আজাদ মনসুরঃ
একজন স্বপ্নবাজ মানুষ, তাঁর পরিচয় নাটকেই। থিয়েটার নিয়ে নতুন নতুন চিন্তা-আর উদ্ভাবনী শক্তিতে তাঁর হাত ধ্রুবতারার মতো। জেলাশহরে যদিও পদ-পদবী ও আত্মপ্রচারে অনেকেই মূল কাজটি থেকে বিচ্যুত হন, কিন্ত আজ এমন একজন মানুষের কথা বলবো, যিনি একাধারে অভিনেতা, নাট্যকার, নাট্য নির্দেশক, নাট্যসংগঠক ও কক্সবাজার জেলার আধুনিক নাট্যচর্চার অন্যতম পথিকৃৎ। তিনি বিচ্যুত হননি, সমৃদ্ধ করেছেন জেলার নাট্যাঙ্গন।
তাঁর চিন্তা-পাণ্ডিত্য-বোধের সমন্বয়ে লিখছেন নাটক, নির্দেশক হিসেবে দৃশ্য পরম্পরাকে গেঁথে অভিনয়শিল্পীদের রূপায়ন করে দিয়েছেন নানা চরিত্রে। আলোক-সেট, পোশাক-সংগীত ও নতুন পরিকল্পনা দিয়ে নিজের মেধাকে কাজে লাগিয়ে সমৃদ্ধ করেছেন কক্সবাজার জেলায় গ্রুপ থিয়েটার চর্চাকে। কক্সবাজার জেলার নাট্যচর্চাকে জাতীয় পর্যায়ে সম্মানিত ও প্রতিষ্ঠিত করেছেন যিনি, সেই খ্যাতিমান নাট্যযোদ্ধা, থিয়েটার চর্চার পুরোধা ব্যক্তি স্বপন ভট্টাচার্য্যরে কথাই বলছি।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের নাট্যকলা শাখায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী স্বপন ভট্টাচার্য্য চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার নাট্যচর্চায় ১৯৮২ হতে ১৯৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাট্য নির্দেশনা, নাট্য কর্মশালা পরিচালনা ও চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার সমন্বয় পরিষদের নানাবিধ কর্মকান্ডে নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৮৫ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের অন্যতম নাট্যদল “সমীকরণ থিয়েটার” এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং দীর্ঘ সময় পর্যন্ত দলীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন।
সংস্কৃতিবান্ধব পারিবারিক পরিমন্ডলে বেড়ে উঠা শৈশবেই সংগীত, আবৃত্তি ও অভিনয়ের প্রতি অনুরাগী হয়ে উঠেন। বড়দাদা অজিত ভট্টাচার্য্যের হাত ধরে ১৯৮২ খ্রিস্টাব্দে চট্টগ্রামের গ্রুপ থিয়েটার চর্চার অন্যতম নাট্য সংগঠন ‘রূপকার’ এর সদস্য হয়ে গ্রুপ থিয়েটার নাট্য চর্চার সূত্রপাত করেন। যদিও সংস্কৃতি চর্চা শুরু করেন চট্টগ্রামের শিশু সংগঠন ‘শিশুমেলা’র অন্যতম সংগঠক হিসেবে। প্রথম অভিনীত মঞ্চনাটক রূপকার এর প্রযোজনায় জহির রায়হান এর গল্প অবলম্বনে ‘অপরাধ’।
পরবর্তী সময়ে কক্সবাজার থিয়েটারের আমন্ত্রণে কক্সবাজারে নাটকের নির্দেশনার কাজ করতে গিয়ে নিজের মেধার সম্মিলন ঘটিয়ে সমৃদ্ধ করেন কক্সবাজার জেলার নাট্যাঙ্গন। নাটককে ভালবেসে কক্সবাজারের প্রায় প্রতিটি নাট্যদলের সাথে একের পর এক নাট্য নির্দেশনার কাজ করেছেন। ব্যক্তিগত কোন লোভ, ভালো চাকরীর প্রাতিষ্ঠানিক মোহ তাঁকে নাটকের অঙ্গন থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। নাট্যকার, নির্দেশক ও নাট্যসংগঠক হিসেবে তিনি ধারাবাহিকভাবে অর্জন করেছেন সম্মান, নাট্যকর্মিদের নির্ভরযোগ্যতা, আস্থা, বিশ্বাস ও ভালবাসা।
