মুরাদ মাহমুদ চৌধুরী

স্বাধীন বাংলার ইতিহাসে বাংলার বাঘের গর্জন। আর সেই গর্জনের ডাকে সাড়া দিয়ে লাখো বাঙ্গালী অনুপ্রাণিত হয়ে ঐক্যতা এনেছিল সেদিন। গায়ের রক্তে চাপ সৃষ্টি করেছিল সেদিনের লাখো তরূণের। সেদিনের বাঘের গর্জনটা আর কারো নয়। প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভূমিকায় আজ আমরা বাংলায় কথা বলি। নিজেকে বাঙ্গালী দাবী করতে পারি। তার এক ঘনিষ্ঠ সহচর, বর্ষীয়ান নেতা, ভাষা সৈনিক ও বীর মুক্তিযোদ্ধা বাদশাহ মিয়া চৌধুরী।
তিনি কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার হলদিয়া পালং ইউনিয়নের পাতাবাড়ী গ্রামের এক অভিজাত জমিদার পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। ছাত্রজীবন শুরু হয় উখিয়ার পালং উচ্চ বিদ্যালয় থেকে। ১৯৪৭ সালে তিনি এবং তার আপন বড় ভাই সালেহ আহমদ চৌধুরী পালং উচ্চ বিদ্যালয়ে একইসাথে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হন। তৎকালীন সময়ে চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। পরবর্তীতে পটিয়ার রুহুল আলী বিদ্যালয় হতে মেট্রিক পাশ করেন তিনি। এরপর ধাপে ধাপে বেড়ে উঠে এই তরূন বাদশা মিয়া চৌধুরী। চারিত্রিক ও স্বভাবগত দিক দিয়ে বিবেচনা করলে বলতে হয় তিনি খুবই গম্ভীর ও প্রতিবাদী এবং বিপ্লবী মানসিকতার মানুষ । স্কুল জীবণের গন্ডি পেরিয়ে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলন। মেতে যায় দেশ ও জাতির অধিকার আদায়ে।
বাদশাহ মিয়া চৌধুরী স্বাধীন কক্সবাজারের এক অনন্য উপমা। যাকে ব্যাতি রেখে দক্ষিণ চট্টলার কোনো ইতিহাস রচনা করা যায় না। তার দীর্ঘ ৮৫ বছরের বর্ণাঢ্য জীবণে হাজারো অর্জন আর সফলতা। যার মধ্যে একটি বিশেষ সফলতার কারণে আজ অবধী স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে বেচে আছেন। তিনি দেশটাকে স্বাধীন করতে পেরেছেন। দেশ ও দশের অধিকার আদায় ও স্বাধীনতা অর্জনে তার অকৃত্তিম অবদান ইতিহাসকে আরো বেশি ঐতিহাসিক করেছে। ৫২ এর ভাষা আন্দোলন, ৬৯ এর গণভূথ্যাণ সহ ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে যার সক্রিয় ভূমিকা রয়েছে। যুদ্ধ পরবর্তী সময়কাল হতে উখিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাতা ও দীর্ঘ সময় ধরে সভাপতিত্ব করেছেন। তার হাত ধরেই উখিয়া উপজেলায় আওয়ামীলীগের জন্ম। যার অসীম সাহস ও মেধা এবং পরিশ্রমের ফসল হিসেবে আজ উখিয়া উপজেলা আওয়ামীলীগ একটি সুপ্রতিষ্ঠিত দল। একাধারে তিনি উখিয়ার হলদিয়া পালং ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা ও চার চার বারের নির্বাচিত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব ও পালন করে এসেছেন। একসূত্রে জানা যায় মরিচ্যার ইউনিয়ন পরিষদ ভবনটি নিজের ধান বিক্রি করে ঢাকায় গিয়ে বরাদ্দ নিয়ে এসেছিল তিনি।
শুরু হয় ৫২ এর ভাষা আন্দোলন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারী রাজধানী ঢাকায় রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে মিছিলে খুনি নুরুল আমিন গুলি করে ছাত্র হত্যার ঘটনার খবরটি ঐদিন রাতেই কক্সবাজারের জনগণের কানে পৌছায়। পরদিন ২২ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিনের মতো স্কুলে গেলে তার সহপাঠী ও বন্ধুদের সাথে আলাপ করে তাৎক্ষণিক ক্লাস বর্জন করে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে তরূন সেই বাদশাহ মিয়া ও তৎকালীন দশম শ্রেণিতে অধ্যয়নরত জাকারিয়ার নেতৃত্বে হাজারো ছাত্র জনতা এক হয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” স্লোগানে মিছিল সহকারে গিয়ে উখিয়া থানা ঘেরাও করে। পরক্ষণে থানার কর্মরত পুলিশ সদস্যরা আন্দোলনে সমর্থন দিলেও তা কার্যকর না করায় সেদিন বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা সকলে উখিয়া থানার সামনের দরজা লাথি মেরে ও লাঠি দিয়ে আঘাত করলে সেই দরজা ভেঙ্গে যায়। পরবর্তীতে সেই ভাঙ্গা দরজাটি ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি চিহ্ন হিসেবে বহাল রাখা হয়েছিল। এরপর সেদিন উখিয়া স্টেশনে জনতার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে বক্তব্য রাখেন তিনি। এইভাবে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে নেতৃত্ব দেন তিনি। ভাষা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখার কারণে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন কর্তৃক মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-২০১৮ এর সম্মাননা স্মারক ও পান তিনি।
