বিবিসি বাংলা:
বিশ্ব জুড়ে জ্যোতির্বিদরা তা সে অ্যামেচার কিংবা পেশাদার যেই হোন না কেন, আকাশের দিকে নজর রেখেছেন “জীবনে একবার আসে এমন একটি মুহূর্তের” সাক্ষী হওয়ার জন্য।
তারা ধারণা করছেন, বেটেলজাস যেটি কিনা পৃথিবী থেকে দেখা যায় এমন উজ্জ্বলতম নক্ষত্রগুলোর একটি হয়তো সুপারনোভায় পরিণত হতে যাচ্ছে, আর এটা হতে যাচ্ছে ধারণা করা সময়ের চেয়ে অনেক আগেই।
সহজ ভাষায় বলতে গেলে: বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে।
যদিও জ্যোতির্বিদরা জানেন যে, বেটেলজাস ধীরে ধীরে “বিস্ফোরিত” হবে, কিন্তু সম্প্রতি হওয়া কিছু পরিবর্তন তাদের মনে প্রশ্নের উদ্রেক করেছে।
বিজ্ঞানীরা কেন মনে করেন যে বেটেলজাস বিস্ফোরিত হবে?
বেটেলজাসকে এরইমধ্যে “ধ্বংসের মুখে থাকা নক্ষত্র” হিসেবে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে যার বিস্ফোরণ এখন সময়ে ব্যাপার মাত্র।
আমাদের সূর্য যা প্রায় ৪ দশমিক ৫ বিলিয়ন বছর বয়সী-তার তুলনায় এই তারাটির বয়স মাত্র ৮০ লাখ থেকে এক কোটি বছর। কিন্তু এটি এর পারমানবিক জ্বালানি দ্রুত মাত্রায় ব্যয় করে ফেলছে।
এটি হচ্ছে লাল একটি সুপার জায়ান্ট, একটি তারা যার আয়ু প্রায় শেষের পথে, কিন্তু এর আকার যথেষ্ট প্রসারিত হয়েছে।
বেটেলজাস একটি বিশালাকার স্পন্দিত নক্ষত্র অর্থাৎ এটি একইসাথে প্রসারিত এবং সংকুচিত হয়- এই ‘প্রতিবেশী’র পরিসীমা সূর্যের চেয়ে ৫৫০ থেকে ৯২০ গুন বেশি হতে পারে।
“এর সম্পর্কে যা জানা যায় তা হচ্ছে এটির সুপারনোভায় পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে,” বিবিসিকে একথা বলেন নটিংহাম ট্রেন্ট ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক ড্যানিয়েল ব্রাউন।
“এর বর্তমান অবস্থা থেকে এটা বোঝা যায় যে, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সময়ের হিসাবে এটি যেকোনো সময় ঘটতে পারে।”
“কিন্তু এটার অর্থ হচ্ছে এটা আগামী এক লাখ বছরেও হতে পারে,” ব্রাউন বলেন।
তার মানে এটি শিগগিরই সুপারনোভায় পরিণত হচ্ছে না?
