জাগো নিউজঃ
কক্সবাজার সদরের খ্যাতনামা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ঈদগাহ আদর্শ শিক্ষা নিকেতন (কেজি স্কুল)। নব্বই দশকে প্রতিষ্ঠার পর পাসের হার বাড়ায় এটি অভিভাবকদের কাছে অন্যতম নির্ভরযোগ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছে। বেড়েছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এ সফলতা কাজে লাগিয়ে এক যুগ ধরে অনৈতিকতভাবে সভাপতির পদ আঁকড়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামরুল হক চৌধুরী নানা অপকর্ম চালাচ্ছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
তিনি শিক্ষক-কর্মচারী নিয়োগে প্রকাশ্য ঘুষের লেনদেনও করছেন। মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করে টেন্ডার ছাড়াই কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ করছেন। ম্যানেজিং কমিটিতে স্ত্রী, সম্বন্ধীসহ স্বজন ও নিজের লোকজনকে স্থান দিয়ে অপকর্ম অব্যাহত রেখেছেন। এসব বিষয় উল্লেখ করে গত ২ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন মোহাম্মদ জুনায়েদ কবির নামে বিদ্যালয়টির প্রাক্তন এক শিক্ষার্থী। তিনি স্থানীয় ঈদগাঁও কলেজগেট এলাকার ডা. মোহাম্মদ আলমের ছেলে।
অভিযোগের অনুলিপি শিক্ষামন্ত্রী, উপমন্ত্রী, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান, চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা), জেলা শিক্ষা অফিসারসহ প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরে পাঠানো হয়েছে।
অভিযোগে মোহাম্মদ জুনায়েদ কবির উল্লেখ করেছেন, অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও হোমিও চিকিৎিসক মোহাম্মদ আলম স্থানীয় শিক্ষানুরাগীদের নিয়ে ১৯৮৬ সালে স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। বাসস্টেশন এলাকায় পছন্দ করা জমির কিছু অংশের দাতা ছিলেন কামরুল হক চৌধুরী। তিনিও শুরু থেকে পরিচালনা কমিটিতে দাতা সদস্য হিসেবে রয়েছেন। সবার চেষ্টায় নব্বই দশকে স্কুলটি পাঠদানে সেরা হিসেবে জেলায় সুনাম ছড়ায়। বাড়তে থাকে শিক্ষার্থী সংখ্যা।
আয় ও অন্যান্য সুবিধা বাড়ায় কর্মহীন কামরুল হক চৌধুরী স্কুল আঙ্গিনায় সারাদিন সময় দিয়ে ডা. মোহাম্মদ আলমসহ অন্য প্রতিষ্ঠাতাদের কৌশলে সরিয়ে সব কিছু নিজের দখলে নেন। ম্যানেজিং কমিটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে শ্বশুর, সম্বন্ধী, স্ত্রী ও অন্য স্বজনদের সম্পৃক্ত করেন স্কুলে। হাত করেন বিদ্যালয়ের সুবিধাভোগী কিছু শিক্ষককেও। এরপর থেকে বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ম্যানেজিং কমিটি নির্বাচনের তফসিল নিজেদের ভেতর সীমাবদ্ধ রেখে তিনি ও প্রধান শিক্ষক অনুগতদের নিয়ে সংগোপনে পছন্দের কমিটি গঠন করেন। ফলে প্রকৃত অভিভাবকরা তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ থেকে বঞ্চিত হয়ে আসছেন।
