আতিকুর রহমান মানিক

কাউয়া টাইম অর্থাৎ কাকডাকা ভোরেই নিত্যদিন ঘুম থেকে উঠার অভ্যাস কেরামত আলীর। সুবহে সাদিকের সময় চারদিক থেকে ফজরের আজানে মুখরিত পবিত্র পরিবেশ, দীঘল রাতের শেষে নতুন একটি দিনের শুরুতে আলো-অাধাঁরীর খেলা, ভোরের পাখিদের কল-কাকলী, পূবাকাশে উষার রাঙ্গা ঝলক ও সবশেষে নতুন সূর্যোদয়। এসব যেন অপার্থিব মনে হয় তার কাছে। বিনা পয়সায় উপভোগ করার মত এমন সুন্দর জিনিস পৃথিবীতে আর নেই বললেই চলে। তাই এসব মিস করেনা সে।

তো আজ সকালের কথা, প্রতিদিনকার মত মর্নিং ওয়ার্ক সেরে বাসায় এসে হালকা নাস্তা ও কিছুক্ষন বিশ্রাম নিয়ে বাজার করার উদ্যেশ্যে বের হল কেরামত। হোম মিনিষ্টার কর্তৃক প্রণীত বাজারের ফর্দ মনোযোগ দিয়ে পড়ে দেখল, হালের ভিআইপি জিনিস পিঁয়াজ নেই। “শুকর আল হামদুলিল্লাহ” মনে মনে বলল কেরামত। পরক্ষনেই মনে পড়ল গতকালই এক কেজি পিঁয়াজ এনেছে সে। মাগার দাম পড়েছে ডাবল সেঞ্চুরিরও উপরে।

বাজারে গিয়ে দেখল, চালের দামও কিছুটা বাড়তি। তবে এতদিনের দাপুটে ডিমের তেল একটু কমেছে দেখতে পেল সে। তাও প্রতিটি ডিম মাত্র ৭ / ৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্র উপকূলীয় ঘেরে উৎপাদিত মাছ বাজারে বেশী আসা ও গত কয়েক বছরে দেশে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মাছের দাম একটু কম ।

যাই হোক, বাজার করে বাসায় যাওয়ার পথে একাধিক মাইকের চিল্লাফাল্লায় তার কান ঝালাপালা হওয়ার যোগাড়। নির্বাচনী মিটিং ও রাজনৈতিক সমাবেশগুলো সাধারনতঃ বিকেলেই হয়, তাহলে সাত-সকালে এরকম চিল্লাফাল্লা কেন ? ব্যানার-ফেস্টুন শোভিত শোভাযাত্রাও দেখতে পেল কেরামত।

একটা ব্যানারে লেখা পড়ে দেখল, আজ নাকি বিশ্ব মানবাধিকার দিবস। মানবাধিকার নিয়ে তাই আজ শহরের বিভিন্ন পয়েন্টে বক্তারা চিল্লিয়ে গলা শুকিয়ে ফেলার যোগাড়। মানবাধিকার লঙ্ঘন হলে খাইয়া ফালামু, মাইরা ফালামু টাইপ চিল্লাচিল্লিও করলেন কয়েকজন বক্তা !

বিভিন্ন স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীরাও এসেছে। কয়েকডজন মাইক, শতাধিক বক্তা, ব্যানার-ফেস্টুন, টি-শার্ট, ক্যাপ ইত্যাদির বাহার দেখে থ বনে গেল কেরামত। গলায়-কোমরে-মাথায় কার্ড ঝুলানো মানবাধিকার ওয়ালাদের ভীড় ক্রমশঃ বাড়তে লাগল। বেলা গড়াবার সাথে সাথে বাহারী নামের মানবাধিকার সংস্হার ব্যানারের আমদানীও বাড়ছিল।

