ডেস্ক নিউজ:
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে শুরু থেকেই দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগের পাশাপাশি এ বিষয়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ বাড়াতে বিশ্ব সম্প্রদায়ের মাধ্যমে বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। আগামীকাল মঙ্গলবার (১২ ডিসেম্বর) নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মিয়ানমারকে যে মুখোমুখি করা সম্ভব হচ্ছে তা এই বহুপাক্ষিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টারই ফল। ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই মামলার শুনানি চলবে। এতে মামলার বাদী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধি হিসেবে গাম্বিয়া, মামলা পরিচালনা করবেন দেশটির বিচারমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল আবুবকর মারি তামবেদ্যু আর মিয়ানমারের পক্ষ থেকে মামলায় লড়তে আসছেন দেশটির স্টেট কাউন্সিলর অং সান সুচি। বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিবের নেতৃত্বে একটি বড় প্রতিনিধিদল সর্বাত্মক সহায়তা দেবেন গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রীকে। প্রথম শুনানির এক মাসের মধ্যেই এ বিষয়ে একটি ইতিবাচক অন্তর্বর্তীকালীন রায় পাওয়ার আশায় আছে বাংলাদেশ।

মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন থেকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের টেকনাফ সীমান্তে আশ্রয় নেওয়ার মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সংকট বিশ্ব সম্প্রদায়ের সামনে চলে আসে। তবে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপরেশনস’ অভিযানের শুরু এরও এক বছর আগে। ২০১৬ সালের ৯ অক্টোবর রাখাইনে একটি সীমান্ত ফাঁড়িতে আক্রমণের অজুহাত দেখিয়ে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেবছর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশনস’ শুরু করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। সেসময় এই মুসলমান সম্প্রদায়ের একাংশের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে সফল হয় সামরিক জান্তারা। আর নির্যাতন চরমে পৌঁছালে অক্টোবর থেকে পরের জুলাই পর্যন্ত প্রায় ৯০ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে আসে বাংলাদেশে। তবে এ বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা হত্যা, ধর্ষণসহ মারাত্মক নিপীড়নের শিকার হয়ে উদ্বাস্তু হওয়ায় এ অভিযানের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে রাখাইন থেকে রোহিঙ্গাদের নিশ্চিহ্ন করতে নতুন পরিকল্পনা আঁটে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী।

পরের ধাপে রোহিঙ্গা নিধন ও উচ্ছেদের বিশদ পরিকল্পনা করে সেনা নিয়ন্ত্রণাধীন মিয়ানমার সরকার। আগের পরিকল্পনার মতোই ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বেশ কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়িতে আক্রমণের ঘটনার অজুহাতে বন্ধ থাকা ‘ক্লিয়ারেন্স অপরেশনস’ নতুন করে শুরু করে মিয়ানমার বাহিনী। আগেরবারে রোহিঙ্গাদের একাংশকে টার্গেট করলেও ২০১৭ তে গণহত্যার উদ্দেশ্য নিয়ে গোটা উত্তর রাখাইনজুড়ে হামলা শুরু করে মিয়ানমার বাহিনী। এতে সহযোগিতা করে দেশটির বেশ কিছু বৌদ্ধ সম্প্রদায়। মিয়ানমার সেনাবাহিনী প্রায় চারশ’ গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিক পুড়িয়ে দেয় এবং সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। বাংলাদেশ, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, ফিলিপাইন ও নরওয়ের গবেষকরা একটি জরিপ করে এবং ওই জরিপের প্রাক্কলন অনুযায়ী ২৫ হাজারের মতো রোহিঙ্গা নিহত হয়।

এদিকে, প্রথম থেকেই বাংলাদেশ বিষয়টি দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করে যাচ্ছে। হামলা শুরু হওয়ার দুই মাসের মধ্যে প্রত্যাবাসন সংক্রান্ত একটি সমঝোতা সই করে দুই দেশ। আর দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগের পাশাপাশি মিয়ানমারের ওপর চাপ অব্যাহত রাখার জন্য বহুপাক্ষিক উদ্যোগ অব্যাহত রাখে বাংলাদেশ। তারই অংশ হিসেবে বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) ও আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে (আইসিজে) মামলার সম্মুখীন মিয়ানমার। এরমধ্যে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালতে ওআইসির পক্ষ থেকে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করেছে এবং এর শুনানি শুরু হচ্ছে মঙ্গলবার (১০ ডিসেম্বর)। অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তাদের তদন্ত কার্যক্রম শুরু করার অনুমোদন পেয়ে গেছে। অন্যান্য জায়গায় আন্তর্জাতিক অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করার মানদণ্ডে এই বিচার প্রক্রিয়া অল্প সময় অর্থাৎ দুই বছরের মধ্যে শুরু হয়েছে।

আইসিজে কী ধরনের আদালত?

আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত (আইসিজে) হচ্ছে সারাবিশ্বের আদালত। জাতিসংঘের যে ছয়টি অঙ্গ সংগঠন আছে আইসিজে তার মধ্যে একটি। এটি সাধারণত জাতিসংঘের আদালত হিসেবে পরিচিত। আইসিজের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এখানে শুধুমাত্র দেওয়ানি মামলা করা যায়, ফৌজদারি নয়। ফৌজদারি মামলা করতে হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি)। ১৯৪৬ সালে যাত্রা শুরু হওয়া আইসিজেতে প্রথম মামলা হয় ১৯৪৭ সালে (যুক্তরাজ্য বনাম আলবেনিয়া)। এখন পর্যন্ত প্রায় ১৮০টির মতো মামলা হয়েছে ওই কোর্টে। বর্তমানে ১৭টি মামলার বিচার প্রক্রিয়াধীন আছে। এই আদালতের সদর দফতর নেদারল্যান্ডসের হেগে অবস্থিত।

এই আদালতে এর সদস্য দেশ অন্য দেশের বিরুদ্ধে সুমদ্র সীমানা নির্ধারণ, গণহত্যা, তিমি শিকার, পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা, অন্যদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে নাক গলানো, এমনকি নাগরিক সুরক্ষা সংক্রান্ত মামলাসহ যেকোনও বিষয়ে সুরাহার আবেদন করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ভারতীয় একজন নাগরিককে পাকিস্তান মৃত্যুদণ্ড প্রদান করলে ওই ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য ২০১৭ সালে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আইসিজেতে মামলা করে। মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবে রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যা, গণধর্ষণ, নির্যাতন, উচ্ছেদসহ যেসব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত হয়েছে সেগুলোকে দেওয়ানি মামলা হিসেবে উপস্থাপন করে দেশটির সরকারের বিরুদ্ধে এই আদালতে মামলা করেছে গাম্বিয়া। বাংলাদেশ তাদের সার্বিকভাবে সহযোগিতা করছে।

গাম্বিয়া কেন মামলা করলো

২০১৮ সালে বাংলাদেশে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশনের মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন হয়। এই সম্মেলনে গাম্বিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর আসার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর স্থলে ওই দেশের অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি তামবেদ্যুকে পাঠানো হয়। ঢাকায় পৌঁছানোর পরে তামবেদ্যু অন্য দেশের মন্ত্রীদের সঙ্গে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প সফর করেন। ২০১৮ সালের ৫ ও ৬ মে অনুষ্ঠিত ওই মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মুসলিম দেশগুলো সিদ্ধান্ত নেয় রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য গাম্বিয়ার নেতৃত্বে একটি অ্যাডহক কমিটি করা হবে এবং এ সংক্রান্ত যাবতীয় কাজ গাম্বিয়া সম্পন্ন করবে। বাংলাদেশসহ অন্য আরও কয়েকটি দেশ এই কমিটির সদস্য এবং সবার সহযোগিতা নিয়ে গাম্বিয়া এ বছরের ১১ নভেম্বর ওই মামলা করেছে।

গাম্বিয়ার আরেকটি সুবিধা হচ্ছে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত ও গণহত্যা বিষয়ক বিচার প্রক্রিয়া বিষয়ে অগাধ জ্ঞান আছে দেশটির বিচারমন্ত্রী আবুবকর মারি’র। ৪৭ বছর বয়সী ব্যারিস্টার আবুবকর রুয়ান্ডা গণহত্যা সংক্রান্ত মামলায় কৌঁসুলি হিসেবে কাজ করেছেন। এছাড়া জাতিসংঘের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করার সুবাদে আন্তর্জাতিক বিচারিক আদালত যা জাতিসংঘের কোর্ট হিসাবে পরিচিত সেটি সম্পর্কেও তার ভালো ধারণা আছে। মামলা পরিচালনার কাজে আবুবকরকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রখ্যাত আইনি প্রতিষ্ঠান ফলি হগ সহায়তা করবে। এই ফলি হগ সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির মামলায় বাংলাদেশের পক্ষে আইনি প্রতিষ্ঠান ছিল।

মামলার আবেদনে যা বলা হয়েছে

গাম্বিয়া তার প্রাথমিক আবেদনে গণহত্যা কনভেনশনের ৯ নম্বর ধারা বলে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছে। গাম্বিয়া ও মিয়ানমার উভয়ই জেনোসাইড কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ। জাতিসংঘ ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং মিশনের রিপোর্ট, জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্টসহ অন্যান্য রিপোর্টকে উদ্ধৃত করে গাম্বিয়া বর্তমান ঘটনাপ্রবাহের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছে।

গাম্বিয়ার পক্ষ থেকে আইসিজে’র কাছে কয়েকটি বিষয়ে সুরাহা চাওয়া হয়েছে। এর মধ্যে প্রথমে চাওয়া হয়েছে মিয়ানমার গণহত্যা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে সে সম্পর্কিত ঘোষণা, মিয়ানমার যেন এই কনভেনশন মেনে চলে সে সম্পর্কিত ঘোষণা, যারা গণহত্যা করেছে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব, প্রত্যাবাসনসহ ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার নির্দেশ।

যেহেতু এধরনের মামলা অনেক দিন ধরে চলে সেজন্য গাম্বিয়া একটি অন্তর্বর্তীকালীন আদেশ চেয়েছে এই আদালতের কাছে, যাতে করে মিয়ানমার এই সংক্রান্ত কোনও প্রমাণ ধ্বংস করে না ফেলতে পারে। এই অন্তর্বর্তীকালীন আদেশের শুনানি হবে আগামী ১০ থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত। আশা করা হচ্ছে, এই শুনানি শেষের এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি আদেশ পাওয়া যাবে।

এই শুনানিতে গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা পরিচালনা করবেন ওই দেশের বিচারমন্ত্রী। অন্যদিকে মিয়ানমার ঘোষণা করেছে তাদের পক্ষে মামলায় অংশ নেবেন স্টেট কাউন্সিলর অং সান সু চি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হকের নেতৃত্বে একটি বড় প্রতিনিধিদল নেদারল্যান্ডসে উপস্থিতি থাকবেন এবং গাম্বিয়াকে সর্বাত্মক সহায়তা করবেন।