এ অভিযোগের সত্যতা মেলে ঈদগাঁও কলেজ গেট এলাকার সেলিম রেজা নামে এক অভিভাবকের কথায়। তিনি বলেন, ২০০৩ সাল থেকে এ বিদ্যালয়ে পড়ে ২০১৪ সালে এসএসসি পাস করা তার প্রথম সন্তান এখন অনার্সে পড়ে। ২০১৮ সালে পাস করে দ্বিতীয় সন্তান এখন উচ্চ মাধ্যমিকে পড়ছে। তৃতীয় সন্তান এখনও পড়ছে নবম শ্রেণিতে। দীর্ঘ এ সময়ে কোনো দিনই ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচন সম্পর্কে জানানো হয়নি।
একই কথা বলেন অভিভাবক ভাদিতলার আলী হোসাইন, পালাকাটার মুজিবুর রহমান, মেহেরঘোনার আলী আকবর, পাহাশিয়াখারীর বজলুর রশীদসহ অনেকে।
মোহাম্মদ জুনায়েদ কবির আরও উল্লেখ করেন, বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক ছালেহা আকতারকে নিয়োগ দেয়ার বিনিময়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামরুল হক চৌধুরী পৃথকভাবে ২ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। ফাস্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, ঈদগাঁও শাখার ছালেহা আকতারের ১৫১-১২২-০০০০৮৮০১ হিসাবের বিপরীতে ২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর ২৭৭৩৪৫৪ নম্বর ও একই বছরের ৮ নভেম্বর প্রদেয় ২৭৭৩৪৫৫ নম্বর চেকে সভাপতির স্ত্রী ম্যানেজিং কমিটির দাতা সদস্য সেলিনা আকতারের একই ব্যাংকের ১২২-৪-১ নম্বর হিসাবে পৃথকভাবে ২ লাখ টাকা নেন। সহকারী গ্রন্থাগারিকের (ছালেহা আকতার) ব্যাংক বিবরণীতে তা স্পষ্ট।
ঘুষের টাকা পেয়ে ২০১৫ সালের ২৬ জুলাই প্রথম আলো পত্রিকায় প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের বিপরীতে ছালেহা আকতারকে একই বছর ২১ নভেম্বর নিয়োগপত্র দেয় বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এ বিজ্ঞাপনের বিপরীতে আবেদনের শেষ তারিখ ছিল ২০১৫ সালের ১০ আগস্ট। কিন্তু ছালেহা আকতার গ্রন্থাগার ডিপ্লোমা পাস করেন ওই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর। এত তার আবেদনই ছিল অবৈধ। এরপরও নিয়োগপত্র দেয়ার বিষয়টি মাউশির চট্টগ্রামের ডিডির কাছে ধরা পড়ায় বাতিল করা হয় প্রথম নিয়োগ। পরবর্তীতে ২০১৬ সালের ২৭ মার্চ একই পত্রিকায় দ্বিতীয় বিজ্ঞাপন দিয়ে ২৫ এপ্রিল পরীক্ষা দেখিয়ে ৩০ এপ্রিল ছালেহাকেই নিয়োগপত্র দেয়া হয় এবং তিনি ওই বছরের ৩ মে কর্মস্থলে যোগ দেন।
শুধু ছালেহা নয়, অন্যান্য আরও অনেক শিক্ষকের কাছ থেকে অনুদান হিসেবে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। তবে ছালেহার মতো চেকে কারও কাছ থেকে এভাবে টাকা নেননি সভাপতি। আর চাকরি সমস্যাসহ প্রতিষ্ঠানে কোণঠাসা হওয়ার ভয়ে কেউ বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেন না। এছাড়াও বিদ্যালয়ের খন্ডকালীন শিক্ষক নিয়োগেও তিনি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন ও পরীক্ষা ছাড়াই নিজের পছন্দের লোকদের নিয়োগ দিয়ে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।