স্পষ্টবাদী ও আপোষহীন নেতৃত্বের কারনে অনেকের ঈর্ষার কারণ হওয়া কক্সবাজারের নব নাট্যান্দোলনের রূপকার স্বপন ভট্টাচার্য্য ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ মে চট্টগ্রাম শহরের ঘাটফরহাদবেগ এলাকায় হিমাংশু বিকাশ ভট্টাচার্য্য ও জোৎস্নাময়ী ভট্টাচার্য্যের ঔরশজাত পঞ্চম সন্তান।
বাংলাদেশের নাগরিক থিয়েটারচর্চা মূলত ঢাকাকেন্দ্রিক। এর বাইরে নিয়মিত চর্চার উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামকে বিবেচনা করতে হয়। আর বাকি বিভাগীয় শহরগুলোতে নানামাত্রায় চালু রয়েছে থিয়েটারচর্চা। কতিপয় ব্যতিক্রম বাদে জেলা শহর আর থানাগুলোতে বিভিন্ন দিবস ঘিরে নাটকের টিমটিমে বাতিটি জ্বলে থাকলেও তাতে প্রাণের প্রতিষ্ঠা নেই। কিন্তু অনেক না থাকা ও না পাওয়ার জেলা শহরে একদল তারুন্যকে আধুনিক নাট্যচর্চায় প্রাণিত করেছেন একজন স্বপন ভট্টাচার্য্য। তরুণদের সাথে শিল্পের নানা শাখা প্রশাখার গল্প ও তর্কে মেতেছেন চা স্টলে, পাবলিক লাইব্রেরীর খোলা চত্বরে কিংবা রাস্তার রকে। উৎসাহিত করেছেন তরুণদের ভাবনার দিগন্ত প্রসারে। কাঁধে হাত রেখেছেন, বন্ধু হয়েছেন, বেখেয়ালী কাউকে শাসিয়েছেন সুমিষ্ট ভাষনে।
নাট্যকলায় সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ স্বপন ভট্টাচার্য্য অর্জন করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, কক্সবাজার জেলা ‘সম্মাননা’ পদক। এছাড়া বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক সম্মাননার পাশাপাশি তাঁর দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন কক্সবাজার সিটি কলেজ এ ২০১৮ সালে সর্বপ্রথম “থিয়েটার স্টাডিজ” বিভাগ (পোস্ট গ্রাজুয়েট ডিপ্লোমা কোর্স) চালু করা হয়েছে। অর্থাৎ এখন কক্সবাজারেও থিয়েটার নিয়ে একাডেমিক পড়াশুনা হচ্ছে, যা জেলাবাসীর জন্য গর্বের ও আনন্দের।
এক প্রশ্নের জবাবে স্বপন ভট্টাচার্য্য জানান, নাট্যগুরু হিসেবে তিনি তাঁর বড়দাদা অজিত ভট্টাচার্য্য, অধ্যাপক মশিউর রহমান আদনান এবং আফরোজ আহমেদ মিরজু’র নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। শিক্ষাগুরু প্রফেসর জিয়া হায়দার ও কামাল উদ্দীন নীলু কে তাঁর নাট্যজীবনের অন্যতম পথ প্রদর্শক হিসেবে মেনে চলেন। নিজের নির্দেশিত প্রথম মঞ্চনাটক সমীকরণ থিয়েটারের প্রযোজনায় হিন্দি কথা সাহিত্যিক প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে সৌমেন্দু ঘোষের নাটক ‘ঋণশোধ’।
নির্দেশিত নাটকের মধ্যে ঋণশোধ, তোতাকাহিনী, তোমরাই, সম্প্রীতি, পুতুলখেলা, মেষ ও রাক্ষস, প্রজন্মের অঙ্গীকার, ঘটনা যা ঘটলো, টু ইডিয়টস, মাধবী, বিবাহ বিভ্রাট, ক্রসবাঁধ, সম্পর্কের আবর্তে, নীল সমুদ্রের ঝড়, পালিয়ে বেড়ায়, তিতাস একটি নদীর নাম, কবর, পরীবানু, শ্রী কৃষ্ণায়ন, রাধাকৃষ্ণ সুধা, পরমহংস শ্রী শ্রী রামকৃষ্ণ, মানুষ ভূত, যখন বৃত্তের বাইরে, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, আত্মদহন, দেনা পাওনা, বাঁধ ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, শব্দের বিজয় গাঁথা ও মনবৈরি অন্যতম।