কেবল ভাষা আন্দোলন করে তিনি থেমে যাননি। ৭১ এর স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষত দক্ষিণ চট্টগ্রাম অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর পাড় ধরে বাশখালী, রাঙ্গুনিয়া, পটিয়া, সাতকানিয়া, চকরিয়া, কক্সবাজার শহর তথা উখিয়া,টেকনাফ, শাহপরীর দ্বীপ, হ্নীলা, বান্দরবান, নাইক্ষ্যংছড়ি সহ তৎকালীন আরকান রাজ্য (মিয়ানমার) সীমান্ত এলাকা পর্যন্ত যুদ্ধ প্রস্তুতি, পরিকল্পনা, দলবদ্ধতা তৈরি ও সংগঠিত করার ক্ষেত্রে অপরিসীম ভূমিকা রেখেছিলেন বাদশাহ মিয়া চৌধুরী। তৎকালীন কক্সবাজার মহকূমা আওয়ামীলীগের সভাপতি আবছার কামাল চৌধুরী,উখিয়া-রামু-টেকনাফ আসনের এমপিএ ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী(বর্তমান কক্সবাজার-৩ আসনের এমপি সাইমুম সরওয়ার কমল এর পিতা),মহকূমা আওয়ামীলীগের কোষাধ্যক্ষ একেএম মোজাম্মেল হক, উখিয়ার শমশের উদ্দিন চৌধুরী,মনিরুক হক চৌধুরী,প্রফেসর মোস্তাক আহমদ,জুলফিখার আলী,সুনীল কৃষ্ণ,প্রবীর ভট্টাচার্য সহ প্রমুখ মিয়ানমার পালিয়ে গেলে সেখানে মিয়ানমার সরকারের প্রদত্ত আশ্রয় শিবিরে প্রায় ৫০ হাজার মুক্তিযুদ্ধের সংঘটক,মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষ অবস্থান করে। সেই সময়ে চট্টগ্রামের কালুর ঘাট যুদ্ধে আহত ক্যাপ্টেন হারূন আহমেদ চৌধুরী, বাদশা মিয়া চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করে তৎকালীন মেজর ইদ্রিস মোল্লার নেতৃত্বে ইপিআর এর ৯ জন ও বেঙ্গল রেজিমেন্টের কয়েকজন সদস্য এবং জহির লাল চৌধুরী,অজিত পাল সহ বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে একটি দল নাইক্ষংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম সীমান্ত হয়ে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করে।এসে প্রথমে তারা রামুর সোনাইছড়ি এলাকায় ক্যাম্প করে। পরবর্তীতে সেখান থেকে আরো কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের মিলিত হয়ে লামা থানায় অপারেশনে অংশ নেন। এরপর চুনতি,সাতকানিয়া,পুটিবিলা,আমিরাবাদ অঞ্চলের রাজাকার ও পাক হানাদারদের মুক্ত করে। তাদের সেই দলের এক সদস্য অজিত পাল হানাদারদের হাতে ধরা পড়লে তাকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে তারা বেচেঁ ফিরলে ১৪ ডিসেম্বর টেকনাফের রাজাকার বাহিনীদের দমন করেন তারা। মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের ক্ষেত্রে প্রতিবেশি দেশ মিয়ানমার সরকারের ভূমিকা ও রয়েছে এতে। সেই সময়ের বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক বিবৃতিতে মিয়ানমার সরকারকে আশ্রয়দানের জন্য ধন্যবাদ জানান তিনি। এইভাবে দেশ স্বাধীনের ঘোষণা দিলে কক্সবাজার তথা গোটা দক্ষিণ চট্টগ্রাম পাকশত্রু মুক্ত হয়।

এই বাদশা মিয়া চৌধুরীই জীবনের ৪৪ টি বছর ধরে বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে লালন করে হ্নদয়ে ধারণ করে আসছে। তিনি মূলত বঙ্গবন্ধুকে তার ভালবাসার জায়গা থেকে আজ অবধি মুজিব কোট পরিধান করে আসছে রীতিমতো। দীর্ঘ ৬১ বছর ধরে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। আওয়ামীলীগের দুঃসময়ে জেলার বিষেষ দায়িত্ব পালন করে পাশে থেকেছিলেন তিনি। আদর্শ,সততা ও উদারতার সাথে কাজ করেছেন আজীবন। অন্যায়কে কোনোদিন দেননি পশ্রয়। সমাজের কল্যাণে মসজিদ,কবরস্থান,চিকিৎসালয়,বিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দান করেছেন। তার অবদান কোনোদিন ভূলবে না কক্সবাজারবাসী।
ইতিহাসকে বিকৃত করে দুষ্টুচক্র ও সুবিধাবাদীরা আজ সকল ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। অথচ যে বাদশাহ মিয়া চৌধুরী কখনো দলীয় পদবী পাওয়ার লোভে রাজনীতি করেননি। তিনি রাজনীতি করেছিলেন দেশের নীতি নির্ধারন ও সংশোধনে। অর্থলোভ ছিল না কোনোদিন কেননা তার পিতৃসম্পদের অভাব ছিল না কোনোদিন। এমন সাদা মনের মাটির মানুষ আদৌ বাংলার বুকে বেচেঁ আছে বলেই বাঙ্গালীর ইতিহাস এতো অমলিন।