যাই হোক, গত কয়েক মাসে জ্যোতির্বিদরা লক্ষ্য করেছেন যে, বেটেলজাস ধীরে ধীরে অনুজ্জ্বল তারায় পরিণত হচ্ছে- যুক্তরাষ্ট্রের ভিলানোভা ইউনিভার্সিটির গবেষকরা গত ডিসেম্বরে দাবি করেছেন যে, তারাটি ৫০ বছর ধরে পর্যবেক্ষণ সময়ের মধ্যে সবচেয়ে অনুজ্জ্বল পর্যায়ে পৌঁছেছে।
উল্লেখযোগ্য হারে উজ্জ্বলতা হারানো থেকে ধারণা করা হচ্ছে যে, এই রেড জায়ান্টটি “বিস্ফোরিত হতে যাচ্ছে।”
বিজ্ঞানীরা তাত্ত্বিকভাবে বলেছেন যে, এতো বেশি মাত্রায় উজ্জ্বলতা হারানোর মানে হচ্ছে যে একটি তারার সময় ফুরিয়ে এসেছে।
“আয়ুষ্কাল শেষ হয়ে আসলে বিশালাকার নক্ষত্রও তাদের ব্যাপক হারে ভরশূন্য হয়ে পড়ে,” টুইটারে এমনটা লেখেন ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যোতির্বিদ এবং বেটেলজাসের গবেষক সারাফিনা ন্যান্স।
“তাত্ত্বিকভাবে বলা যায় যে, সুপারনোভায় পরিণত হওয়ার আগে আগে নক্ষত্রটি থেকে ছড়িয়ে পড়া ধুলা মৃতপ্রায় নক্ষত্রটিকে আবৃত করে এটিকে অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলতে পারে, যার কারণে এটি আমাদের দৃষ্টিসীমা থেকে হারিয়ে যেতে পারে।”
যাই হোক, বিজ্ঞানীরা ভাল করেই জানেন যে, বেটেলজাস একটি পরিবর্তনশীল নক্ষত্র।
ইউনিভার্সিটি অব ইয়র্কের অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্ট এমিলি ব্রান্ডসেন বিবিসিকে বলেন, এটি এমন একটি তারা যেটি পৃথিবী থেকে যে উজ্জ্বলতা দেখা যায় তা পরিবর্তন করে।
“বেটেলজাসের বিস্ফোরণ আসন্ন এমনটা নির্দেশ করার মতো কিছুই নেই। সুপারনোভার প্রক্রিয়া কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করার সুযোগ আমাদের কখনোই হয়নি, তাই বলা যায়, এটি(হঠাৎ বিস্ফোরণ) যেকোনো সময়েই হতে পারে,”ব্রান্ডসেন বলেন।
বিস্ফোরণে কী হবে?
সুপারনোভা একটি শক্তিশালী এবং উজ্জ্বল বিস্ফোরণ যাতে বিপুল পরিমাণ শক্তি নির্গত হয়।
এটা অগোচরে হওয়ার কোন সুযোগ নেই, বিশেষ করে পৃথিবীর এতো “কাছে” হওয়ার পরও।
“কিছু দিনের মধ্যে বেটেলজাস আবার পূর্ণিমার চাঁদের মতো উজ্জ্বল দেখাবে,” ব্রাউন বলেন।
“এমনকি এটা দিনের বেলায়ও দেখা যাবে।”
এটা কয়েক মাস ধরে চলতে পারে।
তাহলে…আমরা কি বিপদে আছি?
সুপারনোভা ব্যাপক হারে বিধ্বোংসী।
উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি আমাদের সূর্য বিস্ফোরিত হয়, জ্যোতির্বিদরা বলেন, তাহলে পুরো সৌরজগৎ ধ্বংস হয়ে যাবে।
এর আগের নক্ষত্রের বিস্ফোরণের কারণে পৃথিবীর তাপমাত্রা বেড়েছিল এবং সেটা আমাদের ওজন স্তরে ক্ষতি করেছিল এবং এটাকে ক্ষতিকর সৌর এবং মহাজাগতিক বিকিরণের মুখে ফেলেছিল।
ভাল খবর হচ্ছে, বেটেলজাসের মতো বিস্ফোরণ হওয়ার জন্য আমাদের সূর্য আকারে খুব ছোট- যদিও পূর্বাভাস রয়েছে যে, কয়েক বিলিয়ন বছরের মধ্যে এটি আয়তনে বেড়ে যেতে পারে এবং বুধ, শুক্র এবং পৃথিবীকে ধ্বংস করে ফেলতে পারে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, বিজ্ঞানের মতে, বেটেলজাস থেকে পৃথিবী নিরাপদ দূরত্বে রয়েছে।
“৫০ আলোকবর্ষ থেকে কম দূরত্বে থাকা সব কিছুই সমস্যা সৃষ্টি করতে পারে,” ড্যানিয়েল ব্রাউন বলেন।
“বেটেলজাসের ক্ষেত্রে বিষয়টি এরকম নয়।”
নক্ষত্রটি কালপুরুষ নক্ষত্রমণ্ডলে অবস্থিত এবং পৃথিবী থেকে প্রায় ৭০০ আলোকবর্ষ দূরে।
এছাড়া, ২০১৬ সালে অ্যাস্ট্রোফিজিক্যাল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় বলা হয় যে, শকওয়েব এবং ধ্বংস্তুপ সৌর জগতে পৌঁছাতে ৬০ লাখ বছর লাগবে।
বেটেলজাস সুপারনোভা কি আসলেই এতো গুরুত্বপূর্ণ?
