও ১৬.১ (গ) ধারা এখনও কার্যকর করেনি বাংলাদেশ। এ দুটি ধারা সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। নারীনেত্রীরা বলছেন, সংরক্ষণ করে রাখা এ দুটি ধারা তুলে না নিলে সমতা নিশ্চিত হবে না। সিডও সনদের ২ নম্বর ধারায় রয়েছে, নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য নিরসনে শরিক দেশগুলো আইনগত ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেবে এবং আইনের সংস্কার করবে। অন্যদিকে, ১৬.১ (গ) ধারায় বিবাহ ও বিবাহবিচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমান অধিকার ও দায়িত্বের কথা বলা হয়েছে।

জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে সিডও কমিটিকে দেওয়া অগ্রগতি প্রতিবেদনে বলা হয়, অভিন্ন পারিবারিক আইন প্রণয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমাজ এখনও প্রস্তুত নয়। এটি অসম্মানজনক।
তবে তিনি ব্যক্তিগতভাবে মনে করেন, এই মুহূর্তে সিডও সনদের দুটি ধারা সংরক্ষণ প্রত্যাহার করা দরকার। এ সংরক্ষণ শাসনতন্ত্র ও সংবিধানবিরোধী। যখনই আন্তর্জাতিক কোনও সনদে আপনি স্বাক্ষর করছেন তখনই মনে রাখা জরুরি, সনদের মূলসুরের সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ দাবি সামনে রেখে কোনও ধারা সংরক্ষণ করা যাবে না।

অবশ্য, নারীনেত্রী সালমা আলী মনে করেন নারী আগের চেয়ে দৃশ্যমান হয়েছে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা এগিয়েছি, অনেক নারী এখন প্রতিবাদী হয়েছেন। কিন্তু লক্ষ্য করতে হবে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কিনা। এই প্রশ্ন মাথায় রেখে যদি বলি, তাহলে বলবো, আমরা বেশ কিছু ভালো আইন পেলেও বাস্তবায়নের জায়গায় এখনও সততা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে। সে কারণেই ধর্ষণ ও নির্যাতনকারী তৈরি ও লালন করার যে কাঠামো সেটা আরও শক্তিশালী হয়ে উঠছে।

সব মিলিয়ে আমার মনে হয় আমাদের যুদ্ধটায় আমরা এখনও নাজুক অবস্থায় আছি ‘উত্তরাধিকার আইনের বিষয় উল্লেখ করে এই নেত্রী বলেন, ‘এখানেই আমাদের গোড়ায় গলদ। সংবিধান নারী পুরুষের সমতার কথা বলছে কিন্তু, ওই জায়গায় ব্র্যাকেট দিয়ে রেখে দিয়েছে। নারীকে তার সমতার জায়গায় শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে রাখা হয়েছে।’ তার প্রশ্ন, ‘ভারতের মতো দেশ এই জায়গাগুলোতে পরিবর্তন আনতে পারলে আমরা কেন পারবো না? আমরা আশা করেছিলাম, বর্তমান সরকার এই চ্যালেঞ্জটা নেবে।’

নারী প্রগতি সংঘের প্রধান নির্বাহী রোকেয়া কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকা খাটো করে দেখার কোনও সুযোগ নেই। তুলনামূলক বিচার যদি করা যায়, দেখা যাবে অতীতের যে কোনও সময়ের তুলনায় বাংলাদেশে নারীর ক্ষমতায়ন অনেক বেড়েছে। কিন্তু, ক্ষমতায়িত পদে আসীন আর সামগ্রিক ক্ষমতায়ন সমার্থক নয়। এ দুটি বিষয় এক অর্থে ব্যবহৃত হওয়ার কোনও সুযোগ নেই। সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক সূচকে নারী উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখার পরেও স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, বৈষম্য রয়ে গেছে। ফলে প্রজন্মকে আইনি বাধা-বিপত্তির মধ্যে রেখে সমতার স্বপ্ন দেখালে তা অর্জন সম্ভব হবে না। আমি স্বাধীন, সমভাবে কাজ করার অধিকার আমার আছে এই বোধ তৈরি করতে হবে রাষ্ট্রকেই।’