এসবের পাশাপাশি বিগত একযুগ ধরে বিদ্যালয়ের উন্নয়ন কার্যক্রমে প্রায় কোটি টাকা ব্যয় হলেও তিনি কখনো টেন্ডার আহ্বান করেননি। এমনকি বিদ্যালয়ের ভবন সম্প্রসারণে এককালীন ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করা হলেও বিনা টেন্ডারে নিজের তত্ত্বাবধানে কাজ করে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বর্তমানেও বিদ্যালয়ের ভবন সংস্কারে প্রায় ১০ লাখ টাকার কাজ বিনা টেন্ডারে চলছে। অডিট কার্যক্রম যথাযথ তদারক করলে তা প্রমাণ হবে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
সহকারী গ্রন্থাগারিক ছালেহার নিয়োগে ঘুষ নেয়ার বিষয়ে বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতি কামরুল হক চৌধুরী বলেন, নিয়োগের বিনিময়ে ছালেহা স্কুলে কিছু বেঞ্চ সরবরাহ দিয়েছিলেন বলে জানি। নগদ টাকা নেয়ার কথা নয়।
দাতা সদস্য (সভাপতির স্ত্রী) সেলিনা আকতারের অ্যাকাউন্টে পৃথকভাবে ছালেহার অ্যাকাউন্ট থেকে ২ লাখ টাকা হস্তান্তর হওয়ার বিষয়ে জানালে তিনি উল্টো প্রশ্ন করে বলেন, এমনটি হয়েছে নাকি? এটি সাংবাদিকের কাছে কেমন করে এলো? আর এটাতো কয়েক বছর আগের ঘটনা। এসব নিয়ে এখন তদন্ত করার প্রয়োজন কি? বিষয়টি আমার ঠিক মনে পড়ছে না। খবর নিয়ে জেনে বলতে হবে।
বিনা টেন্ডারে উন্নয়ন কাজ করার বিষয়টি স্বীকার করে কামরুল হক চৌধুরী বলেন বলেন, বিদ্যালয় ফান্ডের টাকায় আমরা তিনতলা একটি ভবন করেছি। সরকারি একতলা একটি ভবনের ওপরে সম্প্রসারণ করে আরও দুই তলা তুলেছি। টেন্ডার দিলে অনেক ধরণের ঝামেলা হয়। তাই উন্নয়ন কাজ হিসেবে ম্যানেজিং কমিটি আলাদা উন্নয়ন কমিটি করে নিজেরাই ভবন তৈরি করেছি।
উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালাতে সরকারের বেঁধে দেয়া নিয়মনীতির বিষয়ে তিনি বলেন, সব দিক লিয়াজু করলে কোনো কথা ওঠে না, এখন নিজেরা করেছি বলেই এত কথা আসছে। এসব বিষয়ে মাউশি থেকে তদন্ত দল এসে ঘুরে গেছে। তারা বেশ কয়েক বছরের অডিট রিপোর্ট চেয়েছে। ভবিষ্যতে টেন্ডারহীন কাজ না করতে সতর্ক করে দিয়ে চলে গেছে। এ নিয়েতো আর কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়।
অভিযোগকারী মোহাম্মদ জুনায়েদ কবির বলেন, শিক্ষা নিয়ে এমন বাণিজ্য শিক্ষার্থীদের মাঝে নৈতিকতার শিক্ষা ছড়াবে না। এলাকার সবাই বিষয়টি অনুধাবন করলেও হয়রানির ভয়ে কেউ মুখ খোলেন না। আমি একবার বলতে গিয়ে নিগৃহীত হয়েছি। সভাপতি স্ত্রীকে দাতা সদস্য বানিয়েছেন। এখন অন্য কাউকে দাতা সদস্য হওয়ার সুযোগ দিচ্ছেন না। দাতা সদস্য হতে অনেকের আবেদন ম্যানেজিং কমিটির সভায় উপস্থাপন পর্যন্ত করেন না তিনি। উল্টো মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে হয়রানি করেন। এ রকম একটি মামলা থেকে সম্প্রতি খালাস পেয়েছি আমি।
যোগাযোগ করা হলে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের (মাউশি) মহাপরিচালক প্রফেসর ড. মো. গোলাম ফারুক বলেন, অভিযোগ পেয়েছি। তদন্ত করে সত্যতা পেলে বিধিমতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।