অমুক মানবাধিকার সংস্হা, তমুক মানবাধিকার সোসাইটি, সমুক পরিষদ মিলিয়ে বাহারী নামের সমাহার ও সাথে ডজনাধিক মাইকের বেশুমার চিল্লানি। মানবাধিকার নিয়ে এদের মুখে ফেনা তোলার যোগাড় দেখে কেরামত ভিমরি খাওয়ার জোগাড়। এরপর নাকি মানবাধিকার শোভাযাত্রাও হবে, মিটিং হবে, আলোচনা হবে। অবস্হা দেখে আজ শহরের পাড়া-মহল্লায় মানবাধিকারের হাট বসছে মনে করল কেরামত আলী।

এদের মানবাধিকার আজ শুধু একদিন নাকি ? মনে মনে বলল কেরামত।
অথচ সারাবছর বিভিন্ন স্হানে মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, এ নিয়ে এদের কোন মাথাব্যাথা নেই। কেবল বছরের একটি দিনে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মানবাধিকারের পাইকারী বাজার বসানো কেন ? আজকাল নাকি ভূঁইফোড় বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্হা রাতারাতি গজিয়ে উঠেছে। বিভিন্ন এলাকায় কমিটি দেয়ার নামে জমজমাট মানবাধিকার বাণিজ্যের পাইকারী ও খুচরা দোকান চালু হয়েছে। নির্দিষ্ট অংকের টাকার বিনিময়ে মানবাধিকার সংস্হার কার্ড নাকি আকছারই বিক্রি হচ্ছে।

চোর-ডাকাত, দাগী অপরাধী, ভূমিদস্যু, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও সমাজের নিকৃষ্ট কীটগন এই মানবাধিকার কার্ড নামের লাইসেন্স কিনে সবখানে প্রভাব খাটাচ্ছে। থানায় বিচার-শালিশ বানিজ্য, মাদক করাবার, দখলবাজি, সরকারী বিভিন্ন দপ্তরে তদবীর বাণিজ্য ও হুমকি দিয়ে টাকা আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধে নাকি এই মানবাধিকার ফেরিওয়ালারা জড়িত। এসবই মনে করছিল কেরামত আলী। আবার কিছু কিছু মানবাধিকার সংস্হা নাকি বিচার-শালিসে হাজির হওয়ার জন্য নোটিশ পাঠায়। নোটিশ পেয়ে ইস্পিত ব্যাক্তি উপস্হিত হলে ধমক-হুমকি দিয়ে টাকা-পয়সা হাতিয়ে নেয়। কয়েকমাস আগের কথা। এক মানবাধিকার ঠিকাদার আদালতে ব্যবহার্য সমন প্রেরন করে সালিশে হাজির হওয়ার হুকুম দিয়েছিল। সেই সমন পরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছিল।

এরকম একটি অভিজ্ঞতা কেরামত আলীরও রয়েছে। ২০১৫ সালের কথা। ভূমি প্রশাসনে কর্মরত দূর্নীতিগস্ত এক পিয়নের ব্যাপারে পত্র-পত্রিকায় ধারাবাহিক অনুসন্ধানী প্রতিবেদন বেরিয়েছিল। এর কয়েকদিন পর তথাকথিত এক মানবাধিকার সংস্হার কর্তাব্যক্তির ফোন। কেরামত আলী ফোন রিসিভ করার পর মানবাধিকারওয়ালা বিভিন্নভাবে ধমক দিল। পিয়নের দূর্নীতি নিয়ে নিউজ করায় নাকি মানবাধিকার ক্ষুন্ন হয়েছে ইত্যাদি ইত্যাদি। কেরামত বলল, মানবাধিকার লংঘন হলে আপনারা মামলা করেন, আইনগত ব্যবস্হা নেন। আরো অনেকভাবে বুঝাল কোরামত । কিন্তু মানবাধিকার বেটা তা মানতে নারাজ হয়ে ধমকাতে লাগল। অবশেষে বাধ্য হয়েই সভ্যতার বাইরে কয়েকটি শব্দ উচ্চারন করে কেরামত বলল, “বাড়াবাড়ি বেশী করলে পানি খাওয়ার জন্যও দাঁত থাকবেনা”। এরপর চুপ মেরে গিয়েছিল মানবাধিকার ফেরিওয়ালা।
কেরামত পরে শুনেছিল, পিয়ন থেকে নেওয়া কয়েকশ টাকার বিনিময়েই নাকি মানবাধিকার উথলে উঠেছিল।
এই হল হালজামানার মানবাধিকার সংস্হা ও মানবাধিকারের মাজেজা !