তিনি বলেন, তাঁর রচিত ও রূপান্তরিত নাটকগুলো হলো পুতুলখেলা, প্রজন্মের অঙ্গীকার, দুষ্টু মোরগ, টু ইডিয়টস, ট্রাংক রহস্য, অভীপ্সিত, সম্পর্কের আবর্তে, নীল সমুদ্রের ঝড়. যখন বৃত্তের বাইরে, দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা, দেনাপাওনা, আত্মদহন, বাঁধ ও বিশ্বাসের দ্বন্দ্ব, শব্দের বিজয়গাঁথা ও মনবৈরি উল্লেখযোগ্য।
নাটক নিয়ে কাজ করা এই প্রখ্যাত নাট্য নির্মাতা নাটকের মাধ্যমে সমাজ উন্নয়নে অবদানের জন্য ২০১৪ খ্রিস্টাব্দে সমাজ উন্নয়ন মূলক সংগঠন ‘সমন্বয়’ কর্তৃক সম্মাননায় ভূষিত হন। ২০১৫ খ্রিস্টাব্দে ট্রাংক রহস্য নাটকের ২০০তম প্রদর্শনী উপলক্ষ্যে নাট্যকার হিসেবে সমীকরণ থিয়েটার সম্মাননা এবং ২০১৬ চট্টগ্রামের অন্যতম নাট্যদল অরিন্দম আয়োজিত অরিন্দম নাট্য উৎসবে ‘মঞ্চের কুশীলব’ সম্মাননা অর্জন করেন।
সর্বশেষ দেশের চারজন প্রতিশ্রুতিশীল নাট্য নির্দেশককে দেওয়া হচ্ছে নান্দীমুখ সম্মাননা। নান্দীমুখ’র ৩০ বছরপূর্তি উপলক্ষ্যে বছরব্যাপী অনুষ্ঠানমালার প্রথম আয়োজন নান্দীমুখ আন্তর্জাতিক নাট্যোৎসব-২০১৯ এর শেষদিন ২২ নভেম্বর এই চারজনের একজন আমাদের সকলের প্রিয়জন স্বপন ভট্টাচার্য নান্দীমুখ থেকে সম্মাননা গ্রহণ করার কথা রয়েছে।
তিনি কক্সবাজার জেলা শিল্পকলা একাডেমি’র ২০০৪-২০০৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত নাট্য প্রশিক্ষকের দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় মঞ্চায়িত ককস্বাজার শিল্পকলা একাডেমি নাটক বিভাগের পরিবেশনা অদ্বৈত মল্ল বর্মনের “তিতাস একটি নদীর নাম” ও কক্সবাজারের লোকঐতিহ্যবাহী হঁঅলা অবলম্বনে ‘পরীবানু’ উল্লেখযোগ্য প্রযোজনা।
পেশাগত জীবনে বর্তমানে তিনি কক্সবাজার সিটি কলেজের থিয়েটার স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন খুব সফলতার সাথে। পাশাপাশি বাংলাদেশ বেতার, কক্সবাজার কেন্দ্রের নাট্য প্রযোজক হিসেবে নিয়োজিত আছেন। বাংলাদেশ বেতার কক্সবাজার কেন্দ্রে তাঁর রচিত শ্রুতি নাটক ও স্পটের সংখ্যা শতাধিক। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কক্সবাজার বেতার শিল্পী সমন্বয় পরিষদের। জড়িত রয়েছেন চট্টগ্রামের অন্যতম নাট্য পত্রিকা থিয়েটার ফ্রন্ট, নাটক কথা ও ফ্রন্টলাইন থিয়েটার এর প্রকাশনা,উপদেষ্টাও নিয়মিত নাট্য বিষয়ক লেখালেখির সঙ্গে।
কক্সবাজারের অন্যতম প্রধান নাট্য সংগঠন কক্সবাজার থিয়েটারের তিনি দলীয় নাট্যকার, নির্দেশক এবং কার্যনির্বাহী পর্ষদের অন্যতম সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শিক্ষক ও সংগীত শিল্পী সহধর্মিনী বনানী চক্রবর্ত্তী ও একমাত্র সন্তান পিয়াল ভট্টাচার্য্য তাঁর সকল অনিয়ম ও সৃষ্টিশীল কাজের নীরব স্বাক্ষী হয়ে তো আছেনই। তাই যদি বলি একজন স্বপন ভট্টাচার্য্যরা শত বছরে একবারই জন্মায়। ওনার হাত ধরেই একদিন সন্ধ্যায় পাবলিক লাইব্রেরীর হল মুখরিত হবে তরুণদের কোলাহলে। মাদকের নেশার বদলে তাঁরা মেতে উঠবে নাটকের নেশায়, শিল্পের নেশায়। দাদা আমার, এগিয়ে গেলেই সুখ…
লেখকঃ নাট্য ও সংস্কৃতিকর্মী
সদস্য-কক্সবাজার থিয়েটার
(azadcox90@gmail.com/০১৮৪৫ ৬৯ ৫৯ ১৬)