মুহাম্মদ শামসুল ইসলাম সাদিক

অমর একুশ বাঙালির ইতিহাসে শুধু একটি তারিখ নয়; একুশ হলো একটি চেতনার বীজমন্ত্র। একুশকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তায় যে চেতনার জন্ম হয়েছিল, তা ছিল এক অবিনাশী চেতনা। এই চেতনার পথ ধরে ছেষট্টির ছয় দফা, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান ও সত্তোরের নির্বাচন এবং ১৯৭১-এ আমরা পেয়েছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এই গর্বের একুশ হয়েছে আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মৃতি-চিহ্নিত এই দিনটি সংগ্রামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির এক গৌরবোউজ্জ্বল ইতিহাস। একুশে ফেব্রুয়ারি হলো বাঙালি জাতির পরিচয়চিহ্ন। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ধারায় নিরন্তর গতিময়, প্রাণবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ ফেব্রুয়ারি ভাষার মাস হিসেবে সমগ্র বিশ্বের নিকট আজ পরিচিত। এই মাসে চেতনায় এবং শ্রদ্ধায় অবনত হয় সমগ্র জাতি ও বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ এবং ভাষাপ্রেমীরা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে একুশের চেতনার জন্ম। পাকিস্তানিদের দ্বারা পরিচালিত এই রাষ্ট্রে সমতা ও ন্যায় নেই; পরিবর্তে আমাদের বাঙালিদের জন্য আছে সীমাহীন শোষণ, লাঞ্ছনা, বঞ্চনা ও অপমান। সর্বোপরি সব ক্ষেত্রে এক উৎকট বৈষম্য প্রকট হয়ে উঠল। জাতিগত, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশের সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় ১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনগণের অস্তিত্ব ও ভাগ্যকে জুড়ে দেয়া হয়েছিল কৃত্রিম ও সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের সঙ্গে। সে সময় পাকিস্তানে শতকরা ৫৬ জনের মুখের ভাষা বাংলা হলেও শতকরা ৭ জনের মুখের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। ১৯৪৮ সালে উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়া হয়। ঠিক তখন বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে বিক্ষোভ প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পূর্ব বাংলার দামাল ছেলেরা। ভাষার প্রতি বাঙালির চিরঞ্জীব ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫১ সালের মধ্যে ক্রমান্বয়ে জোরালো হয়ে ওঠে বাংলা ভাষার মর্যাদা আদায়ের দাবি। একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন এই বৈষম্য আর অপমানের বিরুদ্ধে বাঙালির প্রথম সরব জবাব।
একুশ কেবল বাংলা ভাষার লড়াই ছিল না। একুশ ছিল বাঙালির সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার সেই লড়াইয়ের সঙ্গে ওতপ্রোথভাবে জড়িয়ে ছিল শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতির লড়াইও। একুশ ছিল বাঙালির এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। আজ পৃথিবীব্যাপী এ দিনটি পালিত হচ্ছে মাতৃভাষার চর্চা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার চেতনায়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আমরা এক অকৃত্রিম আবেগের সৌধ নির্মাণ করেছি। যার সঙ্গে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও জাতিচেতনামূলক আন্দোলনের চালিকাকেন্দ্র হয়ে আছে সর্বত্র। প্রতিটি গণআন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সেদিন পূর্ব বাংলার অধিকার-বঞ্চিত মানুষের প্রথম সংগঠিত সংগ্রামের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল। জাতিগত শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগঠিত হতে একুশ আমাদের উদ্বুদ্ধ করেছে। পরবর্তীকালে প্রতিটি গণআন্দোলনের প্রেরণাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ওই আন্দোলন। একুশের পথ ধরেই আমরা বারবার পেরিয়ে এসেছি সংকটের নানা আবর্ত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বীজমন্ত্র পেয়েছি মহান ভাষা আন্দোলন থেকে। আমাদের জাতীয় ইতিহাসে এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির চেতনার বিকাশে একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির জাতিসত্তার স্বরূপ আবিষ্কার করে। ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি?’। এ গান আমাদের সাংস্কৃতিক চেতনার বিকাশে উজ্জীবনী মন্ত্র । ১৯৫৩ সাল থেকে শহীদ দিবসে কালো পতাকা উত্তোলন, নগ্নপদে প্রভাতফেরি, শহীদের কবরে ও শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রভাতফেরিতে সমবেত কণ্ঠে একুশের গান পরিবেশন, শহীদ মিনারে আল্পনা আঁকা বাঙালির জাতীয় চেতনার নবজাগরণের প্রতীক হয়ে উঠেছে। এখন এসব আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অঙ্গ। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় একুশের চেতনা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ইতিহাসে দেখা যায়, রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পেলেও পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষাকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল। ১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে তারা বাংলা ভাষার বিকৃতি ঘটানোর নানা অপপ্রয়াসে লিপ্ত থাকে। বাংলা ও উর্দু মিলিয়ে একটা নতুন ভাষা তৈরি করা, বাংলা বর্ণমালা তুলে রোমান হরফে বাংলা প্রবর্তন করে ইত্যাদি। তাদের হীন পদক্ষেপ ও অপতৎপরতার বিরুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে ১৯৫৫ সালে বাংলাদেশের জাতীয় বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা। বাংলা ভাষা, বাংলা সাহিত্য ও বাঙালি সংস্কৃতির চর্চা, গবেষণা ও বিকাশে এ প্রতিষ্ঠানের অবদান অসামান্য।
বাঙালির একুশের চেতনার বিশেষ দিক ছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রচার-প্রসার। শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী-পুরুষ বাংলা ভাষায় পান্ডিত্য অর্জন করবে; প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহৃত হবে। দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার প্রচলন হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, গণপ্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা ‘বাংলা’। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। বরং অনেক ক্ষেত্রে বাঙালির হাতেই বাংলা ভাষা উপেক্ষার শিকার। শিক্ষাঙ্গনে ও অফিস-আদালতে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, গণমাধ্যম ও বিজ্ঞাপনে ইংরেজি ভাষার দখলদারি ব্যাপক হারে আজ পরিলক্ষিত। আজ আমাদের দেশে ইংরেজি মাধ্যম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বৃদ্ধি পাচ্ছে ফলে বাংলার গুরুত্ব ক্রমেই কমছে। অন্যদিকে বিশ্বায়নের প্রভাবে আমাদের মানসিকতায় বিদেশিয়ানার প্রভাব দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণে বিদেশি ভাষার আশ্রয় নেয়ার, বিয়ে বা জন্মদিনের আমন্ত্রণপত্রে বিদেশি ভাষার ব্যবহার, দৈনন্দিন কাজর্কমে, কথা-বার্তায় বিদেশি ভাষা ব্যবহার, বিজ্ঞাপন ও বিজ্ঞপ্তিফলকে বিদেশি ভাষাকে অনেক গুরুত্ব দেয়া। অনেকেই আমরা ভুলেগেছি যে, সামাজিক-অর্থনৈতিক উন্নতির সঙ্গে মাতৃভাষার উন্নতির রয়েছে অবিচ্ছেদ্য যোগসূত্র। সম্ভবত সেই কারণেই এ জায়গাটিতে আমাদের পিছুটান ক্রমেই প্রকট হচ্ছে। অনেকেই আমরা ভুলতে বসেছি, বাঙালির পরিচয়ের মূলভিত্তি তার ভাষা। অথচ বাংলা ভাষা যথাযথ গুরুত্ব না পেলে তার শক্তি একদিন ক্রমশ দুর্বল হয়ে যাবে।
একুশের চেতনাই আমাদের সকল যড়যন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের প্রেরণা। আমাদের অগ্রযাত্রার মূল মন্ত্র ২৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষার ওপর আস্থা স্থাপন করেই বলি: ভাষা আন্দোলনের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর আমাদের ইতিহাসের একটি রক্ত-রঙিন দিন নয়, এ দিন এখন পেয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি। একুশ আমাদের অহংকার; আমাদের জন্য গৌরব ও প্রেরণা। একুশের তাৎপর্যকে ধারণ করতে হলে ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা আধিপত্যবাদবিরোধী চেতনা ও শক্তির দিকে আমাদের ফিরে তাকাতেই হবে। সেখানেই আমাদের মুক্তি নিহিত। যা এ অর্জন বাংলাদেশের মানচিত্রকে উজ্জ্বল করেছে বিশ্ব মানচিত্রে।

লেখক: প্রাবন্ধিক