আমাদের ছায়াপথ অর্থাৎ মিল্কিওয়ে-তে সবশেষ সুপারনোভা হয়েছিল ১৬০৪ সালে- এটি হয়েছিল পৃথিবী থেকে ১৩০০০ আলোকবর্ষ দূরে, দূরত্বের হিসাবে যা বেটেলজাসের তুলনায় ২০ গুণ বেশি।
জার্মান জ্যোতির্বিদ ইয়োহানেস কেপলার এটিকে নথিবদ্ধ করার কারণে এটি কেপলারের সুপারনোভা নামে পরিচিতি পায়।
অতি সম্প্রতি যেটি খালি চোখে দেখা গিয়েছিল সেটি হচ্ছে ১৯৮৭এ, এটি প্রতিবেশী বামন ছায়াপথ যা বৃহৎ ম্যাজেলানিক ক্লাউড নামে পরিচিত সেখানে ঘটেছিল-এটি ১৬৮,০০০ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত।
এতো বেশি দূরত্ব হওয়া সত্ত্বেও কেপলারের পর এটি ছিল সবচেয়ে কাছের সুপারনোভা।
এমিলি ব্রান্ডসেন বলেন, “একটি তারার মৃত্যুর বিবর্তন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সম্পর্কে আমাদের আরো বেশি বোঝার সুযোগ করে দিচ্ছে বেটেলজাস। ”
“এটা যদি এখন বিস্ফোরিত হয় তাহলে এটি হবে সব জ্যোতির্বিদের জন্য কাজের ক্ষেত্রে একটা দুঃস্বপ্নের মতো কারণ তাহলে নক্ষত্র সম্পর্কে আমরা কী জানি তা আবার নতুন করে ভাবতে হবে।”
“কিন্তু অন্যদিকে এটা আবার আকর্ষণীয় একটি ঘটনাও হবে।”
এটা কখন সুপারনোভায় পরিণত হবে তা জানা এতো কঠিন কেন?
যদি ‘নক্ষত্রের মৃত্যু’র ঘটনা এর আগে নথিবদ্ধ এবং পর্যবেক্ষণ করার ইতিহাস আমাদের রয়েছে, কিন্তু এটি কখনোই নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়নি।
এমন পরিস্থিতিতে বেটেলজাস আসলো।
যদিও বেটেলজাসের দূরত্ব ৭০০ আলোকবর্ষ, তবুও জ্যোতির্বিজ্ঞানের দিক থেকে দেখতে গেলে এটিকে মিল্কিওয়ের প্রতিবেশী বলা যায়।
এই নৈকট্য সূর্য ছাড়া হাতে গোনা অন্য তারাগুলোর মধ্যে একটি যার ভূ-পৃষ্ঠ বিস্তৃতভাবে পর্যবেক্ষণ করা যায়।
এভাবেই, বেটেলজাস সুপারনোভা বিজ্ঞানকে একটি মূল্যবান সুযোগ তৈরি করে দিতে পারে
“কাছাকাছি এবং ব্যক্তিগত”র ধারণা বা ফেনোমেনা সম্পর্কে গবেষণা করার।
“এটা স্টারগেজার বা যারা নক্ষত্র দেখেন তাদের জন্যও চোখ ধাঁধানো প্রদর্শনী হতে পারে।”
আমরা সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।