হাল আমলে ব্যাঙের ছাতার মত যত্রতত্র গজিয়ে উঠা তথাকথিত মানবাধিকার সংস্হাগুলোর বেশুমার ধান্ধাবাজি বন্ধ করতে “মানবাধিকার সংস্হা প্রতিরোধ কমিটি” গঠন করার প্রয়োজন মনে করল কেরামত।

আরেকটা ব্যাপার মনে পড়ল কেরামত আলীর। চিহ্নিত এক ডাকাত ও ডজন মামলার জেলফেরৎ আসামী কয়েকবছর আগে হঠাৎ করেই মানবাধিকারের মহা ঠিকাদার হয়ে গেল। আলীশান অফিস নিয়ে বসে বিচার-বাণিজ্য, বে আইনি নোটিশ দিয়ে নীরিহ মানুষজনকে ডেকে এনে হয়রানি করা, ধমক দিয়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়া ও বিচারের জামানত আত্নসাৎসহ বিভিন্ন অপকর্মে জড়িয়ে পড়েছিল সে। মানবাধিকার কার্ড দেয়ার নামে সহজ-সরল শতাধিক যুবকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকাও হাতিয়ে নেয় সে।

এরপর এক সুন্দর সকালে সবাই দেখল মানবাধিকার কারবারীর অফিস ও ফোন বন্ধ। প্রতারনার শিকার জনগন এবার দলবলে হানা দিল তার গ্রামের বাড়ীতে। কিন্তু এর আগের রাতেই মানবাধিকার সওদাগর দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। বেচারা এখন নাকি সৌদী আরবে খেয়ে না খেয়ে পার্টটাইম দারোয়ানী করছে।
এই হল হালজামানার মানবাধিকার !

এসব কথা ভাবতে ভাবতে বাসার দিকে হাঁটা দিল কেরামত আলী। বাসায় পৌঁছে বাজারের ব্যাগটা বউয়ের হাতে দিল। বাজার থেকে আনা জিনিসগুলো চেক করে বউ রাগে গজগজ করতে লাগল। ব্যাপার হল, বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে রান্নার অনুষ্ঠানের নিয়মিত দর্শক কেরামতের বউ মলকা বানু। ওখানকার হাবিজাবি রেসিপিগুলো এ্যপ্লাই করে আজগুবি সব অাইটেম প্রায়ই রান্না করে, আর অতি অখাদ্য সেসব খেয়ে কেরামত আলীকে অবাক হওয়ার ভান করে “ওয়াও টেস্টি/ অপূর্ব বলতে হয়। আজও সেরকম কয়েকটি রেসিপির কাঁচামাল আনতে বলেছিল, আর ভূলোমন কেরামত তা বিলকুল ভূলে বসে আছে। এতে মলকা বানু রেগে টং।

এরপরের কাহিনী আরো করুন। বাসার পরিবেশ ক্রমেই উত্তপ্ত হওয়ার সমূহ আশংকা দেখে শান্তি বজায় রাখার চেষ্টা করে কেরামত মিনমিন স্বরে আজ মানবাধিকার দিবসের কথা স্মরন করিয়ে দিল। কিন্তু “বাসার বাজারের সাথে মানবাধিকারের সম্পর্ক কি” বলেই প্রমাণ সাইজের বটি দা হাতে নিয়ে তেড়ে এল মলকা বানু।

বিশ্ব মানবাধিকার দিবসের সকালে নিজ বাসায় মানবাধিকার লংঘনের শিকার হয়ে পৈত্রিক প্রাণটা নিয়ে ভোঁ-দৌঁড় দিল কেরামত।
কোন এক সুন্দর সকালে সবখানেই হয়তো প্রকৃত মানবাধিকারের চর্চা হবে, মানবাধিকারের নামে অপকর্ম – ধান্ধাবাজি ও বাণিজ্য বন্ধ হবে।
কেরামত আলী প্রহর গুণে …